নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হোক
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে জনগণের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সময়ে নির্বাচনের অন্যতম বড় ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে নমিনেশন/মনোনয়ন বাণিজ্য। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা, জনপ্রিয়তা, ত্যাগ, সততা বা নেতৃত্বের ক্ষমতার পরিবর্তে টাকার প্রভাব প্রাধান্য পাচ্ছে। যে বেশি টাকা দিতে পারে, সে-ই পাচ্ছে মনোনয়ন; যে সততা ও আদর্শের রাজনীতি করে, তার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু রাজনীতিকে কলুষিত করছে না, বরং গোটা জাতির নৈতিক ভিত্তিকেও ক্ষয় করছে। যদি টাকার কাছে নীতি নৈতিকতা বিক্রি না করে ভালো মানুষের সন্ধান করা হয় তবে সমাজে খারাপ মানুষের বিস্তার রোধ করা যাবে। আর ভালো মানুষেরা রাজনীতির মাঠে থাকলে সকল অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে, ঘুষ নেয়ার মতো কাউকে খুজে পাওয়া যাবে না। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারলে দেশের উন্নয়ন কেউ ঠেকাতে পারবে না। অর্থাৎ দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং সুন্দর আগামী গঠনের জন্য নেতৃত্ব বাছাইয়ে নৈতিক চরিত্রকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। শুরুটা যদি নির্ভুল হয় তাহলে সমাপ্তিতেও প্রশান্তি থাকবে।
নমিনেশন বাণিজ্যের ভয়াবহ বাস্তবতা:
নমিনেশন বাণিজ্য বলতে মূলত বোঝায়, রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে প্রার্থী নির্ধারণ করা। এটি একধরনের অঘোষিত দুর্নীতি, যা রাজনীতির সব স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের অনেক নির্বাচনে দেখা যায়, যোগ্য নেতা, দীর্ঘদিনের ত্যাগী কর্মী কিংবা জনপ্রিয় সমাজসেবকের চেয়ে অর্থশালী ব্যবসায়ী বা বিত্তশালী ব্যক্তি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যায়। কারণ, তারা দলের উচ্চপর্যায়ে বিশাল অঙ্কের টাকা দিতে পারে, কখনো দান হিসেবে, কখনো প্রচার তহবিল হিসেবে, আবার কখনো ‘অভ্যন্তরীণ চুক্তি’র মাধ্যমে।
এই সংস্কৃতি শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, এমনকি ছাত্র সংগঠনের পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে রাজনীতির প্রতিটি ধাপেই টাকার প্রভাব নির্ণায়ক হয়ে উঠছে।
টাকার প্রভাবের কারণ: একটি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য টাকা দরকার। আবার সেই টাকা অনেক সময় বিপদও ডেকে আনে। যেমন,
১. দলের তহবিল ঘাটতি:
রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই নির্বাচনী তহবিল সংকটে পড়ে। ফলে তারা বিত্তশালীদের কাছ থেকে সহায়তা নিতে বাধ্য হয়। এভাবেই শুরু হয় নমিনেশন বাণিজ্যের দুষ্টচক্র।
২. দলীয় নেতৃত্বের নৈতিক অবক্ষয়:
যখন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নিজেরা অর্থলোভে জড়িয়ে পড়েন, তখন নিচের স্তরেও দুর্নীতি বৈধতা পায়। নৈতিকতা হারায়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির অভাব:
বাংলাদেশে কোনো দলীয় প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি বা অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই। ফলে সিদ্ধান্ত হয় গোপনে, অর্থের বিনিময়ে।
৪. জনপ্রতিনিধিত্বের ধারণার বিকৃতি:
অনেকে রাজনীতিকে এখন সমাজসেবা নয়, বরং ব্যবসা মনে করে। তারা মনে করে, টাকা খরচ করে মনোনয়ন নিলে পরে সেই টাকা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে আসলে উদ্ধার করা যাবে।
৫. আইন প্রয়োগের দুর্বলতা:
নির্বাচন কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো কার্যকর নজরদারি নেই, ফলে এই টাকার খেলা অনায়াসে চলতে থাকে।
নমিনেশন বাণিজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি: নমিনেশন বাণিজ্যের ফলে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতি হয়। যেমন:
১. ভালো মানুষের রাজনীতি থেকে বিদায়:
যারা ত্যাগী, সৎ, আদর্শবান এবং জনগণের জন্য কাজ করেন, তাদের সাধারণত এত টাকা থাকে না। ফলে তারা মনোনয়ন পায় না। এতে রাজনীতিতে যোগ্য নেতৃত্বের ঘাটতি তৈরি হয়।
২. রাজনৈতিক কর্মীদের হতাশা:
দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করা তৃণমূল কর্মীরা যখন দেখে টাকার কারণে অপরিচিত কেউ নমিনেশন পেয়ে যায়, তখন তাদের মনোবল ভেঙে যায়। কর্মীদের রাজনৈতিক বিশ্বাস নষ্ট হয়।
৩. দুর্নীতির চক্র বিস্তার:
যে টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনে, সে নির্বাচনে আরও বেশি টাকা খরচ করে জেতার চেষ্টা করে। আর নির্বাচিত হলে সেই টাকা ঘুষ, কমিশন, বা সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে তুলে নেয়।
৪. জনগণের আস্থাহানি:
জনগণ যখন দেখে যে টাকার বিনিময়ে প্রার্থী নির্ধারিত হচ্ছে, তখন তাদের মনে রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়। তারা বিশ্বাস হারায়, ভালো মানুষ কখনও নির্বাচিত হবে না।
৫. গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়:
নমিনেশন বাণিজ্য গণতন্ত্রের আত্মাকে হত্যা করে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন হওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে টাকা হয়ে যায় আসল চালিকাশক্তি।
ইতিহাসের আলোকে মনোনয়ন প্রক্রিয়া:
গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় সদস্যদের ভোট বা স্থানীয় পর্যায়ের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণ হয় স্থানীয় সদস্যদের ভোটে। ভারতে অনেক বড় দলেও অভ্যন্তরীণ যাচাই-বাছাই ও জরিপের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়। আমেরিকায় প্রাইমারি নির্বাচন হয়, যেখানে জনগণই নির্ধারণ করে কে হবে দলের প্রার্থী।
কিন্তু বাংলাদেশে এই পদ্ধতি অনুপস্থিত। এখানে মনোনয়ন প্রায় সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীভূত, দলীয় প্রধান বা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে। ফলে অর্থবিত্তবানদের সুযোগ বেশি থাকে।
মনোনয়ন বাণিজ্যের অর্থনৈতিক দিক:
একজন প্রার্থী মনোনয়ন পেতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন, কখনো সরাসরি, কখনো গোপনে। এই অর্থ আসে ব্যবসা, শিল্প, বিদেশি বিনিয়োগ, কিংবা অবৈধ উপায়ে। ফলে রাজনীতি হয়ে ওঠে ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্র’। মনোনয়ন মানে একধরনের ‘পুঁজি বিনিয়োগ’, যার লাভ তোলা হয় ক্ষমতায় গিয়ে। এভাবেই রাজনীতি হারায় জনকল্যাণের চরিত্র; হয়ে ওঠে ‘দুর্নীতির ব্যবসা’।
নৈতিকতা ও নেতৃত্বের সংকট:
যখন রাজনীতিতে প্রবেশের পথ টাকায় নির্ধারিত হয়, তখন সমাজের সৎ, নৈতিক, আদর্শবান, দেশপ্রেমিক মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায়। ফলে নেতৃত্বের জায়গা দখল করে নেয় সুবিধাবাদী, চাটুকার, ও অপরাধচক্রের লোকজন। তারা জনগণের সেবা নয়, বরং নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক আধিপত্য রক্ষা করে। ফলস্বরূপ রাজনীতি তার মূল লক্ষ্য, “জনগণের কল্যাণ” থেকে বিচ্যুত হয়।
জাতির উপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব:
নমিনেশন বাণিজ্য শুধু রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নয়, রাষ্ট্রীয় নীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে। যে প্রার্থী টাকায় মনোনয়ন কেনে, সে নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে হাত দেয়। এতে দুর্নীতি বাড়ে, প্রশাসনিক সৎ কর্মকর্তা নিরুৎসাহিত হন, এবং সমাজে ঘুষ সংস্কৃতি বেড়ে যায়। ফলে একসময় সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রই পচে যায়, যা কোনো জাতির জন্য ভয়ংকর সংকেত।
ভালো মানুষের অবমূল্যায়ন ও পরিণতি:
যখন একজন সৎ নেতা মনোনয়ন না পেয়ে অবহেলিত হন, তখন তার কর্মীরাও নিরুৎসাহিত হয়। একজন আদর্শবান কর্মী মনে করেন, ”সততা দিয়ে কোনো লাভ নেই, টাকা থাকলেই সফল হওয়া যায়।” এই মনোভাবই সমাজে হতাশা সৃষ্টি করে এবং রাজনীতি থেকে ভালো মানুষের প্রস্থান ঘটায়। অন্যদিকে, টাকার জোরে উঠে আসা রাজনীতিবিদরা দুর্নীতির উৎসবে মেতে ওঠে, জাতি হারায় নৈতিক নেতৃত্ব।
সমাধানের পথ:
১. দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করা:
দলীয় সদস্যদের ভোট বা জরিপের মাধ্যমে প্রার্থী নির্ধারণ করতে হবে। এতে টাকার প্রভাব কমবে।
২. মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা:
দলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে মনোনয়ন প্রক্রিয়ার হিসাব প্রকাশ করতে হবে।
৩. আইনি পদক্ষেপ:
নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দিতে হবে যেন তারা দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়া তদারকি করতে পারে।
৪. দলীয় তহবিল ব্যবস্থার সংস্কার:
দলগুলোর তহবিলের জন্য সরকারি অনুদান বা বৈধ উৎস থাকতে হবে, যাতে অর্থসংকটে তারা বিত্তশালীদের উপর নির্ভর না করে।
৫. গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা:
নমিনেশন বাণিজ্যের তথ্য প্রকাশে স্বাধীন মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
৬. রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার:
নাগরিকদের সচেতন হতে হবে যে রাজনীতি ব্যবসা নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যম।
নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব:
নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিতে আসতে হবে নৈতিকতা, আদর্শ ও সেবার মনোভাব নিয়ে। তারা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবে টাকার রাজনীতি ভাঙবে।
তরুণদের উচিত, নমিনেশন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, যোগ্য নেতৃত্বকে সমর্থন দেওয়া, এবং সৎ রাজনীতিবিদদের পাশে দাঁড়ানো।
উপসংহার:
নির্বাচনে নমিনেশনে টাকার খেলা জাতির জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। এটি শুধু রাজনীতির অবক্ষয় নয়, নৈতিকতার মৃত্যুও বটে। যখন যোগ্য মানুষ বঞ্চিত হয়, আর টাকা দিয়ে সুযোগ পাওয়া যায়, তখন সমাজে অন্যায় প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়। সৎ মানুষের প্রস্থান ঘটে, রাজনীতি হারায় আদর্শ, আর দেশ হারায় উন্নয়নের গতি। তাই এখনই সময়, দলীয় নমিনেশনে টাকার প্রভাব বন্ধ করার।
রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে জনগণের কাছে, আদর্শের কাছে, সততার কাছে। কারণ, রাজনীতি যদি বিক্রি হয়, তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্মও বিক্রি হয়ে যাবে। এই বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের প্রত্যেককেই বলতে হবে, “টাকার রাজনীতি নয়, যোগ্যতার রাজনীতি চাই।” “নমিনেশনে টাকার খেলা বন্ধ হোক, গণতন্ত্র বাঁচুক।”
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সভাপতি রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।
এমএসএম / এমএসএম
৭ নভেম্বর: “সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিপ্লব ও বাংলাদেশের নবজাগরণ”
নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতা মোটেও কাম্য নয়
সৎ মানুষ অন্যায়ের প্রতিপক্ষ
নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হোক
নাগরিক সমাজ ও মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার
গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন জিয়াউর রহমান
নাগরিক সচেতন হলে রাজা নীতিবান হতে বাধ্য
নাগরিক ভোগান্তি রোধে দরকার পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস ও জনসচেতনতা
জাতিসংঘের ব্যর্থতা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব
রাজনীতিতে রাজা আছে, নীতি নাই
গণতন্ত্রে উত্তরণে তারেক রহমানের যত চ্যালেঞ্জ
তুরস্কের প্রত্যাবর্তন: মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নতুন সম্ভাবনা