গ্রামীণ ঐতিহ্য ও শীত কালীন রসদ সুমিষ্ঠ খেজুর রস
যারা গ্রামে বড় হয়েছে, তাদের কাছে খেজুর রস এক অনুভূতি ও আবেগের বিষয়। শীতকালে আনেকেরই অনেক সময় ঘুম ভাঙতো ভারযষ্টিতে মাটির কলসি ভরে নিয়ে আসা খেজুর রস, আর ডাক দিতো এই রস লাগবে রস! আনেকেই দৌড়ে যেত খেজুর রস খেতে। বর্তমানের তুলনায় একটা সময় শীতের তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। তীব্র শীতে ও ঘন কুয়াশায় ঠান্ডা খেজুর রস খেয়ে অনেকেই মারি কাপিয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতো।
খেজুর রস যদিও আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের প্রথমার্ধে (অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি) পর্যন্ত পাওয়া গেলেও খেজেুরে রস বেশি শীতে বা ঘন কুয়াশার মধ্যেই খেতে বেশি ভালো লাগে। শীতকাল আসলে সেই খেজুর রসের স্বাদ অনেকের মনকে আনমনেই নাড়া দিয়ে যায়। মনে পরে যায়, মায়ের হাতে বানানো খেজুরের রস দিয়ে দুধ পিঠা, পায়েস তৈরি ও মাঝে মাঝে চুলায় জাল করে ঝোলা গুড়ের মত কিছু একটা বানানোর চেষ্টা, যা আরেক অনুভূতি ও আবেগ জড়িত বিষয়। অনেকের মনে হলেই স্মৃতির পাতায় হাতরায় সেই খেজুর রস। তাইতো শীত আসলেই খেজুর রস খুঁজে ফিরে অনেকে।
যারা ঢাকা বা শহরে বসবাস করেন তাদের হয়তো আসল খেজুর রস পেলেও আসল ঘ্রাণ সমৃদ্ধ সুমিষ্ঠ খেজুর রস পাওয়ার কথা নয়। আসল ঘ্রাণ সমৃদ্ধ সুস্বাদু মিষ্টি খেজুর রস পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই গ্রামে ফিরে যেতে হবে। গ্রামেও যে বাণিজ্যিক ভাবে খেজুর বাগানের চাষ হয় ব্যাপারটা এমন নয়। খেজুর গাছ প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্ম নেয় বলেই খেজুর গাছ সাধারণত পতিত অনুর্বর জমিতে, জলাশয়ের ধারে, বাঁধের বা পুকুর পাড়ে, জমির আইলে (জমির ফসলের তেমন ক্ষতি করে না), বাড়ি ও বাগানের চারদিকে, পথের দুই পাশে সারি করে খেজুর গাছ লাগানো হয়। আমাদের দেশে ফলের জন্য নয়, রসের জন্যই চাষ করা হয় খেজুর গাছ। শীতের দিনে খেজুর রসের স্বাদ সবার কাছেই লোভনীয়।
খেজুর যেহেতু অন্যান্য ফসলের মতো ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় না, বসতবাড়ি, মাঠ, পথের ধারে জন্মে। তাই বাংলাদেশে ঠিক কতটুকু জমিতে খেজুরের আবাদ হচ্ছে তার হিসাব কষা মুশকিল। তবে, বিগত ২০১৬-১৭ সালে এ দেশে মোট খেজুর রসের উৎপাদন ছিল ১ লক্ষ ৬৯ হাজার ৫৬ টন। মোট ৫ হাজার ১৩২ একর জমির খেজুর গাছ থেকে তা আহরিত হয়েছিল বলে নিরূপিত হয়েছে। একই বছরে দেশে খেজুরের উৎপাদন ছিল ৩৮ হাজার ৯৩৯ টন (বিবিএস ২০১৮)। সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ আছে রাজশাহী, নাটোর ও যশোরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশি খেজুরের চাষ সম্প্রসারণে ইতোমধ্যে একটি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে (তথ্য সংগ্রহ, কৃষি তথ্য সার্ভিস)।
তবে এই খেজুর রস সংগ্রহ অনেকটা কষ্ট সাধ্য এবং তা থেকে খেজুর গুড় তৈরি আরো কঠিন। এমনই বর্ণনা করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্রের “রস” নামক রসালো ছোটগল্পে। যেখানে মোতালেফ মিঞা ঘরে স্ত্রী মাজু খাতুন থাকা সত্বেও প্রেম সাগরে হবুডুবু খায় ফুলবানুর সঙ্গে। মাজু খাতুনের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর ঘরে আনে ফুলবানুকে। যেখানে মোতালেব মিঞার প্রেমের অন্ত ছিল না, মোতালেফের প্রেমে রোমান্টিকতায় ভরপুর ছিলো, তবুও ফুলবানু খেজুর রস হতে ভালো গুড় তৈরি করতে না পারায়, সে প্রেম বিষাদের রূপনেয়।
বগুড়া শহরের বারপুর হতে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে শিকারপুর গ্রামে খেজুর গাছে কাজ করছে গাছি ওমর ফারুক ও দবির উদ্দিন, কথা হয় তাদের সাথে। খেজুর গাছে উঠতে গিয়ে আহত হন এবং সেই পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়েই কাজ করছেন ওমর ফারুক। তারা রাজশাহী জেলার বাঘা হতে এসে এই শিকারপুর গ্রামে প্রায় ৮০ টি খেজুর গাছ ইজারা নেয়। ৪০ টি গাছ থেকে তারা প্রতিদিন প্রায় ১০০ কেজি রস সংগ্রহ করেন। যার অর্ধেকটাই যায় গাছ মালিকের কাছে। তারা বর্ণনা করেন খেজুর রস সংগ্রহের পদ্ধতি, প্রতিদিন মোট গাছের অর্ধেক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন বাকি অর্ধেক শুকানোর জন্য রেখে দেন, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে খেজুর গাছের মাথার অংশকে প্রথমে ভালো করে পরিষ্কার করা হয়। এরপর পরিষ্কার সাদা অংশ কেটে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় কলসিতে রস সংগ্রহ করা হয়। শীতের মৌসুমে প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে গাছের মাথার হাড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সকাল হলে সেই হাড়ি নামিয়ে আনা হয়। গাছিরা যে হাড়ি ঝুলিয়ে রাখে তাতে অনেক সময় বাদুর সহ কীট পতঙ্গ প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর রসে পরিণত করতে পারে। যা থেকে প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাস হতে পারে। তবে অনেক গাছি সর্তকতা মূলক ব্যবস্থা হিসেবে জাল দিয়ে থাকে। মাঝে একটু রিষ্ক বা ঝুকি থাকলেও বর্তমানে গাছিদের সর্তকতার জন্য খেজুর রস অনেকটা নিরাপদ বলেই মনে হয়। তাই গ্রামে এসে নি:সন্দেহে পান করতে পারেন সুস্বাদু সুমিষ্ঠ খেজুর রস।
মো: আকতার হোসাইর, ব্যাংকার ও কলামিষ্ট
এমএসএম / এমএসএম
বৈষম্য ও দারিদ্র্য কমাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়
গ্রামীণ ঐতিহ্য ও শীত কালীন রসদ সুমিষ্ঠ খেজুর রস
প্রতিশোধের রাজনীতি জাতির জন্য এক অভিশাপ
জলবায়ু সম্মেলন ও বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী
দেশ ও দল পরিচালনায় একই ব্যক্তি নয়
৭ নভেম্বর: “সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিপ্লব ও বাংলাদেশের নবজাগরণ”
নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতা মোটেও কাম্য নয়
সৎ মানুষ অন্যায়ের প্রতিপক্ষ
নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হোক
নাগরিক সমাজ ও মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার
গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন জিয়াউর রহমান
নাগরিক সচেতন হলে রাজা নীতিবান হতে বাধ্য