উত্তরপ্রদেশে মারধর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো নিত্য ঘটনা
জনসংখ্যার বিচারে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন আগামী বছরের শুরুতেই। ভোটের আগে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকেই খবর আসছে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে এবং মারধর করে তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেও বাধ্য করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনাগুলোর ভিডিও করে তা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও - যাতে মুসলিম সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুক্রবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব কথা উল্লেখ করা হয়।
সমাজকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, ভোটের আগে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের লক্ষ্যেই খুব পরিকল্পনা করে এই কান্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে - যদিও উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি এই অভিযোগ মানতে নারাজ।
মন্দিরে জল খেতে গিয়ে বিপদে : সময়টা এ বছরের মার্চের মাঝামাঝি, ঘটনাস্থল দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ। সেখানকার একটি হিন্দু মন্দিরে ঢুকে জল খাওয়ার অপরাধে ১২-১৩ বছরের একটি ছেলেকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে মারধর করছিল দুই তিনজন যুবক। শিশুটির নাম আসিফ; বাবার নাম হাবিব - এটা শোনার পর বেধড়ক মারের পাশে চলতে থাকে অকথ্য গালিগালাজ।
মোবাইল ফোনে গোটা ঘটনার ভিডিও করে পরে হোয়াটসঅ্যাপে আর ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে ওই যুবকরাই। যার হেনস্থার ভিডিও দেখে গোটা ভারত শিউড়ে উঠেছিল, সেই আসিফ পরে বিবিসিকে জানায়, শুধু মুসলিম হওয়ার জন্যই তাকে সেদিন ওভাবে মার খেতে হয়েছিল। সে বলে, ‘প্রথমে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে পেটায়; তারপর হাত-পা মুচড়ে দিয়ে লাথি মারতে থাকে আমাকে।’ বাবার সঙ্গে মিলে রাস্তার ময়লা কুড়িয়ে বাঁচা ছেলেটি ভয়ে কাঁপাতে কাঁপতে আরও বলেছিল, হিন্দুরা তাদের বাড়িতে এলে সে নিশ্চয় জল খাওয়াবে - কিন্তু কোনওদিন আর ভুলেও কোনও মন্দিরে জল খেতে ঢুকবে না।
‘তুই তো পাকিস্তানের চর’ : এর মাসতিনেক পরই গাজিয়াবাদের কাছে লোনিতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবদুস সামাদকে একটি নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে প্রবল মারধর করা হয়। জোর করে তাকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়, কাঁচি দিয়ে কেটে দেওয়া হয় লম্বা দাড়ি - আর এখানেও ভিডিও ধারণ করা হয় গোটা ঘটনাটির।
প্রবীণ মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে পরে বলেন, ‘ক্যানালের ধার থেকে আমাকে একটি অটোতে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওই হামলাকারীরা।’ তিনি বলেন, ‘একটু দূরে ছেড়ে দেবে বলে নিয়ে যায় একটা জঙ্গলে; তারপর একটা ঘরে আটকে রেখে বেধড়ক মার মারতে শুরু করে দেয়।’ তিনি বলেন, ‘ওরা শুধু আমাকে শ্রীরাম শ্রীরামই বলায়নি, বারবার বলছিল, করবি আর পাকিস্তানের দালালি?’
ফিরে আসছে দাঙ্গার স্মৃতি : পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের যে মুজফফরনগর ও শামলিতে আট বছর আগের দাঙ্গায় শত শত মুসলিম ঘরছাড়া হয়েছিলেন, সেখানেও হালে আবার ফিরে এসেছে সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। ‘মকতুব’ নামে একটি এনজিও-র হয়ে সেখানে দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে বহুদিন ধরে কাজ করছেন রাবিহা আবদুররহিম। রাবিহা বিবিসিকে জানান, মুসলিম ছেলেদের মারধর করে বা মেয়েদের হেনস্তা করে তার ভিডিও তুলে রাখার ঘটনা সেখানে আখছার (প্রায়ই) ঘটছে। তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, ওই এলাকার গ্রামে গ্রামে হিন্দু জাঠরা বড় বড় জমায়েত বা মহাপঞ্চায়েত ডেকে সেই সব নির্যাতন উদযাপন করছেন, মুসলিমদের প্রকাশ্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
রাবিহার কথায়, ‘মুসলিমদের লিঞ্চিং উপেক্ষা করা বা চুপচাপ বরদাস্ত করা এক জিনিস - কিন্তু হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে মুসলিমদের হত্যাকে সমর্থন করছে, উৎসব করছে - ভাবা যায়? এতো গণহত্যার প্রথম ধাপ!’ তিনি বলেন, ‘আজকের ভারতে, উত্তরপ্রদেশে বা হরিয়ানায় কিন্তু ঠিক সেই জিনিসই হচ্ছে।’
মুসলিম নির্যাতনেও পরিকল্পিত প্যাটার্ন : কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের আমলে উত্তরপ্রদেশে এ ধরনের ঘটনা এখন এতটাই ডালভাত হয়ে গেছে যে, এখন মিডিয়াতেও এসব খবর ঠাঁই পায় না বললেই চলে। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যটিতে মাত্র ছ-সাত মাস পরই বিধানসভা ভোট। তার ঠিক আগে সেই রাজ্যে মুসলিম নির্যাতন যেন একটা নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী চলছে, একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করছে, বিবিসিকে বলছিলেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্রনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট আফরিন ফতিমা।
আফরিন ফতিমা বলেন, ‘এ রাজ্যে মুসলিমদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে - আর পুরোটাই করা হচ্ছে পরিকল্পিত ছকে।’ তিনি বলেন, ‘গবেষণা বলে, যে কোনও দাঙ্গার পরই মুসলিমরা কিন্তু মিশ্র বসতির এলাকা ছেড়ে গিয়ে নিজেদের ঘেটো-তে গিয়ে বাস করতে চায়। এখানেও ভোটের আগে ভয় দেখিয়ে ঠিক সেভাবেই মুসলিমদের কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘রুটিরুজির প্রয়োজনে তাদেরও বাইরে বেরোতেই হয় - কিন্তু উত্তরপ্রদেশে প্রতিটি মুসলিম নারী-পুরুষ জানেন, প্রতিদিন বাড়ির বাইরে পা ফেলেই তারা বিরাট একটা ঝুঁকি নিচ্ছেন!’
শাসক দল বিজেপি যা বলছে : কিন্তু এই যে ধারাবাহিকভাবে রাজ্যের একটি সম্প্রদায়ের মানুষজন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, পুলিশ-প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদত ছাড়া এটা কি আদৌ সম্ভব হত? রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র সাক্ষী দিবাকর বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের সরকার সবার পাশে আছে, সবার উন্নয়নের জন্য কাজ করছে - ধর্মের ভিত্তিতে কোনও বিভেদ করার প্রশ্নই ওঠে না।’
তিনি বলেন, ‘আপনি যে ঘটনাগুলোর কথা বলছেন তার প্রতিটিতে যথাযথ তদন্ত হয়েছে, অভিযুক্তরা আটক হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আর উত্তরপ্রদেশ এমন একটা রাজ্য যেখানে হিন্দু বা মুসলিমদের জন্য আলাদা করে সরকার কোনও প্রকল্প নেয় না, রাজ্যের সবাই আমাদের চোখে সমান।’ সাক্ষী দিবাকর বলেন, ‘হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ - এ রাজ্যে বিদ্বেষের লড়াই মোটেই হয় না।’
সাবেক পুলিশ প্রধানের চোখে : তবে বিষয়টাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন ভারতের সবচেয়ে দক্ষ, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের একজন বিক্রম সিং। দীর্ঘদিন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের মহাপরিচালক পদে থাকা ড: বিক্রম সিং বিবিসিকে বলেন, ‘যে কোনও সভ্য সমাজে এরকম মেরুকরণের চেষ্টা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও হতাশার - এগুলো কখনওই হওয়া উচিত নয়।’ তিনি বলেন, ‘উত্তরপ্রদেশে বহু শতাব্দী ধরে হিন্দু ও মুসলিমরা যেমন শান্তিতে পাশাপাশি থেকেছে, তেমনি এখানে নানা ডিসটার্বিং ফল্টলাইনও আছে।’
বিক্রম সিং বলেন, ‘তবু আমি পুলিশের ওপর ভরসা হারাতে রাজি নই, রাজ্য পুলিশের নতুন ডিজি মুকুল গোয়েল আমার নিজের হাতে-গড়া অফিসার - তার চাপের কাছে মাথা না-নোয়ানোর ক্ষমতা ও সততায় আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার উত্তরপ্রদেশ পুলিশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুলিশ বাহিনী - ডিজি-র নির্দেশ সব সময় ঠিকমতো নিচুতলায় পৌঁছয় না।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটলেও তা সমূলে নির্মূল করতে হবে। আমার ধারণা জিরো টলারেন্সের বার্তাটা নড়বড়ে হয়ে গেছে বলেই এরকম বিভেদের বীজ মাথাচাড়া দিচ্ছে।’
ধর্মীয় বিদ্বেষই কি ভোটে জেতাবে : ড: বিক্রম সিং অবশ্য সেই সঙ্গেই স্বীকার করছেন আজকের ভারতে ট্র্যাজেডি হল - সব নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে একটা হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় মেরুকরণের আবহে। দিল্লিতে সুপরিচিত লেখিকা ও অ্যাক্টিভিস্ট ফারাহ নাকভি-রও বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, উত্তরপ্রদেশে যা ঘটছে সেটাও করা হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনকে মাথায় রেখেই।
ফারাহ নাকভি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে বিজেপি তাদের পুরনো খেলায় ফিরে এসেছে - কারণ ওই রাজ্যে সুশাসন দিতে তারা চরম ব্যর্থ।’ তিনি বলেন, ‘মহামারিতে সেখানে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, যেগুলো অনায়াসে এড়ানো যেত। গ্রাম-শহর ক্ষোভে ফুঁসছে।’ নাকভি বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে বিজেপি যে খেলাটা চিরকাল খেলতে অভ্যস্ত, সেটাই আবার খেলছে - মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।’
প্রীতি / প্রীতি
পর্তুগালে নাগরিকত্ব আইনের কিছু ধারা আটকে দিল আদালত
যুক্তরাষ্ট্রে বিমান দুর্ঘটনা, ক্রীড়া তারকাসহ নিহত ৭
সৌদিআরবে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস-২০২৫ পালন
ট্রাম্পের মন্তব্যের পর পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন এফবিআই উপপ্রধান
মেড ইন সৌদি ২০২৫ এক্সপোতে সৌদি–বাংলাদেশ বাণিজ্যে নতুন অধ্যায়
২০২৫ সালে ৫,০০০০০ সেনা হারিয়েছে ইউক্রেন : রাশিয়া
ফিলিস্তিনি ও ৭ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে প্রতারণা, ৪০ লাখ ডলার আত্মসাতের নেপথ্যে এক ইসরায়েলি
সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেই সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা থাইল্যান্ডের
সৌদি আরবে গান গাইতে এসে হিজাব পরলেন মার্কিন র্যাপার
রাশিয়ার সাবমেরিনে ইউক্রেনের হামলা
বিজয় দিবসে মোদির পোস্ট— একবারও উল্লেখ করলেন না বাংলাদেশের নাম