তবুও রক্ষা পেল না খেলার মাঠ, পলোগ্রাউন্ডেই বাণিজ্য মেলা
”খেলার মাঠে মেলা নয়” ভাষণে এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। খেলার মাঠে মেলা না করার দাবিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ক্রীড়া প্রেমিদের কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে পলোগ্রাউন্ড মাঠে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও শিক্ষার্থীরা। তাদের আহাজারিতে সাড়া দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকও।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলার মাঠে বইমেলা ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পূ্বের নির্ধারিত মাঠে না হলেও বাণিজ্য মেলার ছোঁবল থেকে রক্ষা করা গেল না রেলওয়ের মালিকানাধিন পলোগ্রাউন্ডের বিশাল খেলার মাঠটি। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডান্ট্রির (সিসিসিআই) আয়োজনে আগামি ১৫ ফেব্রুয়ারি পলোগ্রাউন্ড মাঠে শুরু হতে যাচ্ছে ৩১তম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (সিআইটিএফ)।
গত সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম চেম্বারের স্থায়ী কার্যালয় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানিয়েছে চেম্বার নেতৃবৃন্দ।মাসব্যাপি আয়োজিত বাণিজ্য মেলা ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ডে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। উদ্বোধন করবেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু)। বিশেষ অতিথি থাকবেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এমএ লতিফ এবং গেস্ট অব অনার হিসেবে থাকবেন এফবিসিসিআই’র সভাপতি মাহবুবুল আলম। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রাম রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিতব্য এবারের মেলায় থাকছে দেশি-বিদেশি তিন শ প্রতিষ্ঠানের চার শ স্টল।
অথচ খেলার মাঠ দখল করে মেলার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। গত ৯ ফেব্রুয়ারি নগরের চকবাজারের প্যারেড মাঠে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আয়োজিত ‘আন্তস্কুল-কলেজ বার্ষিক ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, খেলার মাঠ দখল করে কোনো মেলা আয়োজনের প্রয়োজন নেই। চট্টগ্রামের মাঠ রক্ষায় মেয়রকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মাঠগুলো খেলাধুলার জন্য রক্ষা করতে হবে। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও যাতে খেলার সুযোগ পায়, সেটি লক্ষ রাখতে হবে। কারণ, সুষম উন্নয়নের জন্য শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, সিটি করপোরেশনের ৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তাদের মানসম্মত ও আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে ক্রীড়া, বিতর্ক ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) সভাপতি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেছিলেন, চট্টগ্রাম নগরীর আউটার স্টেডিয়ামসহ খেলার মাঠগুলোতে জেলা প্রশাসনের উগ্যোগে আর কোনো মেলা হবে না। এগুলো খেলাধুলার জন্যই উন্মুক্ত রাখা হবে। মাঠে অবৈধ স্থাপনা থাকলে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে। তবে অন্য খোলা মাঠে মেলার আয়োজন বন্ধ থাকবে না। চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুরে জেলা প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে যে সরকারি জায়গা উদ্ধার করেছে, সেখানে সব মেলার আয়োজন করা হবে।
একই সময়ে সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছিলেন, দীর্ঘদিন নগরীর আউটার স্টেডিয়াম, রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ডসহ বিভিন্ন খেলার মাঠে প্রায় সারা বছরই নানা নামে পণ্য মেলা বসছে। এতে কার্যত মেলা আয়োজনকারীদের দখলে চলে গেছে খেলার মাঠগুলো। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে মাঠগুলোর পরিবেশ খেলাধুলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় খেলার মাঠে মেলার আয়োজন বন্ধ করে আবার খেলাধুলা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। তাই চট্টগ্রামের খেলার মাঠ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় মানের খোলোয়াড় তৈরি করতে হলে ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ আলাদা ৫টি অনুশীলন মাঠ প্রয়োজন। বিশেষায়িত মাঠ না হলে ক্রীড়াঙ্গনে প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না।
”খেলার মাঠে মেলা নয়” জেলা প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের ফলে এবার চসিকের আয়োজনে অমর একুশে বই মেলা স্থানান্তিরিত হয়েছে সিআরবি শিরিষ তলায়। আর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা করা হযেছে পাহাড়তলীর শহীদ শাহাজাহান মাঠে।
প্রসঙ্গত, খেলার মাঠ কেবল খেলার জন্য বরাদ্দ রাখায় এ বছর চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের পার্শ্ববর্তী আউটার স্টেডিয়ামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা হয়নি। প্রতিবছর এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের পাশের জিমনেসিয়াম চত্বরে বিজয় মেলার মঞ্চ এবং আউটার স্টেডিয়ামে মাসব্যাপী মেলা বসে। মেলা শেষে তাঁত মেলা, গাড়ি মেলাসহ নানা অনুষ্ঠানের কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা আর আউটার স্টেডিয়ামে খেলতে পারত না। জেলা প্রশাসন গত বছর মাঠটি উদ্ধার করে। উচ্ছেদ করে মাঠের জায়গা দখল করে তৈরি করা অবৈধ রেস্তোরাঁসহ সকল স্থাপনা। বর্তমানে এ মাঠ সর্বসাধারণের খেলার জন্য উন্মুক্ত। খেলার মাঠে মেলা আয়োজন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকরা নানা আলোচনা-সমালোচনা করে আসছিলেন। খেলার মাঠে মেলা আয়োজন করায় উঠতি বয়সের তরুণ-কিশোররা খেলাধুলা করা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। এতে করে তরুণ-কিশোররা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ছে। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের নাগরিকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল- মেলা আয়োজনের জন্য স্থায়ী একটি ভেন্যুর। এ নিয়ে মেলার আয়োজকদেরও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। অবশেষে খেলার মাঠে মেলা আয়োজনের সমস্যাটি সমাধানের পথে।
এর আগে গত বছর নগরের পলোগ্রাউন্ড মাঠে ৩০তম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, আগামীতে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার জন্য আউটার রিং রোডে বে-টার্মিনালের উল্টোপাশে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হবে। (১৬ ফেব্রুয়ারি/২৩) সকালে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। নকশার কাজের প্রক্রিয়া চলমান আছে। আগামী বছর (এই বছর) থেকে সেখানে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা আয়োজনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তবুও মাসব্যাপি মেলার আয়োজন পলোগ্রাউন্ডের খেলার মাঠে করা হয়েছে। এব্যপারে কথা বলতে, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও ফোন রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এমএসএম / এমএসএম