ঢাকা বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

নাগরিক সচেতন হলে রাজা নীতিবান হতে বাধ্য


এসএম পিন্টু photo এসএম পিন্টু
প্রকাশিত: ২৭-১০-২০২৫ দুপুর ১২:৭

একটি রাষ্ট্রের উন্নতি নির্ভর করে তার শাসকের নীতি ও জনগণের সচেতনতার ওপর। রাজা দুর্নীতিপরায়ণ হলেও জনগণ যদি সচেতন হন তবে রাজাও নীতিবান হতে বাধ্য হবেন। তা না হলে রাজার পতন নিশ্চিত। আবার রাজা বা সরকার যতই ভালো নীতি গ্রহণ করুক না কেন, যদি জনগণ সেই নীতি সম্পর্কে উদাসীন থাকে, তবে সেই নীতি কখনোই সফল হতে পারে না। তাই প্রতিটি নাগরিকই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া উচিৎ। শিক্ষা মানুষকে শুধু পণ্ডিতই বানায় না, সচেতন নাগরিক হিসেবেও গড়ে তোলে। তাই “রাজার নীতি ঠিক রাখতে সচেতন নাগরিক হওয়াটা জরুরী। শুধু রাজনৈতিক নয়, শিক্ষাব্যবস্থারও আমুল পরিবর্তণের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। 
নীতিনিষ্ঠ শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা: 
শাসক বা রাজা হলো রাষ্ট্রযন্ত্রের চালক। তার নীতি-আদর্শই সমাজের দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু একটি নীতি তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন জনগণ সেই নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, বুঝে এবং প্রয়োগ করে। নীতিনিষ্ঠ রাজা জনগণের মঙ্গল চান, আর সচেতন নাগরিক সেই নীতি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন। রাষ্ট্র হলো একটি জীবন্ত সংগঠন, যার আত্মা হলো জনগণ এবং দেহ হলো প্রশাসন। রাজা বা সরকার সেই দেহের চালক, কিন্তু চালক কখনোই একা সঠিক পথে চলতে পারে না যদি যাত্রীগণ নিস্ক্রিয় বা দায়িত্বহীন হয়। একথা প্রাচীনকাল থেকেই বলা হয়ে আসছে, “জনগণ যেমন, শাসক তেমনই হয়।”
একজন রাজা যতই নীতিবান, ন্যায়পরায়ণ বা মানবিক হোন না কেন, যদি জনগণ উদাসীন, দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বার্থান্বেষী হয়, তবে তাঁর নীতি টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। আবার উল্টোভাবে বলা যায়, যখন জনগণ শিক্ষিত, নৈতিক ও সচেতন, তখন রাজা বা সরকার বাধ্য হয় নীতিনিষ্ঠ হতে।
রাজা বা শাসকের নীতির সংজ্ঞা ও গুরুত্ব:
রাজার নীতি বলতে আমরা বুঝি রাষ্ট্র পরিচালনার সেই নৈতিক, ন্যায়সংগত ও মানবিক ধারা যা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে। এটি কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং নৈতিক দর্শনের প্রতিফলন।
একজন ভালো শাসকের তিনটি মৌলিক গুণ থাকা জরুরি, তা হলো,  সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও জনকল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। এই তিনটি গুণ থাকলে তিনি নিজেই রাষ্ট্রের সম্পদ আর না থাকলে তিনি রাষেট্রর বোঝা। যদি গুণগুলেঅ থাকে তবে সেই শাসক রাষ্ট্রের সম্পদ বা ক্ষমতা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করবে না, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ বা দলের উর্ধ্বে থেকে বিচার করবে আর ক্ষমতাকে প্রভাবের হাতিয়ার না ভেবে সেবার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। ফলে সেই জাতির এগিয়ে যাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না কেউ। 
কিন্তু এই নীতিগুলো কার্যকর করতে হলে জনগণকেও সেই নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া কোনো রাজা বা সরকার কখনো সফল হয় না।
সচেতন নাগরিকের অর্থ ও প্রয়োজনীয়তা:
সচেতন নাগরিক মানে শুধু পড়াশোনা জানা মানুষ নয়, বরং এমন ব্যক্তি, যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য দুটোই বোঝেন। একজন সচেতন নাগরিক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজের সম্পদ হিসেবে রক্ষা করেন, সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেন। সচেতন নাগরিকদের উপস্থিতিতেই একটি রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়। তারা রাজার ভুল নীতি চিহ্নিত করে সঠিক পথে ফেরাতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই জনগণের প্রকৃত শক্তি।

শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিক চেতনার বিকাশ:
শিক্ষা মানুষের মধ্যে চেতনা সৃষ্টি করে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ বুঝতে শেখে, রাষ্ট্র আমার, আইন আমার, সমাজ আমার। একটি সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা নাগরিকদের, নৈতিকতা শেখায়, দায়িত্ববোধ গড়ে তোলে, অন্যের অধিকারকে সম্মান করতে শেখায়, গঠনমূলক সমালোচনা ও চিন্তার বিকাশ ঘটায়।

শিক্ষা ছাড়া সচেতন নাগরিক গড়া সম্ভব নয়। বিদ্যালয়ে যদি সততা, মানবতা ও দায়িত্ববোধ শেখানো হয়, তাহলে ভবিষ্যতের নাগরিকরাই রাজাকে সৎ পথে রাখবে।
ইতিহাসে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকের ভূমিকা:
ইতিহাসে দেখা যায়, জনগণ সচেতন থাকলে রাজারা ভালো পথে থেকেছেন, আর জনগণ উদাসীন হলে রাজারা অত্যাচারী হয়েছেন। প্রাচীন এথেন্স শহর ছিল শিক্ষিত নাগরিকদের গণতন্ত্রের প্রতীক। জনগণের সচেতনতা সেখানে রাজনীতিকে ন্যায়ের পথে রেখেছিল। সম্রাট অশোক জনগণের মানবিকতার চাপে যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে “ধর্মনীতি” গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সচেতন নাগরিকদের সংগ্রাম, তারা অন্যায়ের শাসন মানেনি, রাজার নীতি বদলে দিয়েছে স্বাধীনতার নীতিতে।
নাগরিক উদাসীনতা ও রাষ্ট্রের অবক্ষয়:
যখন জনগণ নিজের দায়িত্ব ভুলে যায়, তখন রাজার নীতি ভেঙে পড়ে। ভোটের সময় টাকার বিনিময়ে ভোট বিক্রি করা, সৎ মানুষকে ভোট না দেওয়া, অন্যায়ের প্রতিবাদে নীরব থাকা, ঘুষ ও দুর্নীতিকে সহ্য করা, আইনের প্রতি অবজ্ঞা করা, এই আচরণগুলো সমাজে নৈতিক পতন ঘটায়।

ফলাফল হিসেবে রাজনীতিতে আসে সুবিধাবাদী মানুষ, নীতির জায়গা দখল করে স্বার্থ। তখন রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য, জনকল্যাণ, হারিয়ে যায়।
শিক্ষার মাধ্যমে সচেতন নাগরিক গঠনের করণীয়:
সুশিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হলে, নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, শুধু পরীক্ষার পড়া নয়, নৈতিক শিক্ষারশুরু করতে হবে পরিবার থেকেই। বিদ্যালয়ে একাডেমিক সনদের পাশাপাশি চরিত্র গঠনের শিক্ষা জরুরি। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাগরিক দায়িত্ব, মানবাধিকার ও আইনের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। একজন সৎ শিক্ষক শত বইয়ের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। শিক্ষকই সু নাগরিকতার বীজ রোপণ করেন। নাগরিক সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যম যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও সামাজিক মাধ্যম শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। তরুণদের রাজনীতি ও সমাজসেবায় যুক্ত করলে তারা সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে রাজনীতি শেখার আগে যেন নিজের আখের গোছানো না শিখে।
আধুনিক যুগে সচেতন নাগরিকের চ্যালেঞ্জ:
আধুনিক যুগে সচেতন নাগরিক হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের রোষানল থেকে নিরাপদ থাকা। সত্য কথা বললে তাকে প্রতিপক্ষ মনে করা আমাদের রাজনৈতিক কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সচেতন নাগরিকরা এখন অনেক কিছু দেখেও প্রতিবাদ করতে চান না। ভুল ধরে দিলেও এখন অনেকে শত্রু মনে করেন তাই ভুল দেখেও অনেকের মাঝে এড়িয়ে যাওয়া প্রবণতা দেখা যায়। ফলে ভুলটা ভুলই থেকে যায় একটা সময় এটা সমাজ বা দেশের জন্য একেকটি ভয়ঙ্কর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটা সমাজের ক্যান্সারে পরিনত হয়।  আবার ডিজিটাল যুগে তথ্যের প্রাচুর্য যেমন নাগরিকদের জ্ঞান দেয়, তেমনি ভুয়া খবর বিভ্রান্তিও বাড়ায়। তাই আজকের নাগরিকদের সচেতনতার নতুন মাত্রা দরকার, তথ্য যাচাই করার ক্ষমতা, সঠিক মতামত গঠন, গুজব ও বিভ্রান্তি প্রতিরোধের জ্ঞান থাকা দরকার। এগুলোও শিক্ষার অংশ হওয়া উচিত, যাতে নাগরিক, শাসক বা তাদের কথিত সমর্থকরা ভুল পথে না যায়।

গণতন্ত্র ও সচেতন নাগরিকের সংযোগ:
গণতন্ত্র কেবল ভোট দেওয়ার অধিকার নয়, বরং ন্যায়, সমতা ও অংশগ্রহণের একটি সংস্কৃতি। একজন সচেতন নাগরিক, ভোটের সময় নীতিনিষ্ঠ প্রার্থী বেছে নেয়, নির্বাচনের পরও সরকারের কাজ পর্যবেক্ষণ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করে। গণতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন নাগরিকরা রাজাকে জবাবদিহির মধ্যে রাখে। আর রাজা যদি সেটিকে প্রতিপক্ষ মনে করে দমন নীতি ফলো করে তখন জাতির অধপতন নিশ্চিত।
উপসংহার:
রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি কোনো সেনাবাহিনী বা সম্পদ নয়, বরং জনগণের নৈতিকতা ও সচেতনতা। একজন রাজা যদি ন্যায়ের পথে থাকেন, আর জনগণ যদি সচেতন থাকে, তবে রাষ্ট্র অগ্রগতি, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। শিক্ষিত নাগরিক সমাজই রাজার নীতির রক্ষক। তাই শিক্ষা, নৈতিকতা ও সচেতনতার সমন্বয়েই গড়ে ওঠে ন্যায়ের সমাজ। তবে যে শিক্ষা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ বয়ে আনে তা বর্জন করা উচিৎ।
অতএব বলা যায়, “রাজার নীতি ঠিক রাখতে সচেতন নাগরিকই হলো রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিক্ষা সেই নাগরিক তৈরি করে, আর সেই নাগরিকই রাখে রাজার নীতি অটুট।” 
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।

 

এমএসএম / এমএসএম

নাগরিক সচেতন হলে রাজা নীতিবান হতে বাধ্য

নাগরিক ভোগান্তি রোধে দরকার পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস ও জনসচেতনতা

জাতিসংঘের ব্যর্থতা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব

রাজনীতিতে রাজা আছে, নীতি নাই

গণতন্ত্রে উত্তরণে তারেক রহমানের যত চ্যালেঞ্জ

তুরস্কের প্রত্যাবর্তন: মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নতুন সম্ভাবনা

জীবনের জয়গানে সড়ক হোক মুখরিত

এক ভয়ংকর সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

জয় হোক বিশ্ব মানবতার

আলোর উৎসব দীপাবলি :শান্তি ও সম্প্রীতির জয়গান

কর্পোরেট দুনিয়ায় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিলুপ্তির সম্ভাবনা: প্রযুক্তির ঝড়, না কি মানবিক পুনর্জাগরণ?

জুলাই সনদ স্বাক্ষর হলো, সংশয় কি কাটলো

পুলিশ - সাংবাদিক দূরত্ব কাম্য নয়