আজ বিশ্বকবির জন্মদিন

‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো আজ’ ---যুগে যুগে কবিরা সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়েই যেন পথ চলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রঠাকুরও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি কালের কবি নন, কালজয়ী কবি। আজ ২৫শে বৈশাখ কবির ১৬২তম জন্মদিন। বৈশাখের এই দাবদাহে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়। সময়টা ছিল ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ। মেঘের গর্জনে কবি এসেছিলেন আমাদের মাঝে। আমাদেরই সকলের প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি একজন দিকনির্দেশক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সব কিছুতেই যেন মিশে আছেন প্রিয় কবি! তাকে ‘বিশ্বকবি’ উপাধি দিয়েছিলেন ব্রক্ষাবান্ধব উপাধ্যায়। তার পূর্ব পুরুষের আদি বসতি খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে। তিনি ঢাকায় দুইবার আসেন, প্রথমবার ১৮৯৮ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালে। তিনি একই সাথে দুইটি দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা। তার রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানদুটি যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত। এছাড়া শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের কথাও তার গানের অনুবাদ।

শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত ‘শিলাইদহ কুঠিবাড়ি’। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। তার সৃষ্টিকর্ম অবিস্মরণীয়। তিনি যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। চির অমর হয়ে থাকবেন। তার সাহিত্যকর্ম স্রোতস্বিনী বহমান নদীর মতো। পুনরায় বছর ঘুরে ফিরে এসেছে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশত বার্ষিকী। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতার বই বনফুল প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি অসংখ্য কবিতা, গান, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হলো মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী। তাঁর বিখ্যাত নাটক হলো ডাকঘর, বিসর্জন, রক্তকরবী, অচলায়তন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হলো গোরা, নৌকাডুবি, শেষের কবিতা, চোখের বালি। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।

ছোটবেলায় তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় গৃহশিক্ষকের কাছে। পরে কলকাতার একটা নর্মাল স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে। তিনি পড়াশোনার জন্য ১৭ বছর বয়সে বিলাত যান। সেখানে ব্রাইটন পাবলিক স্কুল ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে  কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী, গল্পকার ছিলেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘গীতাঞ্জলী’। এই কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তার ‘অভিলাষ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা। যখন তার বয়স ১৪ বছর তখন প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বনফুল’। তাঁর বিখ্যাত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো - মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী। তাঁর বিখ্যাত নাটক- ডাকঘর, বিসর্জন, রক্তকরবী, অচলায়তন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস- গোরা, নৌকাডুবি, শেষের কবিতা, চোখের বালি। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন যেটির নাম দেন তিনি ‘শান্তিনিকেতন’।  

১৯৩০-এর দশক থেকেই রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। জীবনের শেষ চার বছর তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন। ১৯৪০ সালে তার অসুস্থতা বেড়ে যায়। জীবনের শেষ বেলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা তাকে ব্যথিত করে। এই বর্ষা, এই শ্রাবণের ধারা তার জীবনে আর ফিরে আসবে না। তাই তিনি লিখেছেন- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট! রক্ত কমলকর, রক্ত-অধরপুট, তাপ বিমোচন করুণ কোর তব মৃত্যু-অমৃত করে দান।’ ‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে, গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে’। ‘গীতাঞ্জলি’র শেষ পর্যায়ে ১৫৭তম কবিতায় কবি বলেন, ‘দিবস যদি সাঙ্গ হল/না যদি গাহে পাখি/ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে/এ বার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি’। কবি (১৪ শ্রাবণ) জোড়াসাঁকো মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রানী চন্দকে লিখে নিতে বলেছিলেন ‘তোমার সৃষ্টির পথ/রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে,/হে ছলনাময়ী’। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় কবি লিখেছেন ‘মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর! আজি তার তরে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে/জীবন আমার এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়/মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়’। 

জীবনের শেষ নববর্ষের সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার সাধের শান্তিনিকেতনে। সেদিন তার কলমে রচিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংকট’ নামের অমূল্য লেখাটি। তারও ক’দিন পর ১৯৪১ সালেরই ১৩ মে লিখে রাখলেন, রোগশয্যায় শুয়েই ‘আমারই জন্মদিন মাঝে আমি হারা’। শেষের দিকে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতনের আশ্রম বালক-বালিকাদের ভোরের সঙ্গীত অর্ঘ তিনি গ্রহণ করেন তার উদয়ন গৃহের পূবের জানালার কাছে বসে। উদয়নের প্রবেশদ্বার থেকে ছেলেমেয়েরা গেয়ে ওঠেন কবিরই লেখা। কবি ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ বেলা ১২টা ১০ মিনিটে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন। আমাদের সবার প্রিয় কবি চলে গেলেন অমৃত আলোকে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাদর্শ ও তাঁর সৃষ্টিকর্ম শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে চিরদিন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে। এবার জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘সমাজ সংস্কার ও রবীন্দ্রনাথ।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী  উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এবার রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসরে ।  

 এ ছাড়াও বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহ্জাদপুর, এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে জাতীয় পর্যায়ে। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। বাংলা একাডেমিও  আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।