ক্যাম্পাসে ফিরলেন হৃদয় তরুয়া!

আমি হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। পিতা রতন তরুয়া। মাতা অর্চনা রানী। আমার বাবা একজন নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ। তিনিই আমাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। আমার বাবা পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। অন্যের দোকানে দৈনিক বেতনে কাজ করেন। সেখান থেকে যা পান, তা দিয়েই আমাদের পরিবারের ভরণপোষণ চলে।
আমার বাবার মাসিক আয় গড়ে ১২ হাজার টাকার মতো। এই টাকায় পটুয়াখালীর মতো একটা জেলা শহরে ভাড়া থাকা, খাওয়াদাওয়া, আমার লেখাপড়ার খরচ ইত্যাদি চলে। আমি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়ি। অনেকের কাছে এটা সামান্য কিছু হলেও আমার কাছে, আমার পরিবারের কাছে অনেক।
বিদ্যালয়ে বা কলেজে পড়াকালীন সময়ে আমার পড়ালেখার খরচ বাবা মোটামুটি কষ্ট হলেও চালিয়ে নিতে পারতেন, কারণ তখন বাসায় থেকে পড়াশোনা করতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর থেকে আমার থাকা, খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তাই আমার এই খরচের টাকার জোগাতে আমার বাবার বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে। তা ছাড়া আমার বাবার বয়সও বেড়েছে। যার কারণে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তার ওপর বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে আমার বাবার পক্ষে পরিবারের সকল ভরণপোষণ, পাশাপাশি আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার বাবার পৈতৃক সম্পত্তিও নেই বা কোনো স্থায়ী সম্পদ বাড়ি, কৃষিজমি বা কোনো অর্থও জমা নেই, যা দিয়ে এই প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আমি নিজ থেকে কিছু আয়ের চেষ্টা চালাচ্ছি, যেমন টিউশনি। কিন্তু চট্টগ্রাম আমার জন্য নতুন শহর। এখানকার কোনো মানুষও আমার পরিচিত না। যার কারণে টিউশনি পাওয়াটা আমার পক্ষে দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম থেকে ২৩-২৫ কিলোমিটার দূরে। শাটল ট্রেনে শহরে যেতে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট লাগে। শহর অনেক দূরে হওয়ায় টিউশনি খোঁজাটাও সময় ও কষ্টসাধ্য। তার ওপরে চট্টগ্রামে টিউশনি নিয়েও ব্যবসা চলে। কারও বা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে টিউশনি পেতে হলে একটা বড় পরিমাণের টাকা তাদের দিতে হয়। যেটা আমার মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের স্টুডেন্টের জন্য একটু বেশিই কষ্টের। তাই এমন অবস্থায় আমি যদি কোনো প্রকার বৃত্তি পেতে পারি, সেটা আমার পরিবার ও আমার লেখাপড়ার জন্য সুবিধার হবে। এভাবেই নিজের সম্পর্কে ডায়েরিতে লিখেছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া।
বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে তরুণদের হাত ধরে ফিরে আসছে আন্দোলনে প্রাণ হারানো শহীদদের স্মৃতি। দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি, আলপনা, প্রতিবাদী গান আর কবিতার লাইনে জীবন উৎসর্গ করা বীর শহীদদের আত্মত্যাগকে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেওয়া এই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইতিহাস বিভাগের দুই শিক্ষার্থী ফরহাদ এবং হৃদয় তরুয়া।
বন্ধুদের স্মৃতিচারণ ও গ্রাফিতিতে নিজের প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে তরুয়ার স্মৃতি। তরুয়ার আবাসিক হলের সামনের দেয়ালে স্থান পেয়েছে তার গ্রাফিতি। বন্ধুদের ভাষায় বিপ্লব আর তারুণ্যের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন শহীদ তরুয়া।
কিভাবে শহীদ হলেন তরুয়া :
১৮ জুলাই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন চবির ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয়। চার দিন আইসিইউতে থাকার পর গত ২৩ জুলাই (মঙ্গলবার) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গুলিতে হৃদয়ের ফুসফুস ফুটো হয়ে গিয়েছিল।
হৃদয়ের বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। তাঁর বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া, মা অর্চনা রানী। হৃদয়ের বড় বোন মিতু রানীর বিয়ে হয়েছে। মির্জাগঞ্জে হলেও পটুয়াখালীর সদরে নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া থাকে হৃদয়ের পরিবার।
তরুয়ার বাবা কাঠমিস্ত্রি। মা হার্টের রোগী হয়েও বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। নিজেদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকায় এ দম্পতি মানুষ করতে চেয়েছিলেন একমাত্র ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়াকে। ছেলেও চেয়েছিলেন একদিন মা-বাবার সব কষ্ট দূর করবেন। তাঁদের মুখে হাসি ফোটাবেন। ফোন করলেই তাঁদের সেই স্বপ্নের কথা বলতেন; কিন্তু একটি বুলেট সব শেষ করে দিল।
শিক্ষকের চোখে শহীদ তরুয়া
এক বুদ্ধিদীপ্ত টগবগে তরুণ তরুয়া : অধ্যাপক ড. সালমা বিনতে শফিক
প্রথম দিনেই চোখে পড়ে আলাদা করে, যদিও কৃষ্ণকালো গাত্রবর্ণ, মাথাভরা কালো চুল, মাঝারী উচ্চতার ছেলেটিকে প্রচলিত অর্থে সুদর্শন বলা যায় না। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা ছড়ায়। তরুয়া নামের অর্থ জানতে চাই উপস্থিতির খাতায় নাম ডাকার সময়। পূর্বপুরুষ কাঠমিস্ত্রি, তরুয়া তাদের বংশীয় পদবী। কি অকপট স্বীকারোক্তি ! দারিদ্র কিংবা গ্রাম্যতা লুকোবার কোনো চেষ্টা নেই ওর মধ্যে। ওকে যে ভালোবেসে ফেলি তা নয়, শ্রদ্ধাও করতে শুরু করি। প্রথম দিন হতেই নিয়মিত ছাত্র, মনযোগী শিক্ষার্থী। উপস্থিতির নম্বরের জন্যই শুধুমাত্র সশরীরে শ্রেণিকক্ষে আসে না সে। অদম্য তার জানার আগ্রহ। প্রশ্ন করতে ভালোবাসে; প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক প্রশ্ন। অনুসন্ধিৎসু এই যুবকের প্রতিটি প্রশ্নই আমাকে ভাবায়। ফরাসী বিপ্লবের বহুমাত্রিকতা, বারে বারে মুখ থুবড়ে পড়া, বিপ্লবের বরপুত্র নেপোলিয়নের হাতে বিপ্লবের কবর রচনা ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সবকিছু নিয়েই তার প্রশ্ন, নিদেনপক্ষে বিচক্ষণ অভিমত। ফরাসি বিপ্লব তো শত শত বছরের সামন্ততান্ত্রিকতা, রাজতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থসামাজিক বৈষম্য, বিচারহীনতাসহ অনেক অব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিল, তবু কেন চার দশকের মাথায় জুলাই বিপ্লব হলো? এরপর দুই দশক যেতে না যেতেই আবার কেন ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এলো? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে। তবে উচ্চারণ করে কয়েকজনই, যাদের মধ্যে তরুয়া একজন।
সিনিয়রের চোখে তরুয়া
হয়তো শত শিক্ষার্থীর ঢাল হয়েছিল ওই বুকটা : আকিজ মাহমুদ
মৃত্যুর আগেও স্বপ্নবাজ এই ছেলেটা সাহসীকতার স্বাক্ষর রেখেছে। রেখে গেছে পরের তরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার উজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন। জানি নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে রইবে তার অবয়ব। অথচ এই ছেলেটা পারলে মৃত্যুকেও জয় করতো। আমরাও তাকে উপাধি দিতাম মৃত্যুঞ্জয়ী। তা সম্ভব নয়। মৃত্যুর অমোঘ সত্যটুকু সে যে অস্বীকার করতে পারেনি। ওটুকু ওর হাতে ছিল না। তবু মৃত্যুর সাথে ছেলেটা প্রায় এক সপ্তাহ কি লড়াইটাই না করে গেল। এ লড়াইটা যে তরুর একার ছিল না। পটুয়াখালীর মেধাবী ছেলেটা দরিদ্র এক পরিবারের ভাঙা ঘরের প্রদীপ। পেশায় কাঠমিস্ত্রী বাবা রতন তরুয়ার রত্ন হয়ে উঠেছিল সে। স্কুল কলেজে মেধার স্বাক্ষর রেখে হয়ে উঠছিল মা অর্চনা রাণীর সব দু:খকে হাসিমুখে মেনে নেওয়ার অবলম্বন। অথচ সকালের পাখিটাও খবর দেয়নি আসছে দিন শোকের আধার নেমে আসবে অর্চনা রাণীর আঙিনায়। অর্চনাদের ভাবনায় ছেলের মৃত্যু যে অতি অসম্ভব কিছু। কিন্তু হায় খোদা হাজার হাজার নির্ভীক তরুণের বুকের মধ্যে হৃদয় তরুয়ার বুকটাকেই কেন বেছে নিলে! হায় নির্দয়! শক্ত কঠিন ছোট ওই বুলেট কেন হৃদয়টাকেই ঝাঁঝরা করে দিল। হয়তো শত শিক্ষার্থীর ঢাল হয়েছিল ওই বুকটা।
বন্ধুর স্মৃতিতে তরুয়া
আমার বন্ধুটা অনেক সংগ্রাম করে এত দূর এসেছিল : হারুন-অর-রশিদ
আমরা বন্ধুরা ওকে অসামাজিক ডাকতাম। আর ও খুব সহজেই সেটা মেনে নিত। আমাকে বলত, ‘সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ইচ্ছা করে না।’ মাঝেমধ্যে আমাকে খুব জ্বালাতন করত, খ্যাপাত। আমি রেগেও যেতাম। কিন্তু ও হাসত। বলত, রাগ করলেও আমি তোকে খ্যাপাব। আমি রাগ করে থাকতে পারতাম না। দু-একটা গালি দিয়ে ঠিকই হেসে ফেলতাম।
আমার বন্ধুটা অনেক সংগ্রাম করে এত দূর এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ চালাত। মাঝেমধ্যে ওকে খুব বকতাম। কারণ, শুক্রবারগুলোতেও সকাল ৯টার শাটলে ও টিউশনিতে যেত, ফিরত বিকেলে। তরুয়া অনেক হিসাব করে চলত। কারণ, ও জানত, বাড়ি থেকে টাকা আনার পরিস্থিতি তার নেই। এমনও দেখেছি, যেদিন বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে, সে রাতে কলা–রুটি খেয়ে থেকেছে। বাসায় যেতে চাইত না, সে জন্যও বকতাম। তরুয়া বলত, ‘বাসায় গিয়ে কী করব বল? তার থেকে এখানেই থাকি। টিউশনি তো মিস করা যাবে না।’
সারা দিন টিউশনি করে এসেও তরুয়া রাতভর পড়ত। পড়ালেখা শেষ করতে হবে, পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে, কত ভাবনা ছিল। সংগ্রাম যার সঙ্গী ছিল, আমার সেই বন্ধুটাই কিনা হার মানল বুলেটের কাছে!
T.A.S / T.A.S

জবি ঊষার সভাপতি নাইম, সম্পাদক লিশা

মৎস বীজ কেন্দ্র অধিগ্রহণ দাবিকে আমি মুগ্ধর দাবি হিসেবে গ্রহণ করছিঃ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

পরীক্ষার ফি কমানোর দাবিতে বার কাউন্সিলে স্মারকলিপি প্রদান

ধর্ষণের সর্বোচ্চ বিচার দাবিতে মধ্যরাতে মহাসড়ক অবরোধ জাবি শিক্ষার্থীদের

তিতুমীর কলেজস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের নতুন কমিটি ঘোষণা

নিষিদ্ধ 'হিযবুত তাহেরীর' সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কুবির দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা

শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদে জবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

থিসিস লেখায় দক্ষতা বাড়াতে খুবির রিসার্চ সোসাইটির প্রশিক্ষণ

খুবির শহীদ মীর মুগ্ধ তোরণের উদ্ধোধন আগামী রবিবার

নিজ বিভাগ থেকে সভাপতি নিয়োগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান, প্রশাসনের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রতাহার

বার কাউন্সিলের ফি কমানোর দাবিতে জবিতে মানববন্ধন

সাবেক ছাত্রদল ও সাংবাদিক নেতা সুজার শেল্টারে হত্যা মামলার আসামীর ক্যাম্পাসে প্রবেশ
