মানবতা ও উন্নয়নের আজন্ম সাধক ছিলেন জাতীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক
মানুষ, মানবতা ও উন্নয়নের আজন্ম সাধক ছিলেন জাতীয় নেতা জাতীয় বীর আব্দুর রাজ্জাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থেকে তাদের কল্যাণে কাজ করাই ছিলো এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন সভা সমাবেশে অংশ নেয়া আব্দুর রাজ্জাক
ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম নেতা আব্দুর রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২ মে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে ডামুড্যা মুসলিম পাইলট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি নেওয়ার পর এলএলবি ডিগ্রি নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আব্দুর রাজ্জাক
বাবা ইমাম উদ্দিন ও মা আখফাতুননেসার ঘর আলো করা ছেলেটির রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রজীবনেই। পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাবি’তে জনপ্রিয় ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। এর সুবাদে ১৯৬৫-৬৭ সালে ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
বয়সের ঘর ৩০ বছর পেরোনোর আগেই জাতীয় রাজনীতিতে একজন সংগঠক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪’র ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন প্রয়াত এই নেতা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দুইবার। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হন।
১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের ভোট দিয়ে শুরু হয় আব্দুর রাজ্জাকের নির্বাচনি জয়যাত্রা। ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন আব্দুর রাজ্জাক।
মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন আব্দুর রাজ্জাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ক’জন যুবনেতা ‘চার খলিফা’ নামে সুপরিচিত ছিলেন, আব্দুর রাজ্জাক তাদেরই অন্যতম।
জেনারেল ওবানের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর চার প্রধান (বাঁ থেকে) সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক
আওয়ামী লীগের হাল ধরে রাখা ও মন্ত্রিত্ব
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ থেকে তিন বছর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা ঘটনার পর তিন বছর কারাগারে থাকতে হয়েছিলো তাঁকে। তবে দমে যাননি, পরবর্তী সময়ে বিরূপ পরিস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হাল ধরেন এবং সর্বোচ্চ চেষ্টায় দলের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। দেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে কোনো কালো হাত থাবা বসালেই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু নিজের ত্যাগ ও প্রচেষ্টা দিয়ে দলকে সবসময় আগলে রেখেছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে ১৯৮১ সালের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ছেড়েছিলেন তিনি।
সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকতেন আব্দুর রাজ্জাক
নব্বই দশকে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সূচিত আন্দোলনের সংগঠক এবং গণআদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। বাংলাদেশের শান্তি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
নব্বই দশকে আওয়ামী লীগে ফিরলে সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান হয় তাঁর। তারপর দীর্ঘদিন দলটির নীতি-নির্ধারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকারে পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর সময়েই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি হয়।
সবশেষ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শরীয়তপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।
দেশ ও মানুষের কল্যাণ
জীবনের অন্যতম সময় দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত এই নেতা। সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। কোনো লোভ-লালসা কখনও তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে স্থান পায়নি। সৎ জীবনযাপন ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা মাধ্যমে স্বাধীন বাংলার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তালিকায় স্থান করে নেন তিনি।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে দক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন আব্দুর রাজ্জাক। নিজের সংসদীয় আসন শরীয়তপুরের উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের জন্য সদা তৎপর ছিলেন। সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষা বিস্তারে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন আব্দুর রাজ্জাক কলেজ ও বুড়িরহাট পলিটেকনিক কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাবার নামে করেছেন আলহাজ ইমাম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়।
আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে রাস্তাঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি নদীভাঙন কবলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে জয়ন্তী নদীতে শক্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়। জীবনমান উন্নয়নে তিনি গড়ে তুলেছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ড, ব্যাংক ও ড্যামুড্যা পৌরসভা। এছাড়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করেন।
পরিবারের সঙ্গে আব্দুর রাজ্জাক
আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন শরীয়তপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য। একই আসনে তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য তাঁর ছেলে আলহাজ্ব নাহিম রাজ্জাক। বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাবার স্মরণে নিজের এলাকায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন তরুণ এই রাজনীতিবিদ।
শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের নলমুড়িতে ফেরিঘাটের নামকরণ হয়েছে আব্দুর রাজ্জাকের নামে। এছাড়া জাতীয় এই নেতার নামে শরীয়তপুর পৌরসভার কোর্ট চত্বর পুলিশ বক্স থেকে আটং বুড়িরহাট সড়কের নামকরণ হয়েছে,সরকারি আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, আব্দুর রাজ্জাক নার্সিং কলেজ,আব্দুর রাজ্জাক টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ।
সাধারণ মানুষের কাছে আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের কছে এই ব্যক্তিত্ব এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কিডনি ও লিভারের জটিলতা নিয়ে ২০১১ সালের লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
এমএসএম / এমএসএম