পিএসসির সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও স্থায়ী হননি বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকরা
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রশাসনিক উন্নয়ন ও সমন্বয়-১ অধিশাখা এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সুপারিশ সত্ত্বেও ক্যাডার পদে স্থায়ী করা হয়নি বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের। হয়নি গেজেট প্রকাশ। ফলে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকরা। তাই বৈষম্যবিরোধী স্লোগান নিয়ে বৈষম্যের শিকার তারা। দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার এসব ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসক আলো দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু প্রশাসনে এখনো ষড়যন্ত্রকারী এক শ্রেণির কর্মকর্তার ব্যাপক তৎপরতা চলছে।
তাদের উদ্দেশ্য বৈষম্যবিরোধী এই সরকারকে বিতর্কিত করা। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে মৃতপ্রায় তৃণমূল স্বাস্থ্যসেবাকে পুনরোজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১০ সালে ৩৫৫১ এবং ২০১১ সালে ৫৮২-সহ মোট ৪১৩৩ জন চিকিৎসককে নিয়োগ দেয়া হয়। লক্ষ্য ছিল ওই সময়ে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলিয়ে ৪১৩৩টি শূন্যপদ পূরণ করা। কারণ চিকিৎসকদের এই বিপুল পরিমাণ শূন্যপদ সাধারণ বিসিএসের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে পূরণ করা সম্ভব না। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) একজন সদস্যসহ ৭ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চপর্যায়ের একটি নিয়োগ কমিটি প্রণয়ন করা হয়।
উক্ত কমিটি তৎকালীন আইন সংশোধন করে প্রথম শ্রেণির (নন-ক্যাডার মেডিকেল) কর্মকর্তা নিয়োগ বিধিমালা-২০১০ প্রণয়ন করে এবং একটি উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার চিকিৎসক আবেদন করেন। পরবর্তীতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যম ৪১৩৩ জন চিকিৎসককে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হয়। অথচ যোগদানের পর থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসা সেবা দিয়ে এলও এসব চিকিৎসকের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। দেশ ও জনগণের সেবায় নিয়োজিত হওয়া সেই সকল চিকিৎসক আজ নিগৃহীত এবং বঞ্চিত, তারা চরম বৈষম্যের শিকার। যেন দেখেও কেউ দেখার নেই।
বছরের পর বছর একই পদে কর্মরত থাকায় তারা সামাজিক,পারিবারিক এবং আর্থিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। এর প্রতিকারের জন্য প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তারা আজ ক্লান্ত। চাকরির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বিসিএস এর মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকেরা পদোন্নতি পেয়ে তাদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । এই হতাশায় প্রচুর চিকিৎসক চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে ১৯৮৯ জন চিকিৎসক একরাশ হতাশা নিয়ে জনগণের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, এইসব বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার ভুক্ত চিকিৎসকদের মধ্যে প্রায় ৬০০ চিকিৎসক এফসিপিএস, এমডি, এমএস, এফআরসিএস এর মত উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেও কর্মক্ষেত্রে তারা সামনে এগোতে পারেননি। অথচ এই সকল চিকিৎসককে যথাসময়ে পদোন্নতি প্রদান করলে তারা সাধারণ জনগণকে আরো উন্নত বিশেষজ্ঞ সেবা প্রদান করতে পারতো। জনগণ তাদের এই বিশেষজ্ঞ সেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এছাড়াও প্রায় ৯৩ জন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসক দীর্ঘদিন যাবৎ ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছে। দীর্ঘদিন একই পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় তারা কর্মস্পৃহা হারাচ্ছেন। এসব বৈষম্য নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. আব্দুল মান্নান দেশের প্রথম শ্রেণীর একটি জাতীয় দৈনিকে তার দেয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, এমন সমস্যা অনেক দিনের। আমরা এটা দূর করার চেষ্টা করছি। সমাধান হবে। তবে একটু সময় লাগবে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ও সচিব কমিটির অনুমোদনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সহিত পরামর্শক্রমে বাংলঅদেশ সিভিল সার্ভিস রিক্রুমেন্ট রুল ১৯৮১ অধিকতর সংশোধন করে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে দুই হাজার একজনকে তাদের চাকরির প্রথম যোগদানের তারিখ হতে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত করে।
বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত হওয়ায় ১৯৮১’র রুল অনুসারে এই সকলকে ক্যাডার পদে চাকরি স্থায়ী করলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ২০২২ সালে বিসিএস(স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত হওয়ার প্রজ্ঞাপন প্রকাশের প্রায় ২ বছর পর বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকগণের অভিজ্ঞতা এবং দীর্ঘ ১৪ বছরের জনগণের স্বাস্থ্য সেবায় নিজেদের অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ, প্রশাসনিক উন্নয়ন ও সমন্বয়-১ অধিশাখা সর্বসম্মতিক্রমে চাকরি স্থায়ী করণের শর্ত প্রমার্জনা করে গত ৩রা জুন ২০২৪ সালে একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সুপারিশের জন্য প্রেরণ করে।
হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত করণের আদেশের বিরুদ্ধে গত ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে। রিট পিটিশন নং ১০৭৩৬/২০২২। উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল হওয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন প্রথমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রেরিত চাকরি স্থায়ী করণের প্রস্তাবনার পক্ষে মতামত না দিতে চাইলে গত ২৫ জুলাই ২০২৪ সালে উচ্চ আদালত হতে উক্ত রিটের বিষয়ে একটি রায় প্রকাশিত হয়, যেখানে বলা হয় বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকগণের চাকরি বৈধ এবং তাদের ক্যাডার পদে চাকরি স্থায়ী করণের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাবনার পক্ষে মতামত প্রদান করিতে কোন বাধা নেই বা কোন অন্তবর্তীকালীন কোন আদেশ নেই।
এই রায় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন ক্যাডার পদে চাকরি স্থায়ী করণের পক্ষে মতামত প্রদান করে গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চাকরি ক্যাডার পদে স্থায়ী করণ করে গ্যাজেট প্রকাশ করার জন্য সুপারিশ প্রদান করে।গেজেট প্রকাশে বিলম্ব হওয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেছুর রহমান এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কারণে তা অদ্যাবধি গেজেট প্রকাশ করা হয় নি।
বর্তমানে হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের কতিপয় কর্মকর্তাগণ বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের নিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। জানা যায়, হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা পরস্পরের যোগসাজশে গেজেট প্রকাশে কালবিলম্ব করাচ্ছে। বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের দাবি বিভিন্ন সময়ে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রদান করছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভুল ও মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে স্বাস্থ্য খাতের অবনতি ঘটানো ও কর্মকর্তাদের নামে মানহানির অপচেষ্টা করছেন। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন ভুক্তভোগী চিকিৎসকরা। বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকগণ, হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সকলের প্রতি এমন মিথ্যে, অসত্য ও বানোয়াট তথ্য প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন। যেন দেশের স্বাস্থ্য খাতে কোনোভাবেই বিশৃঙ্খলা দেখা না দেয়। একই সাথে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে স্থায়ী করণের গ্যাজেট প্রকাশের দাবি জানান।
এমএসএম / জামান