ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তিন গজ কাপড় দিয়ে ব্যবসা শুরু এখন মাসে আয় লাখ টাকার উপরে


ফয়েজ রেজা  photo ফয়েজ রেজা
প্রকাশিত: ১২-১-২০২৩ রাত ১১:৪৩

২০২২ সালে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নেপাল এসএমই ফেয়ারে যখন অংশ নিয়েছিলেন, গর্বে চোখে পানি এসে গিয়েছিল। মেলা শেষে তিনি ফিরে এসেছিলেন অর্জন ও আফসোসের গল্প নিয়ে। সেবার মেলায় অর্জন ছিল তার সব পণ্য বেচা হয়ে গিয়েছিল এক মেলায়। আফসোস ছিল বেশি পণ্য না নিয়ে যাওয়ার কারণে। যদি আরও পণ্য নিয়ে যেতেন, হয়তো বেচা হয়ে যেত সব। 

২০১৭ সালে ব্যবসা শুরু করে ২০২২ সালে এ অর্জন অনেকের কাছে খুব বড় নয়। সাফিনা আক্তার বীণা’র জীবনের এই ছোট গল্পটি বিরাট ও বিশাল অর্জনের। ২০১৭ সালে তিনি যখন ব্যবসাটি শুরু করেছিলেন, তখন না ছিল কোনো অভিজ্ঞতা, না ছিল ব্যবসায় বিনিয়োগের মতো সামান্য পূজি, না ছিল পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ। তারপরও তিনি আজকের দিনে ছোট উদ্যোক্তা বা নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসেবে অনেকটা সফল। এর পেছনে আছে তাঁর ইচ্ছা শক্তি। ‘অনেক উদ্যোক্তা মাঝ পথে ঝরে যায়। ব্যবসায় ধাক্কা সামলাতে পারে না। আমি যতবার পড়ে গিয়েছি, ততবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। হুচট খাওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করেছি। এজন্য পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা সহজ হয়েছে আমার জন্য।’ কথাগুলোর মধ্যে বোঝা যায় সাফিনা আক্তার বীণা’র ইচ্ছা শক্তি কেমন। 

পাঁচ বছর আগে ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র ২ থেকে ৩ গজ কাপড় নিয়ে। এর পেছনের গল্পটি আরও করুণ ও হৃদয় বিদারক। সে বছর তাঁর স্বামীর মৃত্যু ঘটে হঠাৎ করে। তাঁর সংসারে তখন দুই ছেলে আর তিনি সাদামাটা একজন গৃহিণী। ঘরের বাইরে কাজ করতে হবে এ কথা কল্পনাও করেননি স্বামীর মৃত্যুর আগে। স্বামী আবু সাফিন ইমরুল কাশেম মৃত্যুর আগে কাজ করতেন রূপসী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর মহাব্যবস্থাপক হিসেবে। 

হঠাৎ স্বামী হারানোর শোক, হঠাৎ আয় রোজগারহীন সংসার, হঠাৎ অনিশ্চিত ভবিষ্যত তাকে যে যন্ত্রণার মধ্যে ফেলেছিল, সেখান থেকে তিনি উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন ইচ্ছা শক্তির জন্য। অল্প পূজিতে ব্যবসা শুরু করার পথে প্রথম বাঁধা ছিল লোক লজ্জা। তিনি সেই শরমের মাথা খেয়ে মাঠে নেমেছেন। শুরুতে পরিবারের সদস্য, আত্বীয় স্বজনদের কাছেই অনুরোধ করেছেন তাঁর পণ্য কেনার জন্য। কাপড় দিয়ে তিনি টেবিল রানার তৈরি করার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে টেবিল রানার এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফ্লোরম্যাট, শাড়ি, বিছানার চাদর, পর্দা , কুশন কভার ,থ্রি পিস, পাঞ্জাবি, বেবি ড্রেস ইত্যাদি।

মাত্র দুই তিন গজ কাপড় নিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন, আজকের দিনে তাঁর মাসে উপার্জন লাখ টাকার উপরে। কারখানার ভাড়া দিচ্ছেন। দু’জন কর্মচারির মাসের বেতন দিচ্ছেন। বড় ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক ও ছোট ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, তারা পড়ছে মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজে। 

ব্যবসায় সাফিনা আক্তার বীণা স্বপ্ন দেখেন না। কাজ করতে পছন্দ করেন। সারাদিন পড়ে থাকেন কারখানায়। নতুন পণ্য তৈরি করেন। এখন অনেক আগাম ফরমায়েশ পান। সেগুলো তৈরি করেন। কিভাবে এতদূও এগুলেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- কেউ যদি দুই গজ কাপড়ের অর্ডার দেয়, আমি সেটি নিয়ে কাজ করে। কাজ করার পর যদি দেখি দুই গজ কাপড়ের মধ্যে দুই টুকরো কাপড় বেঁচে গিয়েছে, তখন সে কাপড় গ্রাহকের কাছে দিয়ে দিই। অল্প পারিশ্রমিক নিই। এই  দুই নীতি শুরু থেকে মেনে চলছি। এখন পর্যন্ত নীতিতে অটল আছি।’

সাফিনা আক্তার বীণা ব্যবসায় নীতি মেনে চলেন। তবে তিনি অনেকবার ঠকেছেন। সেই ঠকা ছিল তাঁর জন্য অনেক বড় ঠকা। অনলাইনে, ফেইসবুক গ্রুপে অনেক ছোট ব্যবসায়ী বড় স্বপ্ন দেখিয়েছেন। অনেক বেশি পণ্যের অর্ডার দিয়েছেন। তিনি যখন সে পণ্য তৈরি করে ডেলিভারি দিয়েছেন, টাকা পরে দিবেন বলে আর দেননি। উল্টো দিয়েছেন হুমকি। ব্যবসায় মনোযোগ দিবেন নাকি ঠকদের পেছনে ঘুরবেন? দ্বিধা ভুলে তিনি মন দিয়েছেন ব্যবসায়। চেষ্টা করেছেন ঘুরে দাঁড়াতে।  তিনি বলেন- ‘আমাদের মত ছোট উদ্যোক্তাদের শত্রু এক শ্রেণীর উদ্যোগতারাই। এরা অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে বসে আছে। তারা ভাবেন আমরা গ্রুপ এডমিনরা যা বলব, উদ্যোক্তারা সেভাবেই চলবে। আর তাদের কথামত কাজ না করলে ব্যবসার ক্ষতি করবে। সুনাম নষ্ট করবে। তারা গ্রুপের সদস্যদের থেকে পণ্য নিয়ে মূল্য দেয় না। বকেয়া টাকা চাইতে গেলে হুমকি দেয়। বিভিন্ন রকম সমস্যা করে। আমার মনে হচ্ছে এটাই বড় সমস্যা এখন উদ্যোক্তাদের।’ 

সরকারের কাছে চাওয়া কি? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন- ‘আমরা দেশে পণ্য বেচতে পারি। বিদেশে পণ্য রপ্তানীর বিষয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেওয়া দরকার। ব্যাংক ঋণ সুবিধা সহজ করা দরকার। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আমরা যদি ব্যাংক ঋণ সুবিধা ও পণ্য রপ্তানি সুবিধা সহজে পাই, তাহলে আরও অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’ 

এমএসএম / এমএসএম