ফেসবুকে কিডনি বেচাকেনার হাট : গ্রেফতার ৫
কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের পার্শ্ববর্তী দেশে চিকিৎসা সহায়তার নাম করে, অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে, কিডনি প্রতিস্থাপনে উৎসাহিত করতো একটি চক্র। রোগীদের সেবা দেওয়ার আড়ালে ভয়ংকর কিডনি কেনাবেচার সিন্ডিকেট গড়ে তোলে চক্রটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচার সংঘবদ্ধ চক্রের অন্যতম হোতা মো. শহিদুল ইসলাম মিঠুসহ পাঁচ সদস্যকে রাজধানীর ভাটারা, বনশ্রী ও মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
র্যাব বলছে, চক্রের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী দেশের কিডনি কেনাবেচা চক্রের সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে শতাধিক মানুষকে পাচার করেছে। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য চক্রটি রোগীপ্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিতো। বিপরীতে কিডনি ডোনারকে চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিতে আশ্বস্ত করতো।
সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব সাইবার মনিটরিং সেল ভার্চুয়াল জগত তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনিসহ অন্যান্য মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সিন্ডিকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আসছিল। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা অনলাইনে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহক ও ডোনারদের আকৃষ্ট করে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) রাত ৮টা থেকে বুধবার (২০ জুলাই) ভোর ৫টা পর্যন্ত র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর ভাটারা, বনশ্রী ও মিরপুর এলাকায় কিডনি বেচাকেনা সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মো. শহিদুল ইসলাম মিঠুকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় চক্রের চার সহযোগীকেও গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- মো. মিজানুর রহমান (৪৪), মো. আল মামুন ওরফে মেহেদী (২৭), মো. সাইমন (২৮) ও মো. রাসেল হোসেন (২৪)।
অভিযানে কিডনি কেনাবেচার চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভিকটিমের সঙ্গে চুক্তির এফিডেভিট কপি, ভুক্তভোগীদের পাসপোর্টসহ মোট ১৪টি পাসপোর্ট, কিডনি ক্রসম্যাচিংয়ের বিভিন্ন দলিলাদি, দেশি ও বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই ও এটিএম কার্ড, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের জাল সিল, খালি স্ট্যাম্প, কম্পিউটার, মোবাইল ও সিম কার্ড জব্দ করা হয়।
বুধবার (২০ জুলাই) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন।
তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি কেনাবেচা এ চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি কেনাবেচার এ অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। চক্রের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি কেনাবেচা সদস্যদের চক্রের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক মানুষকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, চক্রের প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। চক্রের দ্বিতীয় দলটি প্রথম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।
পরবর্তীতে তৃতীয় ধাপ অন্য একটি গ্রুপ প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা নিরিক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে, তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভূয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভূক্তভোগী ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।
এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র যোগসাজশে ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারকে বিদেশের এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রপাচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমদের বৈধ/অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায়।
গ্রেফতার এই চক্রের মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগী প্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিতো। বিপরীতে তারা কিডনি ডোনারকে মাত্র ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করে এবং অগ্রীম ২ লাখ টাকা দিত। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের পর প্রলোভনের শিকার কিডনি দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদর্শন করতো।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক আরও বলেন, চক্রের মূলহোতা ও অন্যতম অভিযুক্ত মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু ২০১৬ সালে নিজের চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশে যায়। সেখানে অবস্থানকালীন সে কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগীদের ব্যাপক চাহিদা দেখতে পায় এবং সে নিজেই কিডনি প্রতিস্থাপনের অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা শুরু করে। পাশ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে সে এখানে কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র প্রতিষ্ঠা করে এবং অনলাইনের মাধ্যমে আগ্রহী বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতেন। এখন পর্যন্ত তার মাধ্যমে ৫০ এর বেশি কিডনি কেনাবেচা হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, গ্রেফতার মো. মিজানুর রহমান কিডনি ডোনারদের পার্শ্ববর্তী দেশে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট, ব্যাংক এনডোর্সমেন্ট, মেডিকেল ডকুমেন্টস, ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করে। উল্লেখ্য, যে সকল ব্যক্তিদের কাগজপত্র সঠিক থাকে না কিংবা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের ঘাটতি থাকে, তাদের কাগজপত্র জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুুত করে এবং সে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এ কাজ করে আসছিল।
গ্রেফতার মো. সাইমন গত এক বছর আগে ও মো. আল মামুন ওরফে মেহেদী ছয় মাস আগে চক্রটির মাধ্যমে জনপ্রতি ৪ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রয় করে। পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ে অধিক টাকা উপার্জনের লোভে তারা এ চক্রটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং কিডনি ডোনার ও ক্রেতা সংগ্রহে লিপ্ত হয়। তারা নিজেদের সুস্থতার প্রমাণ দেখিয়ে অন্যান্য ডোনারদের কিডনি বিক্রয়ে আগ্রহী করত। তারা এখন পর্যন্ত ১০ জনের কিডনি কেনাবেচা করেছে। এছাড়াও গ্রেফতার মো. রাসেল হোসেন ও তারা দুইজন মিলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সম্ভাব্য ডোনারদের সংগ্রহ করতো।
গ্রেফতার এই চক্রটি কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের পার্শ্ববর্তী দেশে কিডনি চিকিৎসায় সহায়তার নাম করে, অর্থ আয়ের উদ্দেশে, কিডনি প্রতিস্থাপনে উৎসাহিত করতো। কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানের আড়ালে তারা এ ভয়ঙ্কর কিডনি কেনাবেচার সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছিল।
এমএসএম / জামান