আমদানি ও বেসরকারি খাতে বিদুৎ উৎপানের কারনেই বিদুৎতের দাম বাড়তি
দেশের বাইরে থেকে এবং বেসরকারি খাত থেকে সরকার বিদুৎ কেনার কারনেই বিদুৎতের দাম বেশি পড়ছে। দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্রিড ভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে ১৩ হাজার থেকে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। চাহিদা আছে সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট।
বেসরকারি খাতের ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বর্তমানে প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ আসছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর দেশের চাহিদা মেটাতে সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াড। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় হয় ১১ টাকা দুই পয়সা। এর মধ্যে আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কিনতেই গড়ে ১৩ টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। যদিও গত অর্থবছর বিদ্যুৎ বিক্রির গড় মূল্য ছিল পাইকারিতে সাত টাকারও কম।
গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নিজস্ব কেন্দ্রগুলোর গড় ব্যয় ছিল আট টাকার কিছু বেশি। সরকারি অন্য কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় ব্যয় ছিল সাত টাকারও কম। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতেও গড়ে ব্যয় হয়েছে পৌনে ১২ টাকা। অর্থাৎ বেসরকারি খাত ও আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে।
পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর সংস্থাটির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ১হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াড অর্থাৎ পিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলো থেকে এসেছে মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়ে প্রায় আট হাজার ৫২২ কোটি টাকা এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওঅ্যান্ডএম) ব্যয় ৪২৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এছাড়া বেতন-ভাতাসহ স্থায়ী ব্যয় ছিল তিন হাজার ৯৪০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ১২ হাজার ৯০৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এতে পিডিবির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে আট টাকা ১৫ পয়সা। এদিকে পিডিবি ছাড়া অন্যান্য সরকারি কোম্পানির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ১ হাজার ৫৬৭ মেগাওয়াট, যা মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে পাঁচ হাজার ৮৫২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ২৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর বেতন-ভাতাসহ স্থায়ী ব্যয় ছিল চার হাজার ৮২৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ১০ হাজার ৯৪০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এতে অন্য সরকারি কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছে ছয় টাকা ৯৮ পয়সা; যা সবচেয়ে কম।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের মধ্যে আইপিপিগুলোয় গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে চার হাজার ৩২৪ মেগাওয়াট , যা মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে ৩২ হাজার ১৯৬ কোটি ৪ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় দুই হাজার ১১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ২২ হাজার ৫৫০ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ৫৬ হাজার ৮৬১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এতে আইপিপিগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় পড়েছে ১৩ টাকা ১৫ পয়সা।
বেসরকারি রেন্টালের সংখ্যা কমে আসায় এ খাত থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহও অনেক কমে গেছে। গত অর্থবছর এ খাত থেকে বিদ্যুৎ এসেছে মাত্র ২১৮ মেগাওয়াট বা দুই দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ খাতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে দুই হাজার ১৯১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ৩৩৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৩১৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে দুই হাজার ৮৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এতে আইপিপিগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় পড়েছে ১৩ টাকা ০১ পয়সা।
এর বাইরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে গত অর্থবছর ১হাজার ৬৪৬ মেগাওয়াড, যা মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে ৯ হাজার ৪৮১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ১ হাজার ৬১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আর স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল আট হাজার ২৭৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ১৯ হাজার ৩৬৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এতে আমদানি বিদ্যুতের গড়ে ব্যয় পড়েছে ১১ টাকা ৭৬ পয়সা। যদিও এর মধ্যে আদানির একার গড় ব্যয়ই ছিল ১৪ টাকা ৮৩ পয়সা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উচ্চ ব্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল অত্যধিক জ্বালানি ব্যয়। গত অর্থবছর পিডিবির গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল পাঁচ টাকা ৮৩ পয়সা এবং অন্য সরকারি কেন্দ্রে তিন টাকা ৭৩ পয়সা। তবে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর মধ্যে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল আইপিপিতে সাত টাকা ৪৫ পয়সা ও রেন্টালে ১০ টাকা দুই পয়সা। আর আমদানির ক্ষেত্রে গড় জ্বালানি ব্যয় পাঁচ টাকা ৭৬ পয়সা।
অন্যদিকে পিডিবির গড় স্থায়ী ব্যয় মাত্র দুই টাকা ৫০ পয়সা এবং অন্য বেসরকারি কেন্দ্রে গড়ে তিন টাকা ০৮ পয়সা। তবে বেসরকারি খাতে গড় স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ আইপিপিতে পাঁচ টাকা ২১ পয়সা ও রেন্টালে দুই টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ আইপিপির ক্যাপাসিটি চার্জও ছিল উচ্চ। আমদানির ক্ষেত্রে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পাঁচ টাকা তিন পয়সা। তবে আদানির ক্ষেত্রে এ ব্যয় সাত টাকা ১৩ পয়সা।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে এবার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে সাড়ে সতের হাজার মেগাওয়াট। পুরো জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে করতে হবে লোডশেডিং।
এখনো গ্যাসের অভাবে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কেন্দ্র ভাড়া দেয়ার জন্য ব্যয় বাড়ছে পিডিবির। এ বিষয় বিদুৎ উন্নয়ন বোডর্র(বিউবো) সদস্য(উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মল হোসেন দৈনিক সকালের সময়কে বলেন, আমাদের বিদুৎ উৎপানের যন্ত্রগুলো অনেক পুরানো হয়ে গেছে এ জন্য ক্যাপাসিটি অনেক কমে গেছে। তা ছাড়া আমরা উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান গ্যাস পাচ্ছিনা, এজন্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শীতের সময় তো গ্যাসের চাপ আরো কম থাকে। অয়েল দ¦ারা যে বিদুৎ প্যান্টগুলো চলে তার উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। আমরা চাহিদা মত উৎপাদন করতে পারছিনা বলেই বেসরকারি ও বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের আর্থিক পরিস্থিতি এবং ডলার সংকট মিলিয়ে এ বছর বিদ্যুৎ চাহিদা কীভাবে সামাল দেয় সরকার সেটি দেখার বিষয়। সক্ষমতা থাকার পরও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারাটা সরকারের কাঠামোগত সমস্যা হিসেবেই দেখেন তিনি।
বাংলাদেশ সরকারের সবচে বড় সাফল্যের জায়গা একটা হলো বিদ্যুতের সক্ষমতা বৃদ্ধি। আবার এ সরকারের সবচে বড় বিপদের জায়গাই হলো সেই অর্থে একটা খুবই ভ্রান্ত বিদ্যুৎ বা জ্বালানি নীতি। কী একটা অদ্ভুত দেশ! আগে খাম্বা ছিল বিদ্যুৎ ছিল না, এখন বিদ্যুতের সক্ষমতা আছে আমরা সেগুলোকে চালু রাখতে পারি না।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতার ভেতরে বিদ্যুৎ খাতকে আগামী দিনে একটা কেইসস্টাডি হিসেবে দেখা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এমএসএম / এমএসএম