জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে এসেছে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পরই। ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের আগে সেখানে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিলো কয়েকজন উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবারের হাতে। বংশপরম্পরায় তারাই কাশ্মীরিদের শাসন ও শোসন করে এসেছেন। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষই রাজ্যের আসল চালিকাশক্তি। তাদের হাতেই রাজ্যের উন্নয়নের চাবিকাঠি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বেশিরভাগই সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা প্রান্তিক মানুষ। জনপ্রিয়তার নিরিখেই কাশ্মীরে নির্বাচিত হচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা। বিধানসভা ভোটে মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণই বুঝিয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত তাঁদের কতোটা খুশি করেছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনে বিজেপি পরাস্ত হলেও ৩৭০ ধারা বিলোপকে কিন্তু এখন বিরোধীরাও সমর্থন করছেন। জম্মু ও কাশ্মীরের শাসক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাও প্রশংসা করছেন কেন্দ্রীয় সরকারের। বিজেপিকে ‘মুসলিম বিরোধী’ তকমা দেওয়ার বদলে তিনি বলেছেন, 'আমি একজন মুসলিম। একজন ভারতীয়ও। এই দুইয়ের মধ্যে কোনও বিরোধ আমার চোখে ধরা পড়েনি।' তার সাফ কথা, ৩৭০ ধারা রদের পর ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের মানসিক দূরত্ব আরও কমেছে।
কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদও জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ৩৭০ ধারা বিলোপে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক অগ্রগতি হয়েছে। মানুষ খুশি। তিনি বলেছেন, '৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পরে পরবর্তী নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিলেন। আজ রয়েছে কাশ্মীরে নির্বাচিত সরকার।'
জম্মু ও কাশ্মীর বিগত বছরগুলিতে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট জঙ্গিবাদীদের দৌরাত্মে উন্নয়ন ছিল পুরোপুরি স্তব্ধ। প্রতিদিন সেখানে অবাধে চলতো সন্ত্রাস। হরতাল আর সঙ্ঘর্ষ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সেই পরিবেশ থেকে আজ কাশ্মীর অনেকটাই মুক্ত। জঙ্গিবাদীরা আজ আর স্থানীয়দের থেকে সাহায্য পাচ্ছে না। ফলে শান্তির পরিবেশ ফিরে এসেছে ভূস্বর্গে। বাড়ছে পর্যটক। পর্যটন শিল্পের হাত ধরে ফিরে এসেছে কাশ্মীরের হারানো গৌরব।
কাশ্মীরের পর্যটন সংস্থা 'আর্থ এক্সপ্লোরার্স ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস'-এর মালিক আতহার ইয়ামিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পর্যটকদের এতো ভিড় বহুকাল তিনি দেখেননি। তিনি বলেন, '১৯৭৫ সাল থেকে আমরা পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কিছুদিন আগেও আমরা খালি হাতে বসে থাকতাম। এখন পরিস্থিতি সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। কারণ আমরা ট্যুরিস্টদের থাকার জায়গাই দিতে পারছি না। হোটেলগুলিতে রুমই খালি নেই। মারাত্মক ভিড় বাড়ছে।'
শ্রীনগরের ট্রাভেল এজেন্সি 'ওহানা হলিডেজ'-এর কর্ণধার মেহরীন আলী চাট জানিয়েছেন, ভিড় সামলাতে নতুন করে কর্মী নিয়োগ করতে হচ্ছে তাঁকে।
কাশ্মীর সৌন্দর্যের পাশাপাশি ধর্মীয় কারণেও পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। জঙ্গি সমস্যা আর কোভিডের দুঃসময় কাটিয়ে পর্যটকদের ভূ-স্বর্গ স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় পর্যটকদের জন্য বহুবিধ সুবিধা করে দিয়েছেন। এবার অমরনাথ যাত্রায় ১০ লাখেরও বেশি ধর্মীয় পর্যটক দক্ষিণ কাশ্মীরের বিখ্যাত বরফের শিবলিঙ্গ দর্শন করছেন। স্থানীয় গাড়ি ব্যবসায়ী গুলজার আহমেদ পর্যটন শিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলেন, 'প্রচুর পর্যটক আসছেন। খুব ভালো লাগছে। ব্যবসাও বাড়ছে।'
৩৭০ ধারা বাতিলের পর একজনও পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে প্রাণ হারাননি। পাথর ছোঁড়ার ঘটনাও প্রায় বন্ধ। কাশ্মীরের নিরাপত্তা এখন সরাসরি দিল্লির অধীনে থাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রভাব এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে পাকিস্তানি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও সফল হচ্ছে না। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ বলেছেন, '১৯৪৭ সাল থেকে আমরা কাশ্মীরে ভূয়া স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে এসেছি। কিন্তু আসল নর্মালসি এখনই বিরাজ করছে করছে কাশ্মীর উপত্যকায়।' স্থানীয়রা বুঝেছেন, শান্তিই পারে তাদের রোজগারের পথ দেখাতে। নিজেদের আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থেই কাশ্মীরিরাও ৩৭০ ধারা বিলোপের সমর্থকে পরিণত হয়েছেন আজ। ভারতের মূলস্রোতে ফিরে এসেছেন কাশ্মীরি যুবকরাও। স্থানীয় যুবকরা জঙ্গিবাদীদের মদদ দেওয়ার বদলে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিই তাদের আস্থার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
জম্মু উপত্যকার প্রায় ১০ লাখ মানুষ এতোকাল নাগরিকত্ব পাননি।ভারতের জাতীয় সংসদের তৈরি করা ৮০ শতাংশ আইনই কার্যকর করা যেতো না সেখানে। নেতারা ক্ষমতা ভোগ করলেও সাধারণ মানুষ ছিলেন সরকারি সুবিধা বঞ্চিতদের দলে। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা ছিল উচ্চবংশীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের হাতে। রাজ্যের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন নিয়ে তাঁদের কোনও চেষ্টা ছিলো না। ক্ষমতার লোভে উপত্যকার মানুষকে নেতারা ভোটে জেতার কাজেই শুধু ব্যবহার করতেন। ২০ লাখেরও বেশি অ-কাশ্মীরি মুসলিম, গুজ্জর যাযাবর ও বাকরওয়ালদের সঙ্গে কিছু অভিজাত পরিবারের প্রতিনিধি এই নেতারা শুধু দুর্নীতি, অসৎ-আচরণ, স্বজনপোষণের মাধ্যমে বঞ্চিতই করে রেখেছিলেন সাধারণ মুসলিমদের। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর গ্রামাঞ্চলে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয় ভোট। গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটে জনসাধারণ উতসবের মেজাজে অংশ নেন। তাঁরা নির্বাচিত করেন নিজেদের এলাকার জনপ্রতিনিধিকে। তারা বুঝিয়ে দেন, হরতাল বা অবরোধের রাজনীতি ভুলতে বসেছে গোটা উপত্যকা।
৩৭০ ধারা বিলোপের পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, কাশ্মীরে ফের শুরু হবে অবাধ রক্তপাত। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, গত দু দশকের মধ্যে এখন সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ সময় কাটাচ্ছে কাশ্মীর উপত্যকা। এরই মধ্যে নির্বিঘ্নে হয়েছে বিধানসভার নির্বাচনও। ভোটারদের অংশগ্রহণের হার ছিল অতীতের থেকে অনেক বেশি। যুবকদের অংশগ্রহণ ও উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৯ থেকেই বেশ স্বাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। স্থানীয়রাই ওড়াচ্ছেন ভারতের জাতীয় পতাকা।
সাধারণ মানুষের হাতেই রয়েছে কাশ্মীরের উন্নয়নের ভার। তৃণমূলস্তর থেকেই সাধারণ মানুষ এখন রাজ্যের উন্নয়নের মূল কাণ্ডারী। পারিবারিক শাসনের দিন প্রায় শেষ। তাই এখন কাশ্মীরে ভোট হয় উৎসবের মেজাজে। কাশ্মীরিরাই নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই রচনা করেন। নিরাপত্তা বাহিনীর নিশ্ছিদ্র প্রহরায় নির্বাচনের নামে প্রহসনের দিন এখন অতীত। তাই প্রথম দিকে অনেকে বিরোধিতা করলেও স্থানীয় মানুষ মনেপ্রাণে স্বাগত জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্ধযুগ আগে নেওয়া ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে। মানুষের মনের ভাষা পড়তে পেরে ভারতীয় রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষও এখন গুণগান করছেন ৩৭০ ধারা বিলোপের।
জিয়াউর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক ও গবেষক।
এমএসএম / এমএসএম

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া

মানবিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস ২০২৫ : গল্পের মাধ্যমে গড়ে উঠুক সচেতনতার বাঁধ

রাজনীতি আজ নিলামের হাট: কুষ্টিয়া-৪ এ হাইব্রিড দাপটের নির্মম প্রতিচ্ছবি

জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দিবে প্রবাসীরা, আনন্দে ভাসছে পরবাসে বাঙালীরা

বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা ও বাংলাদেশে তার প্রভাব

বাংলাদেশে ওয়াশিং প্ল্যান্টের বর্জ্য দ্বারা মিঠাপানির দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে

বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ
