বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার জরুরি
বিমানবন্দর একটি দেশের মুখচ্ছবি। এটি শুধু বিমান ওঠানামার স্থান নয়, বরং একটি জাতির উন্নয়ন, সংস্কৃতি ও অতিথিপরায়ণতার প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তাদের প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে বা স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে আসে। তারা যাত্রী না হলেও, বিমানবন্দরের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রথম ধারণা তাদের চোখ দিয়েই তৈরি হয়। কিন্তু বাংলাদেশসহ অনেক দেশের বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাচ্ছন্দ্যময় বিশ্রামাগার বা অপেক্ষাকক্ষের ব্যবস্থা নেই। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যেমন বাড়ে, তেমনি দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়। এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের জন্য আধুনিক বিশ্রামাগার স্থাপন এখন সময়ের দাবি।
দর্শনার্থীর গুরুত্ব ও বাস্তব অবস্থা:
একটি বিমানবন্দরের যাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে দর্শনার্থীর সংখ্যাও প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে যেখানে প্রবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিপুল, সেখানে প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের আগমন ও প্রস্থানের সময় হাজারো মানুষ প্রিয়জনদের স্বাগত জানাতে বা বিদায় দিতে ছুটে আসেন।
কিন্তু তাদের জন্য বিমানবন্দরের বাইরে পর্যাপ্ত বসার জায়গা, বিশ্রামের স্থান, কিংবা খাবার-পানীয়ের সুযোগ নেই। দীর্ঘ অপেক্ষায় তারা ক্লান্ত হন, রোদ-বৃষ্টি সহ্য করেন, এমনকি অনেক সময় নিরাপত্তা কর্মীদের অসৌজন্যমূলক আচরণের মুখেও পড়েন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা ও প্রত্যাশা:
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান অপরিসীম। তারা যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন তাদের পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দরে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন। কিন্তু প্রবাসীর পরিবার যখন ধুলাবালিতে ভিজে, রোদে পুড়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষা করেন, তখন সেটি দেশের অতিথিপরায়ণতার একটি দুঃখজনক চিত্র তুলে ধরে।
তাদের জন্য একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় বিশ্রামাগার কেবল নাগরিক দায়িত্ব নয়, বরং প্রবাসীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরও প্রতীক।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চিত্র:
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার যাত্রী ও অন্তত লক্ষাধীক দর্শনার্থীর চাপ সামলায়। কিন্তু দর্শনার্থীদের বসে থাকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। অনেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউ কেউ কাছাকাছি দোকানে বা গাড়ির ভেতরে অপেক্ষা করেন। বৃষ্টির সময় বা ফ্লাইট দেরি হলে অবস্থা হয় আরও করুণ।
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরেও একই চিত্র:
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দৈনিক ৪৫০০ থেকে ৫৫০০ যাত্রী পরিবহন করে থাকে। এর সাথে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার দর্শনার্থী আসা যাওয়া করে। ২০২৪ সালে প্রায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার যাত্রী পরিবহন করেছে। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও একই সমস্যা বিদ্যমান। এখানে দৈনিক প্রায় ৩ হাজার যাত্রী পরিবহন করে থাকে। সেই অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার দর্শনার্থীর বিচরণ হয়। কিন্তু অনেক সময় প্রবাসী যাত্রীদের স্বজনেরা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকেন কোনো ছায়া বা বসার জায়গা ছাড়া।
বিশ্রামাগারের প্রয়োজনীয়তা:
বিভিন্ন কারণে বিমানবন্দরে আধুনিক বিশ্রামাগার বা অপেক্ষা করার স্থা দরকার এরমধ্যে কিছু বিষয় নিচে আলোচনা করছি।
১. মানবিক দৃষ্টিকোণ:
বৃদ্ধ বাবা-মা, গর্ভবতী নারী, শিশু বা অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা কষ্টকর ও অমানবিক। বিমানবন্দরে তাদের বসে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত।
২. সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা:
নির্দিষ্ট বিশ্রামাগার না থাকলে দর্শনার্থীরা বাইরে ভিড় জমায়, যা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে টার্মিনালের প্রবেশপথে ভিড়ের কারণে নিরাপত্তা কর্মীদের দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয়।
৩. পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা:
যথাযথ বিশ্রামাগার না থাকায় অনেকে বিমানবন্দরের চারপাশে খাবার খেয়ে প্যাকেট, বোতল ইত্যাদি ফেলে যান। বিশ্রামাগার থাকলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখা সহজ হবে।
৪. মানসিক প্রশান্তি ও অতিথিপরায়ণতা:
যে দেশে দর্শনার্থীদের জন্যও বসার, বিশ্রামের ও পানীয়ের ব্যবস্থা থাকে, সেই দেশের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়ে। এটি নাগরিক দায়িত্ব ও সভ্যতার প্রতীক।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট:
সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দর:
চাঙ্গি বিমানবন্দর বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত। সেখানে দর্শনার্থীদের জন্য ভিসিটর গ্যালারি ও পাবলিক লাউঞ্জ রয়েছে, যেখানে তারা আরামদায়কভাবে বসে ফ্লাইট মনিটর করতে পারেন।
দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর:
দুবাইয়ে দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা বিশ্রামাগার, প্রার্থনা কক্ষ, কফি শপ, এমনকি শিশুদের খেলার জোন পর্যন্ত রয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা ক্লান্ত হন না, বরং আনন্দের সঙ্গে অপেক্ষা করেন।
তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর:
ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে একটি মিট এ্যান্ড গ্রিট হল আছে, যেখানে দর্শনার্থীরা যাত্রীদের আগমনের খবর দেখতে পারেন, বসার জায়গা পান, খাবার ও ইন্টারনেট সুবিধা পান।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, আধুনিক বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার থাকা এখন আন্তর্জাতিক মানের অংশ।
বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ঘাটতি: বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে দর্শনার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ছায়াশীতল স্থান নেই, বাইরের এলাকায় পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন টয়লেট বা বিশ্রামাগার নেই, খাবার-পানীয়ের ব্যবস্থা সীমিত এবং অতিমূল্যবান, রাতের ফ্লাইটের সময় দর্শনার্থীদের নিরাপদে অপেক্ষা করার সুযোগ নেই, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (প্রতিবন্ধী, শিশু, অসুস্থ বা বয়স্ক) দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা সুবিধা নেই।
অর্থনৈতিক যুক্তি:
দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার নির্মাণ শুধু মানবিক উদ্যোগ নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক হতে পারে।
১. টিকিটযুক্ত প্রবেশ ব্যবস্থা: নামমাত্র মূল্যের টিকিটে বিশ্রামাগারে প্রবেশের সুযোগ দিলে রাজস্ব আসবে।
২. খাবার, কফি, বই বা স্যুভেনির বিক্রির মাধ্যমে আয়: এসব সেবা বেসরকারি অংশীদারদের মাধ্যমে পরিচালিত হলে সরকারের বাড়তি ব্যয় লাগবে না।
৩. বিজ্ঞাপন আয়ের উৎস: বিশ্রামাগারের ভেতরে ব্র্যান্ডিং বা ডিজিটাল বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যেতে পারে।
৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বিশ্রামাগার পরিচালনায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তা, খাদ্যসেবা ও তথ্যকর্মীসহ শতাধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
নির্মাণ পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা:
১. অবস্থান নির্ধারণ:
টার্মিনালের বাইরে কিন্তু নিরাপত্তা সীমার ভেতরে একটি নির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করে বিশ্রামাগার স্থাপন করা যেতে পারে।
২. স্থাপত্য ও নকশা:
আধুনিক কিন্তু পরিবেশবান্ধব নকশা, যথেষ্ট আলো-বাতাস ও ছায়া, আরামদায়ক বসার চেয়ার, সোফা, টয়লেট, পানীয় জল, শিশু ও প্রবীণদের জন্য আলাদা জায়গা, ফ্রি ওয়াই-ফাই, চার্জিং স্টেশন, ফ্লাইট তথ্য প্রদর্শন মনিটর থাকার ব্যবস্থা করা যায়।
৩. পরিচালনা ব্যবস্থা:
এটি হতে পারে সরকারি অথবা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) একটি প্রকল্প। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে, সরকার নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা দেবে।
৪. নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা:
প্রবেশের সময় দর্শনার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা টিকিট যাচাই করা যেতে পারে, যাতে অনাকাঙ্খিত প্রবেশ ঠেকানো যায়।
দর্শনার্থী বিশ্রামাগারের সুফল:
দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার থাকলে অনেক সুবিধা রয়েছে, যেমন; জনসাধারণের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি, বিমানবন্দরের ভিড় কমে আসবে, দেশের ভাবমূর্তি উন্নত হবে, পর্যটন খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, অর্থনৈতিক আয় বৃদ্ধি পাবে, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা সহজ হবে।
গবেষণামূলক দিক:
বিশ্বব্যাপী পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নের গবেষণায় দেখা গেছে, ”হিউম্যান সেন্টারড ইনফ্র্যাসট্রাকচার ডিজাইন” কনসেপ্ট এখন জনপ্রিয়। অর্থাৎ, শুধু যাত্রী নয়, পরিবহন অবকাঠামো ব্যবহারকারীর সকল অংশীদারকেই (যাত্রী, দর্শনার্থী, কর্মী) আরামদায়ক অভিজ্ঞতা দেওয়াই আধুনিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতি।
বাংলাদেশেও যদি এই নীতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে বিমানবন্দর হবে জনগণের সম্পূর্ণ সুবিধাভোগী কেন্দ্র, শুধু যাত্রী পরিবহন কেন্দ্র নয়।
নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান:
সরকার ইতিমধ্যেই বিমানবন্দর আধুনিকায়নে বিপুল বিনিয়োগ করছে। কিন্তু শুধু যাত্রী টার্মিনাল নয়, দর্শনার্থী সুবিধাও যদি সেই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ সত্যিই আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাবে। প্রতিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দর্শনার্থী লাউঞ্জ নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা, প্রয়োজনে বেসরকারি অংশীদারদের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবা পরিচালনা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (বৃদ্ধ, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী) দর্শনার্থীদের জন্য পৃথক সেকশন এবং ডিজিটাল টিকিটিং ও নিরাপত্তা স্ক্যান ব্যবস্থাসহ আধুনিক সকল সুবিধা সংযুক্ত করা।
উপসংহার:
বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার কেবল আরাম বা বিলাসিতা নয়, এটি একটি সভ্য সমাজের প্রতিচ্ছবি, একটি মানবিক প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো আধুনিকায়নের পথে রয়েছে; এখন প্রয়োজন মানুষের মৌলিক আরাম ও সম্মান নিশ্চিত করা।
যে দেশে প্রবাসীর মা-বাবা, সন্তানেরা বা স্বজনেরা সম্মানের সঙ্গে বসে অপেক্ষা করতে পারেন, সে দেশই প্রকৃত অর্থে অতিথিপরায়ণ ও সভ্য।
অতএব, এখনই সময়, “বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার স্থাপন” শুধু প্রস্তাব নয়, বরং বাস্তব পদক্ষেপে রূপান্তরিত করার।
এমএসএম / এমএসএম
বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার জরুরি
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সচেতনতার বিকল্প নেই
ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক তারেক রহমান
তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা
গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জনগণ
বৈষম্য ও দারিদ্র্য কমাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়
গ্রামীণ ঐতিহ্য ও শীত কালীন রসদ সুমিষ্ঠ খেজুর রস
প্রতিশোধের রাজনীতি জাতির জন্য এক অভিশাপ
জলবায়ু সম্মেলন ও বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী
দেশ ও দল পরিচালনায় একই ব্যক্তি নয়
৭ নভেম্বর: “সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিপ্লব ও বাংলাদেশের নবজাগরণ”
নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতা মোটেও কাম্য নয়