ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

উন্নয়নহীন ১২ হাজার মানুষের জীবনযুদ্ধ: বড়লেখায় এক অবহেলিত পাহাড়ি জনপদের নাম 'বোবারথল'


বড়লেখা প্রতিনিধি photo বড়লেখা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২৫-৮-২০২৫ দুপুর ৪:০

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী একটি পাহাড়ি জনপদ হলো 'বোবারথল'। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও বাস্তবতার চিত্র এখানে রীতিমতো করুণ ও দুর্দশাগ্রস্ত। বড়লেখা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুর্গম টিলা অঞ্চলে বোবারথল জনপদে আনুমানিক ১০-১২ হাজার মানুষ বসবাস করে। সরেজমিনে পরিদর্শন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বোবারথল, করইছড়া, উত্তর করইছড়া, দক্ষিণ গান্ধাই, মাঝ গান্ধাই, গান্ধাই পুঞ্জি, পেকুছড়া, ইসলামনগর, শান্তিনগর, কুসবানগর, বারোঘরি, উত্তর ডিমাই, বেকি, ষাটমার পাড়, ওসমানী বাজার এবং ষাটঘরি—মোট ১২টি গ্রাম নিয়ে গঠিত বৃহত্তর বোবারথল যেন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় উপেক্ষিত একটি অধ্যায়।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন ধরে চরম সংকট বিরাজ করছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখানকার মানুষ ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। বোবারথলের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট হলো সুপেয় পানি, যাতায়াত ব্যবস্থা ও চিকিৎসাসেবা। পুরো এলাকাজুড়ে নেই কোনো গভীর কিংবা অগভীর নলকূপ। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে পাহাড়ি ছড়া, ঝরনার পানি ও টিলার নিচে পাতকুয়া। শুষ্ক মৌসুমে এসব ছড়া শুকিয়ে গেলে পাহাড়ে গর্ত খুঁড়ে চুঁইয়ে পড়া পানি সংগ্রহ করতে হয়, যেখানে পানি জমতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। স্থানীয় গৃহবধূ তাছলিমা বেগম জানান, “পাহাড় বেয়ে দিনে দুইবার পানি আনতে হয়। গর্তে পানি জমতে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগে।” স্থানীয় বাসিন্দা বারোঘরি গ্রামের ইমন আহমদ বলেন, “এই পানি খাওয়ার অনুপযোগী হলেও বিকল্প না থাকায় তা রান্না, গোসল ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়, যার ফলে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই প্রায়ই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।”

জানা যায়, এখানে কোনো উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মী নেই। স্থানীয় দোকানদার ও ভেষজ চিকিৎসকদের ওপর নির্ভর করে সাধারণ রোগের চিকিৎসা করা হয়। গুরুতর রোগীদের ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদর হাসপাতালে নেওয়ার সময় যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে রোগীর অবস্থা প্রায়শই আশঙ্কাজনক হয়। গ্রামের সঙ্গে শহরের কোনো পাকা রাস্তার সংযোগ নেই। প্রতিদিন কর্দমাক্ত টিলাপথ, ভাঙা কালভার্ট ও সাঁকো পার হয়ে চলাচল করতে হয়। বর্ষায় এই পথ আরও ভয়ঙ্কর হয়। কোনো যানবাহন নিয়মিত চলাচল করে না। অসুস্থ রোগীদের কাঁধে বা খাটিয়ায় করে প্রধান সড়কে নেওয়া হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য এই পথ চলা দুঃস্বপ্নের মতো বিভীষিকাময় হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামনগর গ্রামের সেলিম উদ্দিন বলেন, "জীবনটা গেল পাহাড়ে ওঠানামা আর ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে। আমরার গ্রামে একটা ভালো সড়কও নাই, কমিউনিটি ক্লিনিকও নাই, পানি তো খাইতেই ভয় লাগে। সরকার কয় উন্নয়ন, আমরার ভাগ্যে তা কই?"

গ্রামের বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও তা প্রায়ই বিচ্ছিন্ন থাকে। মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রায় নেই বললেই চলে, ইন্টারনেট প্রায় অকার্যকর। ফলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল শিক্ষা ও অনলাইন ক্লাসের মতো সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাক্ষেত্রেও চিত্র হতাশাজনক। এলাকাটিতে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ও ১টি হাইস্কুল থাকলেও শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। স্থানীয় শিক্ষকদের মতে, বর্ষা মৌসুমে রাস্তার কারণে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। ফলে তাদের নিয়মিততা ও মনোযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পশ্চিম পেকুছড়া গ্রামের আল ইমরান বলেন, "রাস্তার দুর্দশার কারণে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েছে।" কলেজছাত্র রাজিব উদ্দিন জানান, "দুর্গম রাস্তার কারণে বাড়ি থেকে কলেজ যেতে দৈনিক প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে।" কৃষকরাও উৎপাদিত পণ্য বাজারে নিতে পারেন না, ফলে অনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।

স্থানীয় বাসিন্দা জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম বোবারথল মাদ্রাসার সভাপতি ও স্থানীয় সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বোবারথল প্রবাসী ঐক্য পরিষদের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল মুকিত জানান, "এলাকাবাসী তথা দেশ-বিদেশীদের অর্থায়নে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে কোনো রকমে রাস্তা সংস্কার কাজ করানো হয়েছে। তবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো ফলপ্রসূ সমাধান পাওয়া যায়নি।" স্থানীয় ইউপি সদস্য ময়নুল হক বলেন, "বোবারথল অবহেলিত একটি জনপদ। রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে, রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া যেন এক যুদ্ধ। অসুস্থ রোগীকে সহজে হাসপাতালে নেওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে বাঁশ ও ঝুড়ির সাহায্যে দুইজন মিলে রোগীকে কাঁধে তুলে পাহাড়ি কাদা-পথ পেরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। এছাড়া গভীর নলকূপের বরাদ্দ মিললেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো 'বোবারথল' নাম শুনলেই পিছিয়ে যায়।"

দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, "বোবারথলের কথা বহুবার উপজেলা পরিষদ সভায় তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দেশের মানচিত্রে আজও অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনপদের নাম বোবারথল। ইউনিয়নের সীমিত বরাদ্দে এখানে উন্নয়ন সম্ভব নয়, প্রয়োজন সরকারি পর্যায়ে বড় ধরনের বিশেষ বরাদ্দ।" তিনি জানান, "যাতায়াতের দুরবস্থা এই এলাকার মানুষের প্রধান দুর্ভোগ। ফলমূল উৎপাদন করেও ব্যবসায়ীরা বাজারে নিতে পারেন না। বর্ষা এলে কাদা হাঁটু পেরিয়ে কোমরে পৌঁছে যায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারেন না। ফলে শিক্ষা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে বোবারথল।" চেয়ারম্যান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, "যদি রাস্তা পাকা করা হয় বা অন্তত ডাবল ইট সোলিং দেওয়া যায়, তবে বোবারথলের চেহারা বদলে যাবে, জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আসবে, আর বোবার বহু বছরের কষ্টের অবসান ঘটবে।"

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বড়লেখা কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মঈন উদ্দিন বলেন, "পাহাড়ি ভৌগোলিক অবস্থার কারণে এ এলাকায় টিউবওয়েল স্থাপন করা সম্ভব হয় না। আমাদের দপ্তর থেকে ৭-৮টি রিং টিউবওয়েল (পাতকুয়া) স্থাপন করা হয়েছে। বোবারথল নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য আমরা বিকল্পভাবে সমতল এলাকায় টিউবওয়েল স্থাপন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি পৌঁছানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কিন্তু এলাকা অনেক উঁচু ও দুর্গম হওয়ায় প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, ফলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।" উপজেলা প্রকৌশলী অধিদপ্তর (এলজিইডি) কার্যালয়ের উপ-সহকারী মিয়া মোহাম্মদ মুরাদ বলেন, "বোবারথল সড়ক উন্নয়নের জন্য রুরাল কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (আরসিআইপি) প্রকল্পের আওতায় একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল, যা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।" তিনি বলেন, "দুর্গম বোবারথল এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করা গেলে সত্যিকার অর্থে স্থানীয়দের জন্য তা অত্যন্ত উপকারী হবে।"

এ বিষয়ে উপজেলার নির্বাহী অফিসার গালিব চৌধুরী জানান, "আমি বোবারথল এলাকা সম্পর্কে কিছু অবগত নই। আমি এই উপজেলায় নতুন এসেছি। স্থানীয় চেয়ারম্যান বোবারথল এলাকা নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি।" স্থানীয়রা আশা করেন, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বোবারথলের উন্নয়নে আরও গুরুত্ব দেবে এবং বাস্তব কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে, যাতে তারা উন্নয়নের আলো দেখতে পারে।

এমএসএম / এমএসএম

শান্তিগঞ্জে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়ন শীর্ষক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

নাফনদীর মোহনায় ট্রলার ডুবি, ৭জেলে উদ্ধার

বালিয়াকান্দিতে জেলা প্রশাসকের মতবিনিময়

বাউফলে চেয়ারম্যান পরিবহন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

আদমদীঘিতে সমন্বয় কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত

জয়পুরহাটে পৌর হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির কার্যক্রম স্থগিতের দাবীতে স্মারকলিপি প্রদান

দৌলতপুরে মুখ বাঁধা অবস্থায় নারীর মরদেহ উদ্ধার

কমিউনিটি পুলিশিং সভা ও উদ্ধারকৃত মোবাইল-অর্থ হস্তান্তর: মেহেরপুর জেলা পুলিশের জনবান্ধব উদ্যোগ

ভূরুঙ্গামারীতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবজাতক শিশুদের জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করছে উপজেলা প্রশাসন

পাবনায় ট্রিপল মার্ডারের রায়ে একজনের মৃত্যুদন্ড

গলাচিপা সরকারি কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে জামায়াতের এমপি পদ প্রার্থীর মত বিনিময় সভা

ত্রিশালে মসজিদে চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত

চৌগাছা সরকারী হাসপাতালে ডাক্তার সংকট, চিকিৎসা সেবা ব্যহত