দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ভারত-কানাডার ঠান্ডা যুদ্ধ
গত বছর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেন, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার প্রমাণ আছে তাদের কাছে।ভারতের তরফে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। এরপর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপরাধমূলক অভিযান চালানোর অভিযোগ তুলেছে কানাডা। বর্তমানে ভারত এবং কানাডার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর কোনো পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতটা খারাপ হয়নি।
ঠান্ডা যুদ্ধের পর ভারত মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে। ভারতের লক্ষ্য ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ বাজার অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার। জি-৭ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নেরও চেষ্টা করেছে ভারত। কানাডা এই উভয় গ্রুপের অংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। উভয় দেশের অর্থনীতিও একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খালিস্থানপন্থী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলায় ভারতীয় যোগ থাকার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার দ্বৈত নাগরিক এই ব্যক্তি এক সময় ‘শিখস্ ফর জাস্টিস’ নামে সংগঠনের মুখপাত্র ছিলেন। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র খালিস্তান গঠনের প্রচারাভিযান চালানোর কারণে ভারত সরকার ওই সংগঠনকে ২০১৯ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করে সেই সময় ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল পান্নু ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছেন। ভারতের পক্ষ থেকে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের তদন্তের জন্য একটা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি তৈরির ঘোষণা করা হয়।
গত বছরই মার্কিন ফেডারেল আদালত নিখিল গুপ্তা নামে এক ভারতীয় নাগরিককে মার্কিন নাগরিক গুরপতবন্ত সিং পান্নু হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করে।বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে এই মামলায় সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কানাডার তোলা অভিযোগকে কেন্দ্র করে ভারত এবং সে দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুনভাবে অবনতি ঘটেছে। পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আনন্দ সহাইয়ের মতে, ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করেন জাস্টিন ট্রুডো ২০২৫ সালের অক্টোবরে কানাডার সাধারণ নির্বাচনে হেরে যাবেন। এরপর নতুনভাবে সূচনা করার সুযোগ মিলবে। পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৮৫ সালের এয়ার ইন্ডিয়া বোমা হামলার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, যে ঘটনায় ৩৩১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।কানাডার ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কানাডায় ভারতীয় হস্তক্ষেপের কথা বিশ্ব হয়তো আজ জানতে পেরেছে, কিন্তু তাদের কাছে এটা গত চার দশকের অভিজ্ঞতা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে জারি করা বয়ানে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সহিংস চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছেন, যারা কানাডায় ভারতীয় কূটনীতিক ও কমিউনিটি নেতাদের হুমকি দিচ্ছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নাম করে এসব হতে দিচ্ছে কানাডা সরকার। অবৈধভাবে কানাডায় প্রবেশ করা কিছু ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দিতে কোনওরকম বিলম্ব হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি কানাডা প্রত্যাখ্যান করেছিল যাতে সন্ত্রাসীরা কানাডায় থাকতে পারে। কানাডার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলেছে ভারত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 'ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভারতের প্রতি বৈরিতার প্রমাণ মিলেছে। ২০১৮ সালে যখন তিনি ভারত সফরে এসেছিলেন, তখন তার লক্ষ্য ছিল নিজের ভোট ব্যাঙ্ক গড়ে তোলা। তার মন্ত্রিসভায় এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা প্রকাশ্যে ভারত বিরোধী চরমপন্থী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী এজেন্ডার সাথে যুক্ত ছিলেন। ট্রুডোর সরকার এমন এক দলের ওপর নির্ভর করেছিল, যাদের নেতারা প্রকাশ্যে ভারত বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করেছিলেন। প্রসঙ্গত, কানাডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। কানাডার জনসংখ্যার ২.১% শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত। গত ২০ বছরে কানাডায় শিখদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষা, ক্যারিয়ার, চাকরির মতো কারণে পাঞ্জাব থেকে কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন। জাস্টিন ট্রুডো যখন তার প্রথম মেয়াদে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, তখন সেখানে চারজন শিখ মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ থেকেও ট্রুডো সরকারের কাছে শিখ সম্প্রদায়ের গুরুত্ব অনুমান করা যায়। এদিকে, গত চৌঠা সেপ্টেম্বর নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) নেতা জগমিত সিং জাস্টিন ট্রুডো সরকারের ওপর থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করার ঘোষণা করেন। এনডিপির সমর্থন নিয়েই চলছিল ট্রুডোর সরকার। তবে এনডিপি থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও সংসদে আস্থা প্রস্তাবে জয় লাভ করতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। ২০২৫ সালের অক্টোবরে কানাডায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। জাস্টিন ট্রুডো চান কানাডায় বসবাসকারী শিখ সম্প্রদায় তাকে সমর্থন করুক। ২০১৫ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন তিনি। তবে, ২০১৯ ও ২০২১ সালে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় তিনি অন্য দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে তার সরকার। প্রসঙ্গত, জগমিত সিংয়ের দল এনডিপির সমর্থনে সরকার পরিচালনাকে ভাল চোখে দেখেনি ভারত।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত জগমিত সিংয়ের দল কানাডায় গত নির্বাচনে ২৪টা আসন জিতেছিল। কিংমেকারের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনডিপির নেতা হওয়ার আগে জগমিত সিং খালিস্তানের সমাবেশে যোগ দিতেন। একাধিকবার ভারতের সমালোচনা করেছেন তিনি। হরদীপ সিং নিজ্জরকে ২০২৩ সালের ১৮ই জুন একটা গুরুদ্বারের পার্কিং লটে গুলি করে হত্যা করা হয়।কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে গুরু নানক শিখ গুরুদ্বারের সভাপতিও ছিলেন তিনি। জলন্ধরের ভার সিং পুরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন হরদীপ সিং নিজ্জর। ভারত সরকারের মতে, তিনি খালিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান ছিলেন। খালিস্তান টাইগার ফোর্সের সদস্যদের পরিচালনা, নেটওয়ার্কিং, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা করার বিষয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন হরদীপ সিং নিজ্জর। তার হত্যার ঘটনা প্রসঙ্গে গত বছর ১৮ই সেপ্টেম্বর কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো কানাডার ‘হাউজ অফ কমন্সে’ বলেন, হরদীপ সং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের সম্ভাব্য জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। এরপর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ভারত ৪০ জন কানাডিয়ান কূটনীতিকের কূটনৈতিক দায়মুক্তি বাতিল করে দেয়। এই কারণে, কানাডিয়ান দূতাবাসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কর্মীকে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। সেই সময় ভারত জানিয়েছিল, কানাডা শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা শুধু ভারতের জন্যই নয়, কানাডার পক্ষেও হিতকর নয়। ২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আরও একবার ওই হত্যা মামলায় ভারতীয় সংযোগের কথা উল্লেখ করেন। সেই সময়েও ভারত তীব্র আপত্তি জানিয়ে অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। সম্প্রতি আরসিএমপি যে প্রমাণ দিয়েছে তা কিন্তু কোনও মতেই উপেক্ষা করা যাবে না।
পাশাপাশি, কানাডার তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবারও আবেদন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। শুধু তাই নয়, তদন্ত নিয়ে ভারতের নিষ্ক্রিয়তা এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্যও বন্ধ করা উচিৎ।দীর্ঘদিন ধরে যা দাবি করে আসছিল ভারত, কানাডা তা পূরণ করেছে। কানাডার মাটিতে এক কানাডিয়ান নাগরিককে হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের সঙ্গে ভারতীয় এজেন্টের যোগসূত্রের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হস্তান্তর করেছে কানাডা। এখন ভারতের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পালা। এতে দুই দেশ ও জনগণের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। কানাডা এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। এদিকে কানাডার অভিযোগ নস্যাৎ করে ভারত পাল্টা দাবি করেছে কানাডা থেকে হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মা ও অন্যান্য কূটনীতিকদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কানাডার ছয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও নিয়েছে ভারত। ট্রুডো সরকারের মনোভাবের কারণে ভারতীয় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। বর্তমান সরকারের প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার কানাডা থেকে হাইকমিশনার সহ অন্যান্য কূটনীতিকদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত জানিয়েছে,ট্রুডো সরকার যেভাবে ভারত বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদ ও চরমপন্থাকে সমর্থন করছে, তার জবাব দেওয়ার অধিকার ভারতের রয়েছে। নিজ্জার হত্যা মামলায় ভারতীয় হাইকমিশনারের নাম উল্লেখ করার প্রসঙ্গে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুরো বিষয়টা এখন রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে, কারণ একাধিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে ভুঝেছেন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। যা-ই হোক, পরবর্তিতে ভারত কানাডার সম্পর্ক কোন দিকে যাবে,তা সময়ই বলে দেবে।
T.A.S / T.A.S