ঢাকা বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

জান্নাতুল ফেরদৌস

মধুর আমার মায়ের হাসি


তানভীর সানি  photo তানভীর সানি
প্রকাশিত: ৭-১০-২০২৩ রাত ৮:১৬

আম্মা চলে যাওয়ার ৪০ দিন আজ। আসলে আমি মনে করি- মাকে নিয়ে কোন স্মৃতিচারণ হয় না। কারণ,একজন সন্তানের সাথে একজন মা সব সময়ের জন্য জড়িয়ে থাকে। কারণ, মা ছাড়া কোন সন্তানের অস্তিত্বই থাকে না। একজন মায়ের জন্যই একজন সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখতে পারে। আমার মা রাশিদা খানম, বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। চার ভাই বোনের মধ্যে মেজ আমার মা। ছোটবেলা বাবাকে হারিয়ে মায়ের ছায়ায় বড় হয়েছেন আদরে ভালোবাসায়। আমার নানার সরকারি চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় আমার মা বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। আম্মার মুখে আমি প্রায়ই উনার ছোটবেলার স্মৃতিচারণে রাজশাহীর কথা শুনেছি। আমার মা শিক্ষা-দীক্ষা মন-মানসিকতায় একজন আধুনিক অথচ ধর্ম পরায়ণ, পর্দানশীল মানুষ ছিলেন। আমার মা এমন শিক্ষাই শিক্ষিত হয়েছিলেন যে, একটি ছোট ফ্যামিলি থেকে বিয়ে হয়ে আমার বাবার যৌথ এবং বড় পরিবারে সুন্দর করে সবার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন। আমি বুঝতে শেখার পর থেকে মৃত্যুর ক্ষণ পর্যন্ত উনার মুখে আমি কোনদিন আমার দাদার বাড়ির কোন বদনাম বা কোন নেতিবাচক কথা শুনিনি। আম্মা একজন ধৈর্যশীল এবং অল্পতেই সন্তুষ্ট হওয়া মানুষ ছিলেন। কখনোই আমি উনার মুখে কোন অভিযোগের কথা শুনিনি। আমার মা ছিলেন একজন সেবা পরায়ণ, পরোপকারী মানুষ। আমি উনাকে দেখেছি বছরের পর বছর উনার শাশুড়ি (আমার দাদু) কে হাসিমুখে সেবা করে যেতে। আরও দেখেছি ওনার বড় ভাইয়ের মত ভাসুর (বাবা মানে আমাদের বড় চাচা) আর  বড় জা ( মানে আমাদের বড় চাচি), আমার মেজ ফুপু, ওনাদের অসুস্থতায়ও উনি ২৪ ঘন্টা ছিলেন উনাদের পাশে। সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন উনাদের ভালো রাখতে। আমরা তিন বোন। আমাদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি আম্মার কাছেই। ছোটবেলার যে স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়ায়, সেটি হচ্ছে আম্মা রান্না করতেন আর আমরা তিন বোন আমার পাশে জলচকি নিয়ে বসে পড়তাম। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা মানবিক গুণাবলীসহ আমাদের আজকের অবস্থানের পেছনে আমাদের মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। আমি লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটি 'চাকরি' করতাম। আমার সন্তানের জন্য যখন বাধ্য হয়ে আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন আম্মার মনে ছিল খুব আফসোস! উচ্চ শিক্ষিত ও বিভিন্ন রকম গুণাবলী থাকার পরও কিছু করছি না কেন? আম্মার উৎসাহ উদ্দীপনায় আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু। আম্মা সব সময়ই চাইতেন আমরা তিন বোন নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে প্রমাণ করি আমরা সব পারি। এ চাওয়াতেই ছিল আম্মার যত আনন্দ। আম্মার কাছ থেকেই প্রথম শিখেছিলাম সংসার কিভাবে আগলে রাখতে হয়। চলার পথে বিভিন্ন রকম পারিবারিক সমস্যা কমবেশি সবারই হয়। সেসব ক্ষেত্রে আম্মা কখনো প্রশ্রয় দেননি। আম্মা তাঁর দূরদর্শী চিন্তা দিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে সমাধান করে দিয়েছেন। আমরা যখন কোন কাজ করে সফল হতাম, তখন আম্মা খুবই খুশি হতেন। আম্মার অগাধ  আস্থা ও বিশ্বাস ছিল আমাদের উপর। আম্মার বিশ্বাস ছিল  আমরা এমন কিছু করতেই পারি না যাতে করে সবার সম্মানহানি হতে পারে। আম্মাকে একজন রত্নগর্ভা মা বললেও ভুল হবে না। আমরা তিন বোন। আমার আম্মার তিন সন্তান তিনজনকেই তিনি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে, সুপাত্রস্থ করেছেন। বাবা-মায়ের দোয়া নিয়েই আমরা তিন বোন সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছি। এ বছর নভেম্বর ২০২৩ এ ঐতিহ্যবাহী রান্না ১০০ রেসিপি গ্রুপ থেকে আম্মাকে রত্ন গর্বা মা হিসেবে সম্মাননা দিতে চেয়েছিলেন। আফসোস আমার আম্মা সেটা দেখে যেতে পারলেন না, তবে শুনে গেলেন। আসলে মাকে নিয়ে লেখার কিছু নেই। সব কিছুর উর্ধ্বে মায়ের অবস্থান। এক জীবন ধরে লেখে গেলেও লেখা  শেষ হবে না। আম্মা ছিল মোমবাতির মতো। নিজের কথা চিন্তা না করেই অন্যকে আলু বিলিয়ে আলোকিত করা একজন মানুষ। আম্মা একজন খুবই ধীরস্থির ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ ছিলেন। আম্মাকে কখনো উঁচু গলায় কথা বলতে শুনি নাই। আমার আম্মা এতই চুপচাপ থাকতেন। আমার দাদু আম্মাকে অনেক সময়ই আদর করে ঠাণ্ডা মা বলে ডাকতেন। আমার জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার মায়ের দোয়া আমার সাথে ছিল। এই জন্যেই বোধহয় অনেক সময় আল্লাহ আমাকে অনেক বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসার জায়গা ছিল আম্মা। যখনি কোন কাজ শুরু করব, তখনই আম্মাকে ফোন দিয়ে বলতাম। কেন জানি আমার মনে হতো আম্মা দোয়া করলে সে কাজে আমি আল্লাহ চাইলে সফল হবোই। কিন্তু এখন আম্মাও নেই আর আমাদের দোয়া করার মানুষও নেই। কিন্তু সবই নিয়তি। আম্মা এখনই কি চলে যাওয়ার সময় ছিল? আরও কত কিছু দেখার ছিল আপনার। বাকি রয়ে গেল আপনার নাতি নাতনিদের সফলতাগুলো দেখা । অবশ্য আপনার দোয়া সবসময়য়ের জন্যই ওদের সাথে আছে। ওরা অনেক কষ্ট পায় আপনার কথা মনে করে। আমাদের বিশ্বাস না ফেরার দেশে আপনি ভালো থাকবেন আম্মা। আপনার মত নেককার, পরহেজগসর, দ্বীনি মানুষ আমার এ জীবনে কমই দেখেছি। আপনার সন্তান হিসেবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনার মুখের হাসি আমার কাছে এখনও মধুর।

জান্নাতুল ফেরদৌস, লেখক ও পিঠাশিল্পী

Sunny / Sunny