শিশু আমেনাকে নির্যাতনকারী শ্যামলী-বাদল দম্পতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে যশোরে মানববন্ধন
১১ বছরের শিশু আমেনাকে নির্দয়ভাবে নির্যাতনকারী শ্যামলী-বাদল দম্পতিকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। যমোর প্রেসক্লাবের সামনে শনিবার (২৯ মে) সকালে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় উপস্থিত বক্তারা বলেন, আজ শিশু আমেনার সাথে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত ঘৃণিত ও বর্বরোচিত। বক্তারা অনতিবিলম্বে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
উল্লেখ্য, মায়ের বান্ধবীর বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে এক বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হয় ঙঙ বছরের আমেনা খাতুন। সারা শরীরে গরম খুন্তির ছ্যাঁকার দাগ। ক্ষত শুকিয়ে কালশিটে পড়ে গেছে। বুকের উপরে উঠে পাড়িয়েছে। প্লাস দিয়ে মাথা ফুটো করে দিয়েছে, চুল টেনে ছিঁড়েছে। আমেনা এখন যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণনা শুনে গা শিউরে উঠছে।
যশোর সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের নূর ইসলাম ও আকলিমা খাতুনের মেয়ে আমেনা। আমেনার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। নানা মারা গেছেন জন্মের আগেই। আমেনার যখন ৭ বছর বয়স, তখন নানি জোহরা খাতুন আকলিমাকে আবার বিয়ে দেন। ভিক্ষা করে নানি জোহরা খাতুনই লালন-পালন করতেন আমেনাকে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমেনা জানায়, শ্যামলী আন্টি তাকে ঢাকার মহাখালীতে সাততলা সরকারি কোয়ার্টারে নিয়ে যান। সেখানে শ্যামলী আন্টি, তার স্বামী বাদল সিকদার ও আন্টির শাশুড়ি লিলি থাকেন। আন্টির শাশুড়ি সরকারি হাসপাতালের নার্স। ওই বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর দুই মাস সে ভালো ছিল। এরপর থেকেই শুরু হয় নির্যাতন। বাড়ির কাজের একটু এদিক-ওদিক হলেই তাকে বেধড়ক মারপিট করতেন শ্যামলী ও বাদল।
আমেনা বলে, তাকে দিয়ে বাসাবাড়ির সকল কাজ করানো হতো। এর আগে আমেনা কোথাও কাজ করেনি বা শেখেনি। শুরু হলো রুটি বানানো দিয়ে। রুটির পরিমাণ কম বলে আমেনাকে মারপিট করা হতো। হাত থেকে পিরিচ পড়ে গেল কেন; আবার মার। সারা গায়ে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, হাত ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাত মচকে দিয়েছে, প্ল্যাস দিয়ে মাথার চুল টেনে টেনে উঠিয়ে দিয়েছে, গলায় এবং মাথায় আঘাত করেছে। দুই পায়ে পিটিয়ে ভেঙেছে রুটি বানানো বেলন। শ্যামলীর স্বামী আমেনার পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে যন্ত্রণা দিয়েছে; শ্যামলী বুকের উপর দাঁড়িয়ে লাফালাফি করেছে। আমেনার মুখে টেপ লাগিয়ে হত্যাচেষ্টাও করেছে।
অত্যাচার-নির্যাতনের এসব কিছুই জানতে পারেনি আমেনার মা ও নানি। আকলিমা খাতুন জানান, ফোন করলেই বলতো আমেনা ভালো আছে। ফোনে লাউড দিয়ে কথা বলাত। তারা কিছুই জানতে পারেনি।
আমেনা খাতুনের মা আকলিমা জানান, গত বছর করোনার আগে তার ছোটবেলার বান্ধবী শ্যামলী বৈরাগী তাকে অনুরোধ করে আমেনাকে তার সাথে দেয়ার জন্য। শ্যামলীর দুটি বাচ্চা। ঢাকার বাসায় থেকে আমেনা তাদের দেখাশোনা করবে। আমেনার থাকা-খাওয়া ও মানুষ করার দায়িত্ব তার। সরল বিশ্বাসে বান্ধবীর হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছিলাম বলে জানান আকলিমা।
আমেনার নানি জোহরা খাতুন জানান, এক মাস আগে তিনি আমেনা কে দেখতে ঢাকায় যান। কিন্তু বাদল তাকে বাড়ি নেয়নি। তার কাকা তাকে মিরপুরের বাসায় নিয়ে গেছে। তাকে বলেছে, শ্যামলী-বাদল বরিশালে বেড়াতে গেছে। আমেনাকেও সাথে নিয়ে গেছে। যশোরে ফিরে জোহরা খাতুন ফোন করে আমেনার জন্য কান্নাকাটি করেন। একপর্যায়ে এক সপ্তাহ আগে আমেনাকে নিয়ে আসার জন্য তার মা আকলিমাকে ফোন করে শ্যামলী। এরপর গত ২৩ মে তার নানি ঢাকায় গিয়ে আমেনাকে নিয়ে আসেন। এরপর ২৫ মে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে আমেনার মা আকলিমা বলেন, মেয়েটাকে শ্যামলীর কাছে দিয়েছিলাম ভালো থাকবে বলে। কিন্তু তার এ অবস্থা করবে ভাবতেই পারিনি। আমি আমার মেয়ে নির্যাতনের বিচার চাই। এ ব্যাপারে বক্তব্য নেয়ার জন্য বাদল সিকদার (০১৭৩০-১৫০৩৬৭) ও শ্যামলী বৈরাগীর (০১৭৬৩-৬৬০৫২৮) নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা রিসিভ করেননি।
হাসপাতালে আমেনাকে চিকিৎসা দেয়া যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অজয় কুমার সরকার জানান, তার শরীরে অসংখ্যা পোড়া বা ছ্যাঁকার দাগ ও নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। অনেক ক্ষত শুকিয়ে গেছে। অনেক দিন ধরেই এ ক্ষতগুলো হয়েছে। তাকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
যশোরে ফেরার পর আমেনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তিতে সহযোগিতা করা রক্তদাতা ও সামাজিক সেবামূলক সংগঠন ‘স্বজন সংঘের’ সাধারণ সম্পাদক সাধন কুমার দাস জানান, জোহরা খাতুন প্রথমে আমেনাকে নিয়ে গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। এমন নির্যাতনের খবর পেয়ে তিনি ও তার সংগঠনের যুগ্ম-সম্পাদক সঞ্জয় কুমার নন্দী তাদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। মামলা করার জন্য যশোর কোতোয়ালি থানায়ও যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু থানা থেকে ঢাকার সংশ্লিষ্ট থানায় মামলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সাধন কুমার দাস বলেন, আমেনার মা ও নানি অসহায় দরিদ্র মানুষ। তাদের পক্ষে ঢাকায় গিয়ে মামলা করা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি মামলা দায়ের ও নির্যাতনকারীদের শাস্তির জন্য প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।
এমএসএম / জামান