ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৫

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব অচল: সংবাদকর্মীরা সদস্য হতে বাধা কেন?


মো. কামাল উদ্দিন photo মো. কামাল উদ্দিন
প্রকাশিত: ২১-৮-২০২৪ দুপুর ১১:৫২

আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিকদের দাবির কারণে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এই সংকট সমাধানের জন্য অনেকে চেষ্টা করছেন, তবে এখনো সন্তোষজনক সমাধান হয়নি। বর্তমানে আমাদের নবনিযুক্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা, ফারুকে আজম, বীর প্রতীক, এই সংকট সমাধানের জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তার উদ্যোগের প্রতি সম্মান জানিয়ে কিছু কথা লিখছি।

কর্মরত সকল সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি আজকের এই লেখাটি লিখলাম। এর আগেও আমি আরো কয়েকটি লেখা লিখেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য লালায়িত নই, তবু বলতে চাই, একজন সাংবাদিক বা সংবাদকর্মী হিসেবে প্রেসক্লাবে সদস্য হওয়া তার অধিকার। যেহেতু ক্লাবটি সংবাদকর্মীদের বিনোদনের স্থান, এই ক্লাব কিন্তু সাংবাদিক বানানোর কোনো কারখানা নয়। সাংবাদিকরাই ক্লাব বানাতে পারেন, কিন্তু ক্লাবে সাংবাদিক তৈরি করা যায় না। সেই কথাটি আমরা সবাই জানার এবং বোঝার পরেও কেন যেন না বোঝার ভান করে অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি করছি।

সবাই জানেন, একজন খেলোয়াড় তার খেলার ক্লাবে সদস্য হবেন, একজন শিল্পী তার নির্দিষ্ট ক্লাবে সদস্য হবেন, একজন আইনজীবী এবং শিক্ষক যদি তাদের পেশাগতভাবে সংশ্লিষ্ট ক্লাবে সদস্য হতে পারেন, তাহলে প্রেসক্লাবে সংবাদকর্মী সদস্য হতে বাধা সৃষ্টি হবে কেন? হ্যাঁ, প্রেসক্লাবেও সদস্য হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন। তবে সমস্যাটা হলো এক শ্রেণীর দালাল এবং আত্মঅহংকারী সাংবাদিকদের নিয়ে। তারা কোনো না কোনোভাবে ক্লাবের সদস্য হয়ে সরকারের দালালি ও চামচামি করে ক্লাবকে তাদের পৈতৃক জমিদারি এস্টেট বানিয়ে বাবুগিরি করছেন। তারা এই ক্লাবের পদ-পদবি ব্যবহার করে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, যা অপ্রিয় হলেও সত্য। এক কথায়, ক্লাব তাদের হাতে জিম্মি।

আজ বৈষম্যের শিকার সংবাদ কর্মীদের প্রশ্ন হলো—আমরা যারা সংবাদপত্রের সাথে জড়িত, কেন আমরা সদস্য হতে পারবো না? এই 'কেন' শব্দের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হাজারো প্রশ্ন চলে আসে। আমরা জানি, কিছু কিছু ক্লাব রয়েছে যা এখনো শোষকদের প্রতিনিধি হয়ে আছে, যেমন চিটাগং ক্লাব। এই ক্লাবটি ইংরেজদের হাতে প্রতিষ্ঠিত; যে ইংরেজ এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি ছিলেন ১৮৭৮ সালে এই দেশে প্রথম চা বাগানের মালিক তিনি হলেন "ডব্লিউ ক্যাম্পারেল" তিনিই এই চিটাগং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই চা বাগানের নাম ছিল গুন্ডু চা বাগান, যার অবস্থান ছিল বর্তমান চিটাগং ক্লাবের স্থানে। সেই স্থান থেকে পুরো দামপাড়ার দিকে বিস্তৃত ছিল এটি। আজ সেই ইংরেজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চিটাগং ক্লাব এখনো ইংরেজদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি, এখনো ইংরেজদের বৈষম্য নীতিতে ক্লাব পরিচালিত হয়।

ঠিক তেমনি, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ১৯৬২ সালে পাকিস্তান আমলে জাতিগত বৈষম্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার বৈষম্যতা এখনো ক্লাব কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে বজায় রেখে চলেছে। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন সাংবাদিক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে কেন? ক্লাবের সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দেন, তারা নাকি মূলধারার সাংবাদিক, আর যারা ক্লাবের সদস্য নন, তারা কোনো সাংবাদিকই নন; তারা স্বৈরাচার সাংবাদিকদের ভাষায় ভুয়া সাংবাদিক।

আমি একটা ৭০০ পৃষ্ঠার গবেষণামূলক বই লিখেছি, “সাংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কথা”। সেই বই লিখতে গিয়ে আমি অন্তত ৩০০টির মতো দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রের উপর লেখা বই পড়েছি। কোন বইতে 'মূলধারার সাংবাদিক' লেখা নেই। শুধু মাত্র অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রী এই 'মূলধারার সাংবাদিক' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যা কিন্তু সংবাদপত্রের বিধিবিধানে উল্লেখ নেই। তাই আমি বলি, মূলধারার বিপরীত শব্দ হলে গুণধারা, যারা ক্লাব সদস্য হয়ে মূলধারা বলেন, যারা সদস্য নন, তারা হলো গুণধারা সাংবাদিক—কারণ তাদের মধ্যে অনেক গুণাগুণ রয়েছে। শিক্ষার সনদের কথা বলা হয়, সাংবাদিকতায় কোনো পাঠ্য শিক্ষার মাপকাঠি নেই। সাংবাদিকতা নির্ভর করে মেধা এবং অভিজ্ঞতার উপর। যার যত মেধা বেশি, তিনি একজন মেধাবী সাংবাদিক; যার যত অভিজ্ঞতা বেশি, তিনি একজন বিজ্ঞ সিনিয়র সাংবাদিক। অনেকেই বলেন, সাংবাদিকতা করতে হলে উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে। আমি বলি, তা সঠিক নয়। একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি কয়টা পাঠ্যবই পড়েছেন? প্রাইমারি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হলে বেশি হলে ৫০০টি পাঠ্যবই পড়েছেন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক সাংবাদিক আছেন যারা কোনোদিন স্কুলের বারান্দায়ও যাননি, অথচ লক্ষ লক্ষ বই পড়েছেন। তাহলে কে বেশি পড়াশোনা করেছেন—নির্দিষ্ট পাঠ্য শিক্ষায় শিক্ষিত নাকি যারা অঢেল বই পড়েছেন?

এখন আরো একটি শব্দ সংযুক্ত করা হয়েছে—অনলাইন সাংবাদিক। অনলাইন সাংবাদিকতা যারা করেন, তারা নাকি কোনো সাংবাদিকই নন! আমি বুঝি না, এই আধুনিক এবং মুক্ত সাংবাদিকতার যুগে তারা কী বলেন? এখন সংবাদপত্র একমাত্র নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ডিজিটাল তথ্য বিনিময়ের উপর। সেইখানে অনলাইন সাংবাদিকতাকে কীভাবে অস্বীকার করা যায়? এখন প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা অনলাইনে আছে। পত্রিকাগুলো টেলিভিশন চ্যানেলের মত ভিডিও সংবাদ যেমন প্রকাশ করে, তেমনি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও ভিডিও সংবাদের পাশাপাশি লেখা সংবাদ প্রচার করে। এখন সবচেয়ে শক্তিশালী হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—গণমাধ্যমকেও হার মানিয়ে দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। সেইখানে অনলাইন সাংবাদিকতা কিভাবে অস্বীকার করা যায়, তা তাদের অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। আবার অনেক জ্ঞানপাপী সাংবাদিকরা বলেন 'হলুদ সাংবাদিকতা'। আমি শুনে হাসি তাদের কথায়। হলুদ সাংবাদিকতা কিন্তু কোনো অপ-সাংবাদিকতা নয়। হলুদ সাংবাদিকতা হচ্ছে মূলধারার বিপরীতে সংবাদ প্রকাশ করা। পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী সাংবাদিকতা হলো হলুদ সাংবাদিকতা এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা।

মনে রাখবেন, সত্যিকারের সাংবাদিকতা করতে হলে কিছু নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হবে। তা আমি সংবাদকর্মীদের অবগতির জন্য তুলে ধরছি-**সংবাদ সম্পর্কে চিরকালীন কিছু কথা বা ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করা যাক, ঘটনা যখন ঘটে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঁকি দেয়। মূলত চারটি প্রশ্ন আমাদের মনকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়: (ক) What - কী হয়েছে বা ঘটেছে?(খ) Where - কোথায় ঘটেছে?
(গ) When - কখন ব্যাপারটা ঘটল?
(ঘ) How - কীভাবে ঘটল?এই চারটি প্রশ্নের উত্তর জানার চাহিদাই মানুষকে সংবাদ সম্পর্কে জানার জন্য তাড়িত করে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
ধরা যাক, দুই বন্ধু একসঙ্গে যাচ্ছিল, তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল। অথবা দুজনের মধ্যে হঠাৎ দেখা হলো। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, "শুনেছিস কি হয়েছে?" অথবা রাস্তায় মানুষের জটলা দেখে পথচলতি কেউ এগিয়ে এসে জানতে চাইল, "ব্যাপারটা কী?" ঘটনা অনেক কিছুই হতে পারে। যেমন, ধরা যাক একটি মারাত্মক রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই এই চারটি প্রশ্নই জাগবে:
কী হয়েছে?(What?)
উত্তর: একটি ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে।কোথায় ঘটেছে? (Where?)
উত্তর: ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে, কুমিল্লায়।
কখন ঘটেছে? (When?) উত্তর: রাত ১০টার দিকে।কীভাবে ঘটেছে? (How?) উত্তর: দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন একই লাইনে চলে আসায় পরস্পরের মধ্যে ধাক্কা লেগেছে/ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে। এই চারটি প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া গেল। দেখা যাচ্ছে, এই দুর্ঘটনার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। বহু মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেকের মধ্যে এর জন্য উদ্বেগ ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, এবং এই ঘটনা বহু মানুষের মনকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। সুতরাং, এটি একটি সংবাদ। আমি একটি মাত্র উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করলাম; আরো অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যাবে, কিন্তু সব উদাহরণের ধরন একই রকম।
সংবাদ করতে হলে এই নিয়মটি কার্যকরভাবে মানতে হবে। সাংবাদিক ও সংবাদ সংগ্রহের মূলনীতি অল্পের মধ্যে শেষ করলাম। এখন যা শিখেছি, তা শিখতে হবে, এই নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি। মনে রাখবেন,অভিজ্ঞতার কথা মানুষকে সবসময় সমৃদ্ধ করে। এই সমৃদ্ধি পাঠক-পাঠিকা বা যিনি লেখক, উভয়ের কাছেই সমানভাবে মহার্ঘ্য। ও শক্তিশালী করতে। তবে
সাংবাদিকতা করতে হলে খোলা মনের মানুষ হতে হবে। আসলে দেখা যায়, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে কিছু সাংবাদিক নামের সাংঘাতিক জিনিস আছে যারা নিজেদের দোষ না দেখে অন্যের দোষ খোঁজে। ক্লাবের বাইরে সাংবাদিকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। অথচ ক্লাব সদস্যদের মধ্যে অসংখ্য সাংবাদিক রয়েছেন, যারা নামসর্বস্ব সাংবাদিক। তাদের একমাত্র পরিচয় তারা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য, কিন্তু তারা কখনো সাংবাদিকতা করেছেন বা কোথায় করেছেন তার উত্তর দিতে হলে পুরানো ডায়েরি খুঁজে বের করতে হবে।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের অচলাবস্থা নিরসনের জন্য বিনয়ের সাথে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখবেন, এখন সব জায়গায় অধিকার আদায়ের জন্য সবাই সোচ্চার হয়েছে, আগের সেই দিন নেই, যখন প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করে অসাধু আচরণ করা হতো। একেবারে শেষে একটি কথা বলে শেষ করছি—প্রেসক্লাবের সদস্য না হলে কি সাংবাদিকতা করা যাবে না? আরো বিস্তারিত লেখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক, এবং মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।

T.A.S / এমএসএম

প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করছে

নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেই কোন সুসংবাদ

বিদায়ী বছরের ইতিবৃত্ত ও নতুন বছরের সূচনা

জলবায়ু সংকট বর্তমান বিশ্বে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ

ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং খাতে চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

জনগণকে সম্পৃক্ত করার উপযুক্ত সময় এখনই

বিজয় দিবস ও এমএজি ওসমানী পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে না থাকা

স্বাধীনতাকে হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে রাখার নাম বিজয়

অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা

অগণতান্ত্রিক শক্তির অপসারণ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

নিরাপত্তার স্বার্থেই ভারতকে উগ্রতা পরিহার করতে হবে

মানব উন্নয়ন শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলের ওপরে নির্ভর করে না

প্রেসিডেন্ট আসাদের পতন ও সিরিয়ার ভবিষ্যৎ