বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হল ১৬তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘রুপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অর্ন্তভুক্তিমূলক বিশ্ব গঠন‘। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দিবস যা প্রতিবছর ২রা এপ্রিল পালিত হয়। জাতিসংঘ বিশ্বজুড়ে সদস্য দেশগুলিকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে উৎসাহিত করে। "বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস" প্রস্তাবটি ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয়। এই প্রস্তাবনাটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বিনা ভোটে পাশ এবং গৃহীত হয়। বিশ্ব অটিজম দিবস স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জাতিসংঘের সাতটি দিবসের মধ্যে অন্যতম।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সম্পর্কে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ইনসাফ বারাকাহ কিডনি এন্ড জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা: আফরোজা আক্তার বলেন, অটিজম ও এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিদের জীবনব্যাপী সেবার প্রয়োজন হয়। মাত্রাভেদে অনেকেই অন্যের সাহায্য ছাড়া জীবন অতিবাহিত করতে পারে না বিধায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যথাযথ পুনর্বাসন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা নয় উল্লেখ করে ডা: আফরোজা আক্তার বলেন, উপযুক্ত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি।
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিসহ সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মানসিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ জীবন গঠনের পথকে আরো প্রসারিত করতে সহায়তা করবে। ইতোমধ্যে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (এনডিডি) সুরক্ষা ট্রাস্ট অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তির গৃহভিত্তিক পরিচর্যা ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য কভিড পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ৫৩টি জেলার ১৯০টি উপজেলার ৩৯০ জন মাতা-পিতা/অভিভাবককে অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। একই সঙ্গে ৬০টি জেলার ১০৫টি উপজেলার ১১৫টি বিদ্যালয়ের ৪৫০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ‘বলতে চাই’ ও ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ নামক দুটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবে ‘বলতে চাই’ অমৌখিক যোগাযোগ সহজীকরণ করবে। শিশুর অটিজম আছে সন্দেহ হলে সহজেই ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ অ্যাপ দ্বারা ঘরে বসেই অটিজম আছে কি না তা জানা যাবে। অটিজম সচেতনতা দিবসে প্রত্যাশা, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও থেরাপি সেবা দিয়ে কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রতিটি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু উন্নত স্পিচ থেরাপি সেবা ও প্রশিক্ষণ পেলে মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে।
ইনসাফ বারাকাহ কিডনি এন্ড জেনারেল হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আফরোজা আক্তার বলেন, অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি) বা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা বিচিত্র। একজনের সঙ্গে আরেকজনের হুবহু মিল নেই। কেউ সবাক, কেউ বা বাক্শক্তি থাকা সত্ত্বেও কথা বলে না। কারও আচরণ অতি চঞ্চল, কেউ অতিরিক্ত গুটিয়ে থাকা স্বভাবের। অটিজম বিয়য়ে অনেকের মধ্যেই বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এসব ভ্রান্ত ধারনাগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এএসডি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি সমস্যা। এএসডির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের দুই পাশের গঠন এবং নিউরোট্রান্সমিটার লেভেলে অসংগতি থাকে। শুধু ছেলে শিশুদেরই অটিজম হয় ব্যাপারটা এমন নয়। মেয়ে শিশুদেরও অটিজম হতে পারে। আসলে যেকোনো জাতি, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বয়সভেদে অটিজম হতে পারে বলে জানান তিনি।
ডা: আফরোজা আক্তার বলেন, অটিজম শনাক্ত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মেডিকেল টেস্ট নেই। তবে চিকিৎসকরা শিশুর আচরণ মূল্যায়ন করে তা নির্ণয় করেন। অটিজম শনাক্তে বেশকিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-চোখে চোখ না রাখা, নাম ধরে ডাকলে কোনো প্রতিক্রিয়া না করা, দুলতে থাকা এবং খেলনা দিয়ে অর্থহীনভাবে খেলা করা, বারবার একই কথা বলা, একই কাজ করা ইত্যাদি।
সিডিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, এএসডি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে ২১ শতাংশের বুদ্ধিমত্তা খুব কম, ২৩ শতাংশের স্বাভাবিকের তুলনায় স্বল্প এবং ৪৬ শতাংশের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের ওপরে অবস্থান করে। আগে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, এমএমআরের টিকার কারণে শিশুদের অটিজম হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা এখন একমত যে, এর কোনো বাস্তবতা নেই। অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা এখনো আবিস্কৃত হয়নি। তবে বিহেভিয়ার মডিফিকেশন টেকনিকসহ বিভিন্ন নিবিড় ও অগ্রিম পদক্ষেপ গ্রহনের ফলে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর উন্নতি করা সম্ভব।
অটিজম কোনো স্থায়ী অবস্থা নয়। সময়ের সাথে সাথে এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ শিশুর মধ্যে রোগের কারণ বাড়তে পারে। কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে এপিলেপ্সি দেখা দিতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে এমন শিশুরা বিষন্নতায় ভুগতে পারে। তাদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার এদের মধ্যে অনেকেই নিজের কাজ করতে পারে এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
অনেক সময় বলা হয়, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতীয় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা একা থাকতে পছন্দ করে কিংবা তারা সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে চায় না। আসলে বিষয়টি তা নয়। তারা প্রায়ই সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে চায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগে প্রায়োগিক দক্ষতার অভাবে তারা তা করতে পারে না। কখনো কখনো তারা বন্ধুত্বও তৈরি করতে পারে।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো কোনো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কথা বলতে পারে এবং অন্যের সঙ্গে মিশতেও পারে। তাদের বাচনিক অথবা অবাচনিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তারা মেধাবী, সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং চিন্তার দিক থেকে তারা সক্ষম থাকতে পারে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেকেই জীবনে সফল হতে এবং সমাজে অবদানও রাখতে পারে।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি অনুভূতিহীন। অন্যের প্রতি তারা স্নেহ বা সহানুভূতি দেখাতে পারে না বলে এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। আসলে বাস্তবতা এমনটা নয়। অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্নরা সহানুভূতিপ্রবণ। আবার নিজেও অন্যের কাছে স্নেহ পেতে চায়। তবে প্রক্রিয়াগত কারণে এবং সামাজিক বিষয় বোঝার পার্থক্যের কারনে সাধারণের চেয়ে তাদের প্রকাশভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন হয়। বলা হয়, অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সবারই শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় এমন ধারনা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল। কারন, কিছু কিছু অ্যাসপারজার সিনড্রোম শিশুদের অনেকেই গণিতের মতো বিষয়ে অন্য শিশুদের সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সমস্যা কখনোই পুরোপুরি দূর হয় না। তবে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব। স্বল্প মাত্রায় অটিজম যেমন- এসপারজার সিনড্রোম অথবা হাই-ফাংশনিং অটিজমের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশু পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। উচ্চমাত্রায় অটিজমের ক্ষেত্রে পরিণত বয়সেও স্বনির্ভরভাবে দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্ভব নাও হতে পারে।
অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের এপিলেপসি (খিঁচুনি), অন্ধত্ব, বধিরতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা, ডাউন সিনড্রোম কিংবা অন্য শারীরিক সমস্যাও থাকতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের অবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। এই শিশুরা পৃথিবীকে আপনার-আমার চেয়ে আলাদাভাবে দেখে। এরা খুব ভালো পর্যবেক্ষক। আশপাশের বহু কিছুই তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। ভালো আচরণ, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে তাদেরকে সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব।
ইনসাফ বারাকাহ কিডনি এন্ড জেনারেল হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আফরোজা আক্তার বলেন, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) একটি নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটির কারণে এই সমস্যাটি দেখা দেয়, যা ব্যক্তির সামাজিক, যোগাযোগ ও আচরণগত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। একে সংক্ষেপে অনেকে অটিজম নামেও অভিহিত করে। ASD-তে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠতে অসুবিধা হয়। এর কারণে কথাবার্তা-অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও ভাষাগত দক্ষতা কম থাকে। সাধারণত ১৮ মাস থেকে ৩ বছর সময়ের মধ্যেই এ রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশু মা-বাবা বা আপনজনের ডাকে সাড়া না দিয়ে নীরব থাকে।
ঠিক কী কারণে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর জন্ম হয় বিজ্ঞানীরা তা পুরোপুরি নির্ণয় করতে আজও সক্ষম হয়নি। বিশ্বের সব জায়গায় জাতিগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি নির্বিশেষে ASD-এর প্রকোপ দেখা দেয়। বিভিন্ন প্রকার পরিবেশ দূষণকে ASD-তে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। এর চিকিৎসায় ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই৷ প্রয়োজন যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ৷ তবে প্রতিটি অটিস্টিক শিশুই আলাদা হওয়ায় তাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি একজনের চেয়ে আরেকজনেরটা আলাদা বলে উল্লেখ করেন ডা: আফরোজা আক্তার।
প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অটিজম আন্দোলনের ফলে অনেক অটিস্টিক শিশু মূলধারায় ফিরে আসছে। যার ফলে অসহায় পিতামাতা হতাশা কাটিয়ে পাচ্ছে উৎসাহ, সাহস আর আশ্রয়। বিশ্বে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে অটিস্টিক শিশুদের মধ্য থেকে তৈরি হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের শিশুরাও সে পথে হাঁটছে। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর মাস্টার্স এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজিতে বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম ও স্নায়বিক জটিলতা-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ করছেন। বাংলাদেশের অটিজম-বিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে তাকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স‘ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকস-এর পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন সায়মা ওয়াজেদ। তিনি ২০১৩-এর জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হন। সারা বিশ্বেই অটিস্টিক শিশুদের অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের উদ্যোগে ২০১১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অটিজম-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় ‘South Asian Autism Network (SAAN)’। যার সদর দপ্তর করা হয় বাংলাদেশে। তার চেষ্টাতেই বাংলাদেশে ‘নিউরোডেভলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট ২০১৩’ পাস করা হয়। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায়ও স্থান করে নিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ।
বাংলাদেশে অটিজম-বিষয়ক বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও কাজ করছেন সায়মা ওয়াজেদ। ২০১৬ সালে তিনি প্রতিবন্ধীদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের জন্য ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডেও সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। অটিজম নিয়ে আরও ব্যাপক আকারে কাজ করতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘সূচনা ফাউন্ডেশন‘ নামের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশে একসময় অটিজম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। যেসব শিশু এ রোগে আক্রান্ত তাদেরকে বলা হয় অটিস্টিক। একসময় অটিস্টিক শিশু সমাজ ও পরিবারে ছিল অবহেলিত। এ ধরনের শিশুর পরিবারকেও সামাজিকভাবে অনেক অবজ্ঞা সহ্য করতে হতো। তাদেরকে রাখা হতো সমাজের মূলস্রোতের বাইরে। অটিস্টিক শিশুর সঙ্গে সাধারণ শিশুদের মিশতে দেয়া হতো না। এই শিশুদের উন্নয়নে এগিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। অটিজম বিষয়ে সচেতনতা ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের অবদান অতুলনীয়। কয়েক বছর আগেও যে দেশে অটিজম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিরূপ ধারণা ছিল, তার ঐকান্তিক চেষ্টায় অটিজমের গুরুত্ব ও সচেতনতা জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত।
বাংলাদেশ অটিজম-সংক্রান্ত কার্যক্রম এগিয়েছে অভাবনীয়ভাবে। ১৪টি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স। ৮টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি। এর মধ্যে প্রথম সারির ৫টি হলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের অনুপ্রেরণায় বেসরকারি পর্যায়েও অনেক প্রতিষ্ঠান অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হয়েছে। অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধিতা-বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল কখনও সরাসরি, কখনও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সব জাতীয় কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে দেশে অটিজম-সংক্রান্ত বেশকিছু চিকিৎসা সহায়তাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে যেমন- ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (IPNA) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা; জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা; ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকা; প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট; মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বা মনোরোগবিদ্যা বিভাগ; নিকটস্থ জেলা সদর হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স; সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষায়িত স্কুল; প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন।
IPNA একটি জাতীয় পর্যায়ে পরিচালিত অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান যা শুধু প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও হস্তক্ষেপের আকারে পরিষেবাই প্রদান করছে না বরং ‘অটিস্টিক শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ’ নিশ্চিত করছে যেখানে তারা তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশ করতে শিখতে পারে। এছাড়াও এই ইনস্টিটিউট ডাক্তার, শিক্ষক ও পিতামাতার জন্য অটিজম সম্পর্কিত জ্ঞান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা-দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করছে।
এমএসএম / এমএসএম