গ্যাসের সংকট সমাধানে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে তিতাস
২০২১ সালের জুনে দেশে গ্যাসের বৈধ আবাসিক সংযোগ ছিল ২৮ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৭টি। গত এক বছরে শুধুমাত্র বিল বকেয়া থাকার কারণে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ৫১ হাজার ৭১৭টি বৈধ আবাসিক সংযোগ আর অবৈধ আবাসিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ৩ লাখ ৪৬৯টি। বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ৩১৫টি। এতে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে মনে করেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্।
দেশে বর্তমানে যে জ্বালানি সংকট চলছে তার বড় কারণ গ্যাসের অভাব। মোট চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন ৪০০ মিলিয়ন ঘটফুট গ্যাসের সংকট আছে। সাধারণ মানুষের বাসা-বাড়ি থেকে শিল্প কারখানা, সবখানেই এই সংকট এখন তীব্র। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সমস্যা নতুন করে আঘাত এনেছে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল যেসব দেশ শিল্পকারখানা নির্ভর এবং নতুন নগরায়নের দিকে যাচ্ছে, সেসব দেশ পড়ছে বেশি সমস্যায়। টাকা বা ডলার বেশি গুণতে পারলে বিশ্ববাজারে বিকল্প জ্বালানির জোগান আছে। ডলার সংকট এবং স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তরল গ্যাসের দাম অনেক বেশি, তাই এলএনজি কেনার সামর্থ কমে গেছে বাংলাদেশের। একই সমস্যায় পড়েছে পৃথিবীর ছোট আকারের অর্থনীতির দেশগুলো। যার কারণে দেশে চাহিদা থাকার পরেও সরবরাহ করা যাচ্ছে না প্রাকৃতিক গ্যাস। ফলে দেখা যাচ্ছে অনেক বাসায় বৈধ গ্যাসের সংযোগ থাকার পরেও গ্যাসের চাপ কম।
কারণ পাইপলাইনে গ্যাস নেই। গ্যাসের সংকটে ভুগছেন গৃহিণীরা। শিল্প কারখানায় ভুগছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। গ্যাসের এই সমস্যার সমাধান কি? তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ বলেন, ‘চাইলেই কোনো দেশ রাতারাতি গ্যাস সংযোগ দিতে পারে না। গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যায় না। ১৯৬৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিতাস তার অধিভুক্ত বৃহত্তর ঢাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১৩ লাখ ২৩ হাজার ৮০৯ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করতে পেরেছে। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মোট ক্রেতার সংখ্যা ২৮ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৭ জন। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় যা খুবই কম। বর্তমান বাস্তবতায় ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। নতুন গ্যাস কূপ অনুসন্ধান ও খননের চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা। যতটুকু জানি সারা দেশে প্রায় ৪৬টি নতুন গ্যাস কূপের তালিকা করেছে। এসব কূপ খনন করার পর হয়তো ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। উত্তোলন ও খননেও সময় লাগবে। হয়তো আগামী ২০২৫ সালের দিকে এই পরিমাণ গ্যাস যুক্ত হবে পাইপলাইনে। নতুন গ্যাস যদি উত্তোলন করা যায়, তাহলে বর্তমান গ্যাসের যে সংকট আছে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তবে এখনো বিষয়টি নিশ্চিত নয়।’ তাই গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অপেক্ষায় আছেন শীতকালের। শীতে ঘরে গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমবে। ঘরে বেঁচে যাওয়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে শিল্পকারখানার উৎপাদনে।
গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ আছে ২০১৫ সাল থেকে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক কোনো সংযোগের আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে না। নতুন গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। বিদেশ থেকে আমদানি করা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় জ্বালানি। সরকারের হাতে এখন ব্যয় সংকোচন আর অপচয় বন্ধ করা বাদে অন্য কোনো পথ নেই। বিল বকেয়া এবং অন্যান্য কারণে আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তিতাস গ্যাস চেষ্টা করছে গ্যাসের অপচয় নিয়ন্ত্রণ রাখার। অবৈধ সংযোগ এবং বকেয়া বিলের কারণে গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া চলমান আছে। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কঠোর অবস্থানে আছে তিতাস গ্যাস। এর ধারাবাহিকতায় বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গত এক বছরে ৪ জন কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। বিভাগীয় মামলা চলমান আছে ২০ থেকে ২৫টির মতো।
তিতাসের কর্মী ও কর্মকর্তারাও গ্যাসের অবৈধ সংযোগের সাথে যুক্ত থাকেন, এমন অভিযোগ অনেক সময় পাওয়া যায়।
এই বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘গ্যাসের সকল অবৈধ সংযোগ এর সাথে তিতাসের কর্মকর্তারা জড়িত, এটি সব সময় ঠিক নয়। অনেক সময় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন দালালচক্র অবৈধ সংযোগ দেয়। এমনও দেখা গেছে রাস্তায় ‘গ্যাসের সংযোগ কাছ চলছে, সতর্কবার্তার ব্যানার সাঁটিয়ে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ রকম ঘটনার কারণেও অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তিতাস গ্যাস। বিশ্ব পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক হয়, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম যদি সহনীয় অবস্থায় আসে, তাহলেই গ্যাসের সংকট কমবে।’
আমাদের দেশে আবাসিক সংযোগে বিকল্প আছে এলপি গ্যাস। বর্তমানে শিল্পকারখানায়ও এলপি গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এলপিজি ব্যবহারের জন্য সংযোগ খরচ নেই।
পরিবহন খরচ দিয়েই যেকোনো সময় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস কেনা এবং ব্যবহার করা যায়। উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য কারখানা পর্যায়ে এলপিজির ব্যবহার বাড়াতে হবে। উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য সরকার এসব দিকেও সার্বক্ষণিক নজর রাখছে।
যেহেতু চাইলেই প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়, তাই তিতাস গ্যাস অবৈধ সংযোগ বন্ধের বিষয়ে আরও কঠোর হচ্ছে। যাতে অপচয় রোধ করা যায়। আমাদের দেশের মানুষের অভ্যাস হচ্ছে একটি অবৈধ সংযোগ একবার বিচ্ছিন্ন করার পর কিছুদিনের মধ্যে পুনরায় অবৈধ সংযোগ স্থাপন করা হয়। তা বন্ধ করার জন্য সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে যাদের বাসায় বা কারখানায় গ্যাসের বৈধ সংযোগ আছে, তারা যদি অবৈধ গ্যাস সংযোগের সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে তার অবৈধ সংযোগের সম্পৃক্ততার অভিযোগে বৈধ সংযোগটিও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশী কারো বাসা বা কারখানায় যদি অবৈধ গ্যাসের সংযোগ থাকে, তিনি যদি তা না জানান তাহলে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে এলাকা ভিত্তিক গ্যাস সংযোগ। এই উদ্যোগে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে অল্পদিনের মধ্যে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ আরও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
এমএসএম / এমএসএম