টাঙ্গাইলের ধলেশ্বরী নদী ৩ উপজেলাবাসীর মরণ ফাঁদ

দুর্ভোগের আরেক নাম টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মাহমুদ নগর ইউনিয়নের পাড় বহুলী খেয়াঘাট। ধলেশ্বরী নদীর ওপর একটি সেতুর অভাবে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা ছাড়াও নগরপুর, সিরাজগঞ্জের চৌহালী অঞ্চলের মানুষ দুর্ভোগে রয়েছেন। এ যেন দেখার কেউ নেই! প্রতিনিয়তই এই অঞ্চলের মানুষ সেতু না থাকায় নদী পারাপরের সময় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখেই অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। এলাকার একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রীও হয়েছেন, কিন্তু আমলা তান্ত্রিক জটিল ও সদিচ্ছার কারণে সেতু নির্মাণ হয়নি। মাহমুদনগর ইউনিয়নে করিমগঞ্জ হাঁটের পাশেই মেজর মাহমুদুল হাসান উচ্চ বিদ্যালয় ও বালিয়াপড়া উচ্চ বিদ্যালয় নামে ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আবার একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র কারিগরি স্কুল, ১০টি প্রাইমারি স্কুল, কোরাইশনগর ফাজিল মাদ্রাসা ও একাধিক হাফিজিয়া মাদ্রাসা রয়েছে। রয়েছে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। মাহমুদনগর ও তার আশপাশে মাকোরকোল হাট, খাষ শাহ্জানী হাট, বালিয়াপাড়া, চাঁনবয়রা, কাতুলির তোরাপগঞ্জের হাট অন্যতম। মাহমুদনগরে পশ্চিম দিকে যমুনার চরাঞ্চল। এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দাদের প্রধান পেশা কৃষি। তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য এসব হাটবাজার ও শহরে নিয়ে বিক্রি করতে হয়। কৃষকের উৎপাদিত ফসল বর্ষাকালে শহরের হাটে বিক্রি করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় শত বছর ধরে চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তির মধ্য দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর খেয়া পারাপর হচ্ছেন। শুধু মাহমুদনগরই নয়, এই খেয়া পার হয়ে, টাঙ্গাইল সদর হতে চৌহালী, মানিকগঞ্জের আড়িচা, শিবালয় হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে রাত দিন মানুষ চলাচল করছেন। পাড় বহুলীর গোলচত্ত্বরের পাকা সড়ক দিয়ে নদীর ঘাটের দিকে যেতে আরো বেশী ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। বর্ষাকালে খেয়াঘাটের আগে ডোবায় পানি আসে, আবার কয়েকদিনের মধ্যেই তা শুকিয়ে যায়। ফলে সেখানে খেয়া নৌকার ইজারাদার কয়েকদিন পর পরই বেকায়দায় পড়ছেন। শুধু তাই নয়, আবার বৃস্টি হলে খেয়াঘাটে যেতে মানুষের কৃর্ষি জমির কাঁচা মাটি হওয়ায় সেখানে কাঁদার সৃস্টি হয়। ফলে সিএনজি অটোরিকসা, রিকসা ভ্যান গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গর্ভবর্তী নারী, অসুস্থ রোগী ছাড়া প্রবীণ নারী-পুরুষ ও স্থানীয় স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নদী পারাপারে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছেন। অনেক সময় চলাচলকারী মানুষ সেখানে কাঁচা মাটির কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। 

তাছাড়া, বহুলী এই খেয়া ঘাটের মাঝিদের নৌকা ঘাটে ভিড়াতে বেশ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। নদীতে পানি বাড়লে পাড় ভেঙে যায়। ফলে নৌকা ভিড়াতে তাদের হিমসিম খেতে হয়। বিশেষ করে ঝড়-তুফানের সময় নৌকায় মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোসহ যানবাহন তোলা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। 
টাঙ্গাঈল সদর উপজেলার ১২ নং মাহমুদ নগর ইউনিয়নের আয়তন হচ্ছে, ৮বর্গ কিলোমিটাল। মোট জনসংখ্য ১৯হাজার ৭৫৫জন। আর ভোটার সংখ্যা ১২০০০জন। পরিবারের সংখ্যা ৪২০০টি, ২৪টি, ডাকঘর ১টি। শিক্ষার হার ৭০.৫শতাংশ।মোট বাড়ীর জমির পরিমাণ হচ্ছে,৬০৭৬.৯১ একর। ২২ টি জলধারা ছাড়াও ১৫টি বিল রয়েছে। আর পাকা রাস্তা মাত্র ৭ কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তা ১৫ কিলোমিটা। ২৫টি পুকুর ও দু’টি নদী রয়েছে। এলাকার অধিকাংশই মানুষই ধর্মভীরু। মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান রয়েছে। 

স্থানীয়রা জানান, মাহমুদনগর ইয়িনের নির্বাচিত তরুণ চেয়ারম্যান আসলাম হোসেন শিকদার এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে ২৩-২৪টি গ্রাম নিয়ে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক জনসাধারণের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হচ্ছে এই ইউনিয়ন। ধলেশ্বরী নদীতে সেতুটি নির্মাণ না হওয়ায় তিনটি উপজেলা অর্থাৎ নাগরপুর, সিরাজগঞ্জের চৌহালী ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযাগ বিচ্ছিন্ন। টাঙ্গাইল সদর থেকে নাগরপুর হয়ে চৌহালী যেতে প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার ঘুরে যতে হয়। সেতু নির্মাণ হলেই টাঙ্গাইল সদর থেকে মাহমুদনগর হয়ে চৌহালী উপজেলায় যাতায়াত সহজ হবে। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চল দিয়ে যমুনার পশ্চিমের মানুষও অল্প সময়ে চলাচল করতে পারবে। আবার ধলেশ্বরী সেতু না থাকায় শুকনো মৌসুমে প্রায় এক কিলোমিটার পথ তপ্ত বালুর পথ হেঁটে পার হতে হয়। এলাকার লক্ষাধিক মানুষের চলাচলের একমাত্র এই রাস্তা।

কুকুরিয়া এলাকার শিক্ষানুরাগী আব্দুর রশিদ জানান, ‘বর্ষাকালে নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে হয়। এখানে নদীর ওপর সেতু হলে আমাদের খুবই উপকার হবে। শুধু তাই নয়, এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষক। তাদের কৃষিপণ্য বিক্রির জন্য হাট বাজারে যেতে।ফলে তাদের অনেক খরচ ও সময়ও বেশী লাগে। সেতুটি হলে তাদের অনেক উপকার হবে।

ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের অধ্যাপক মো. আব্দুল বাতেন জানান, মাহমুদনগর ইউনিয়নের ধলেশ্বরী নদীর উপর ব্রিজ না থাকায় মাকোরকোল, কুকরিয়া, খাষ কাউলিয়া, খাষ সাহাজানি, ধলাই, আগদিঘুলিয়া, হরিপুর, শরাতৈল, ধলাইসহ চরাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরঞ্চলের থাকেন। তারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় বড় পদে সুনামেন সঙ্গে কর্মরত আছেন। তাদের প্রতি বছর ঈদ ও বিভিন্ন দিবসে নাড়ীর টানে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রাণ টানে। কিন্তু এই নদীতে সেতু না থাকায় ভোগান্তির কারণে তারা গ্রামমুখি হতে পারছেন না। আর এই সেতু নির্মাণ করা হলে, এলাকার এসব চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা ছাড়াও প্রবাসিরা এলাকার উন্নয়নের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারবেন। তাই অনতি বিলম্বে এই সেতু নির্মাণের জন্য সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, নদীতে ফেরি বা অন্য কোনো বিকল্প পথের তুলনায় সেতু ব্যবহারের মাধ্যমে যাতায়াতে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হয়। সেতু ব্যবহারের ফলে নদী পারাপারে নৌকাডুবি বা অন্যান্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে যায়। স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলবে। সেতু নির্মাণের ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবেন। উদাহরণস্বরূপ, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। ফেরি পারাপারের দীর্ঘ সময় ও ভোগান্তি দূর হয়েছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।মোটকথা, সেতু শুধু একটি অবকাঠামো নয়, এটি একটি অত্র অঞ্চলের উন্নয়ন ও মানুষের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে।

আর কুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা টাংগাইল সাবালিয়া আদর্শ হাই স্কুল ও কলেজের অধ্যাপক  মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ বলেন, মাহমুদনগর পাড়বহুলী নদীর খেয়া ঘাটের জায়গায় একটি সেতু অত্র এলাকার মানুষের প্রাণের দাবী। সেতুটি নির্মাণ হলে এলাকার সঙ্গে টাঙ্গাইলের দক্ষিণাঞ্চলসহ পশ্চিমের যমুনার চরঞ্চালের মানুষের চলাচলে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। যা তাদের যাতায়াতকে সহজ করবে। বিশেষ করে নদী, খাল বা অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এলাকাগুলোকে সংযুক্ত করতে সেতু অপরিহার্য। আর সেতুটি নির্মাণের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উন্নতি ঘটে। পণ্য ও যাত্রী সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহন করা যায়, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এলাকার সেতুটি নির্মাণে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দাবি করছেন তিনি।

জাতীয় কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা এর অনুষ্ঠান সংগঠক মো. আবদুস সালাম জানান, মাহমুদনগর ইউনিয়নের ধলেশ্বরী নদীর উপর সেতুর প্রয়োজনীয়তা অনেক কারণে অপরিহার্য। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ অবহেলিত। এখানে সেতু নির্মাণ হলে অত্র এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর এলাকার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন কররে, যা যাতায়াতকে সহজ হবে। বিশেষ করে নদী, খাল বা অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এলাকাগুলোকে সংযুক্ত করতে সেতু নির্মাণ অপরিহার্য।

মাহমুদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসলাম হোসেন শিকদার জানান, তার ইউনিয়নের ধলেশ্বরী নদীতে সেতু না থাকায় এলাকার হাজার হাজার বাসিন্দা দুর্ভোগে পড়ছেন। এলাকার গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি বহুলী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা। এখানে সেতু নির্মাণ করা হলে টাঙ্গাইল সদর উপজেলাসহ নগরপুর ও চৌহালী উপজেলার বাসিন্দাদেরও ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি ও অর্থণৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। আর অত্র অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান বা সামগ্রিক উন্নতি, বাসিন্দাদের আয়, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। সেতুটি হলে এলাকার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদানে প্রসার ঘটবে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান এর সঙ্গে তার সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি জানান, ধলেশ্বরী নদীতে সেতু নির্মাণের বিষয়টি অত্যান্ত জনগুরুত্ব বিবেচনা করে সেতুটির পরিমাপ করা হয়েছে। তবে নির্মাণে সময় লাগবে। আগামি জুলাই মাসের দিকে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনাটি পাঠানো হবে।