প্রশাসনের বিরুদ্ধে লিখায় সাইবার মামলা

সরকারী দফতরের অপকর্ম ঢাকতে সাইবার মামলার আশ্রয় নিচ্ছে সরকারী দুর্নীতিবাজরা। প্রশাসনের বিরুদ্ধে কলম চালালেই সাইবার মামলা দিতে দ্বিধাবোধ করছে না সরকারী রকর্মকর্তারা। হয়রানির শিকার হচ্ছে সংবাদকর্মী ও সাধারন মানুষ। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলা প্রশাসনের সাবেক ইউএনও খোন্দকার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাতের ইন্ধনে দায়ের করা সাইবার মামলা খারিজ করে দিয়েছে আদালত। 
চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সাংবাদিক মোঃ সাইফুল ইসলামকে রামগড় উপজেলা প্রশাসনের দায়ের করা মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তিনি ‘সাউথইস্ট এশিয়া জার্নাল’ নামে একটি সপ্তাহিক ম্যাগাজিন পত্রিকার ঢাকা অফিসে কর্মরত আছেন। অভিযোগ রয়েছে, রামগড় উপজেলা প্রশাসনের ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করা ও ফেসবুকে উক্ত সংবাদ ভাইরাল করায় ক্ষুব্দ হয়ে সাংবাদিক সাইফুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার মত ঘটনা ঘটিয়েছেন ইউএনও’র নির্দেশে প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল আহমেদ। 
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ির রামগড়ে ‘হাইকোর্টে রীট করে ইউএনও’র রোষানলে দুই দিনমজুর। এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের জেরে উক্ত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের কর্মরতদের মাধ্যমে প্রথমে থানায় সাধারণ ডায়েরি ও পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ (১) ধারায় মামলা করা হয়।  রামগড় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়ের করা এই মামলায় সাংবাদিক সাইফুল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়। উক্ত মামলায় সাইফুল ইসলাম হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন ও খাগড়াছড়ি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত থেকে স্থায়ী জামিনে ছিলেন। 
সত্য সংবাদ প্রকাশনার কারণে তিনি রামগড় উপজেলা প্রশাসনের উপজেলা নির্বাহী অফিসার দফতরের মামলার ফ্যাঁসাদে পড়েছেন এমন তথ্য উঠে এসেছে মামলার জামিন আবেদন থেকে। কেউই আইনের উর্দ্ধে নয় এমন মাপকাঠিতে তিনি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) এর আইনী সহায়তা চেয়েছেন এই সংবাদকর্মী। অবশেষে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারক জহিরুল কবিরের  আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে তৃতীয় দফায় জামিন নেন। এর আগে গত বছরের ৬ মার্চ সাংবাদিক সাইফুলকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন দেন হাইকোর্ট। এরপর গত বছরের ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির বিজ্ঞ চীফ জুড়িসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত থেকে অস্থায়ী ও ১৩ জুলাই স্থায়ী জামিন পান সাংবাদিক সাইফুল।
চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইবুন্যাল আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ মার্চ চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ জহুরুল কবির এর আদালত সাইফুল ইসলামকে এই মামলা হতে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। আসামী পক্ষের আইনজীবি ও বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান দীর্ঘ সময়ের শুনানীতে অংশ নেন। এছাড়াও এডভোকেট সাইফুদ্দিন খালেদ, হাসান আলী, বদরুল হাসান, জিয়াউদ্দিন  আরমান, শান্তনু চৌধুরীসহ মানবাধিকার আইনবিদগণ  বিবাদীপক্ষ শুনানিতে অংশ গ্রহণ করেন।  
সাইবার ট্রাইবুন্যাল আদালতে চার্জ শুনানীকালে আসামীর আইনজীবিরা বলেন, বিতর্কিত মোবাইল কোর্ট এর আদেশ নিয়ে, উচ্চ আদালতে দায়ের করা রিট মামলার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করার প্রমাণ মিলেছে সাইফুল ইসলামের প্রকাশিত সংবাদে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাংবাদিক সাইফুল নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনি সংবাদটি শেয়ার করেছেন। এতে তিনি কোন অপরাধ করেন নি। বরঞ্চ তিনি তার পেশাগগত দায়িত্ব ও সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সমুন্নত করেছেন। এটি মানহানির পর্যায়ে পড়ে না। 
এসময় বাদীর পক্ষে নিযুক্তিয় এডভোকেটগন আসামীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আবেদন জানান। ঘটনার সত্যতা ও তথ্য প্রযুক্তি আইনে অপরাধ না হওয়ায় আদালত উভয় পক্ষের শুনানী শেষে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন সাংবাদিক সাইফুলকে। চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের পাবলিক প্রসিকিউর (পিপি) এডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী সাইফুলকে মামলা থেকে অব্যাহতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাছে। 
সাইবার মামালা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সকালের সময়’কে জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে জনস্বার্থে আমি এই সংবাদ প্রকাশ করেছি এবং  তা বহুল প্রচারের জন্য আমার ব্যক্তিগত ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করি। এতে রামগড় উপজেলা প্রশাসনের সাবেক ইউএনও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে হয়রাণির জন্যই এ মামলাটি দায়ের। এমন ঘটনায় ও সঠিক কর্মকান্ডের কারণে উচ্চ আদালতের ডিভিশন ও চীফ জুড়িসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত আমাকে পূর্বে জামিন দিয়েছেন। 
তিনি আরো বলেন, এছাড়া বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসানের কাছে আমি আইনী সহায়তা চাইলে বিএইচআরএফ এডভোকেট প্যানেলের সহায়তায় আমি চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইবুন্যাল আদালতে সারেন্ডার পূর্বক জামিন লাভ করি। শেষ পর্যন্ত এমন রামগড় উপজেলা প্রশাসনের দায়ের করা মিথ্যা মামলা থেকে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক আমাকে অব্যাহতি দিয়েছেন। 
জানা গেছে, গতবছরের ১ আগস্ট রামগড় উপজেলা অফিস সংলগ্ন বিজিবি ক্যাম্পে কাজ করার সময় আবুল কালাম ও রুহুল আমিন নামে দুই দিনমজুরকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৫ দিনের সাজা দেন রামগড়ের ইউএনও খোন্দকার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত। পরে বিজিবির সঙ্গে ভূমি বিরোধের জেরে সংক্ষুব্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ সাজা দিয়েছেন এমন অভিযোগ উঠে। এমন অভিযোগে ২০২২ সালের  ২৫ অক্টোবর ইউএনওর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বাতিল ও ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে দুই দিনমজুর। এ ঘটনায় রিট তুলে নিতে দুই দিনমজুরকে রাজনৈতিক ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া ও হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠে ইউএনও’র বিরুদ্ধে। পরে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংবাদ প্রকাশ করেন সাইফুল ইসলাম। 
এদিকে, দুই দিনমজুরের করা রিটে ইউএনও'র ৬ মাসের বিচারিক ক্ষমতা বাতিল ও রিটকারীদের ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ কেন দেয়া হবে না মর্মে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে ইউএনও খোন্দকার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত চেম্বার আদালত ও আপিল বিভাগে আপিল করলেও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। বর্তমানে রুলটি হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
আরো জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর রামগড় থানায় সাংবাদিক সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১(১) ধারায় মামলাটি দায়ের করেন রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল আহমেদ। এর আগে ‘ইউএনওর রোষানলে দুই দিনমজুর নিরাপত্তাহীনতায়’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিক সাইফুলের বিরুদ্ধে রামগড় থানায় একটি জিডি করেন ইউএনও অফিসের উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম।