দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করেই চলে জীবন

দেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনঘেঁষা উপজেলা শরণখোলা। এই উপজেলার বেশিরভাগ মানুঘ-ই মৎস্যজীবী ও বনজীবী। নদী, সগর ও সুন্দরবনের চর, খালে মাছ ধরেই চলে এখানকার মানুষের জীবিকা। পর্যাপ্ত কৃষিজমি থাকলেও তা লবণাক্ততার কারণে চাষাযোগ্য নয়। কিছু জমিতে চাষাবাদ হলেও অতিবৃষ্টি, খরা, লবণাক্ততা ও সময়-অসময়ের দুর্যোগে ফলন নষ্ট হয়ে যায়। তাই প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করেই চলতে হয় এ অঞ্চলের মানুষদের। 

উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের দুর্যোগপ্রবণ এলাকা শরণখোলার দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর। পূর্বে বলেশ্বর নদী এবং পশ্চিম দিকটিও ঘিরে রেখেছে সুন্দরবন। ৪টি ইউনিয়ন হলেও ভৌগোলিক দিক থেকে সাগর, নদী ও সুন্দরবন মিলিয়ে বেশ বড় এ উপজেলা। যুগ যুগ ধরে বনজীবী ও মৎস্যজীবী এলাকা হিসেবেই পরিচিত শরণখোলা। তাছাড়া এ এলাকার সুন্দরবন ও মৎস্য খাত থেকে সরকার প্রতি বছর বড় একটি রাজস্ব পেয়ে থাকে। কিন্তু অতিবৃষ্টি, খরা ও সময়-অসময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সারাবছরই যুদ্ধ করে জীবন কাটাতে হয় এ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের।

বছরের ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ- গ্রীষ্মকালীন এই সময়ে বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য হাহাকার লাগে এখানে। তাছাড়া সারাবছরই কম-বেশি ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবেলা করতে হয় উপকূলবাসীদের। ফলে যেমন ক্ষতি হচ্ছে ফসলের, তেমনই ভেঙে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও গাছপালা। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এলাকায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, ওই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা এ অভাবী জনপদের মানুষগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও সংস্থা দুর্যোগ নিয়ে কাজ করলেও তার সুবিধা খুব কম পরিবারই পায়। তাছাড়া ইউনিয়ন পরিষদে যে বাজেট আসে, তা খুবই সামান্য। এই সামান্য বাজেট দিয়ে এখানকার মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব নয় বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীরা। 

উপজেলা সদর রায়েন্দা রাজৈর এলাকার জেলে আমিনুর হাওলাদারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ট্রলার নিয়ে সাগরে গেলেই দুর্যোগের কবলে পড়তে হয়। এ সময় সাগরে জাল ফেলা যায় না, তাই মাছও পাওয়া যায় না। শেষে বড় অংকের দেনা হয়ে জাল ও ট্রলার বিক্রি করতে হয়।

রায়েন্দা ফেরিঘাটসংলগ্ন বাঁধের উপরে ব্যবসা করেন রায়হান হাওলাদারসহ অনেকে। তাদের সাথে কথা বললে তারা জানান, কদিন পরপর বৈরী আবহাওয়া আর দুর্যোগ। এতে তাদের দোকানে কোনো কেনাবেচা হয় না। তাই সংসারও চলে না।

ধানসাগর এলাকার কৃষক ময়নুল ইসলাম, কদমতলা এলাকার কালাম খানসহ অনেকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জমির ফসল যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি গাছের নারিকেল, সুপারি ও কলার ফলনও কমে গেছে। যা ফলন হয় তাও খুব ছোট।

শরণখোলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসক্লাবের বর্তমান আহ্বায়ক শেখ মোহাম্মাদ আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে, তার মধ্যে নদীভাঙন অন্যতম। আর এ নদীভাঙনের কারণে অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে। এছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় ভাঙনের তীব্রতা আরো বেড়েছে। তাই প্রথমেই নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে টেকসই ভবন তৈরি করে সেখানে মানুষের বসতি ঘড়ে তুলতে পারলে দুর্যোগে অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবে এ এলাকার মানুষ।

সুন্দরবনসংলগ্ন সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরান হোসেন রাজিব বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারাদেশই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরঘেঁষা শরণখোলা উপজেলা হওয়ায় এখানে ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। তাই সরকার ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা যে সাহায্য করছে, তা অপ্রতুল। ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় এখানকার বাজেট বাড়াতে হবে। 

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে হেলভেটাস বাংলাদেশের সহায়তায় শরণখোলা উপজেলায় জলবায়ু ও জেন্ডারভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনাসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসার্চ স্টাডিজ (সিএনআরএস) ইভলভ, প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর (প্রকল্প সমন্বয়কারী) মিলন চৌধুরী বলেন, তারা এ উপজেলায় জেন্ডার উন্নয়ন ও জলবায়ু মোকাবেলায় স্থানীয়ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগণের কণ্ঠস্বর বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে ওয়ার্ড পর্যায় থেকে উপজেলা পর্যন্ত সিবিও ও সিএসও নেটওয়ার্কের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে স্থানীয় পরিকল্পনা থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেট প্রণয়নে তারা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু মোকাবেলায় ভূমিকা রাখছেন।