গুলির শব্দের মধ্যে তফসিল ঘোষণা,এ কোন গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?
ঢাকার বিজয়নগরের সেই রক্তমাখা দুপুর যেন বাংলাদেশকে আইনের বই নয়—বাস্তবের নির্মম সত্য দিয়ে প্রশ্ন করেছে। মাত্র গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন—গণতন্ত্রের উৎসব শুরুর কথা বলেছেন। আর ঠিক তার পরের দিনই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি প্রকাশ্য রাস্তায় মাথায় গুলি খেয়ে পড়ে আছেন লাইফ সাপোর্টে—জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে।
এই দুই দৃশ্য পাশাপাশি দাঁড়ালে রাষ্ট্রের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি ছুরি হয়ে গেঁথে যায়—
এই তফসিল কি সত্যিই ভোটের উৎসবের শুরু, নাকি সহিংসতা ও আতঙ্কের এক নতুন অধ্যায়ের নির্মম ভূমিকামাত্র?
নির্বাচনী মনিটরিং ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে—তফসিল ঘোষণার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মাথায় ঘটে যাওয়া এই গুলির ঘটনা কোনোভাবেই কাকতালীয় বলে মনে করার সুযোগ নেই। দেশে যখন নির্বাচন সামনে দাঁড়িয়ে, তখন সবচেয়ে জরুরি তিনটি বিষয়—আস্থা, নিরাপত্তা এবং অংশগ্রহণ। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পরের দিনই রাজধানীর বুকে দিবালোকে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মাথায় গুলি করে ফেলা—এটা আর সাধারণ একটি “ক্রাইম নিউজ” নয়।
এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক বার্তা।
এটি মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্ক তৈরি করার একটি কৌশল।
এটি এমন এক শক্তিপ্রদর্শন, যার ভাষা অত্যন্ত স্পষ্ট—
“কে নির্বাচনী মাঠে থাকবে, আর কে থাকবে না—তা ভোট নয়, গুলি ঠিক করবে।” গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অপমান, সবচেয়ে বড় ব্যঙ্গ, সবচেয়ে বড় লজ্জা—এটাই।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি জাতির কঠিন প্রশ্ন দাঁড়িয়ে গেছে—স্বাধীন প্রার্থীর ওপর এমন বর্বর হামলা কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে লক্ষ্য করেই করা আঘাত নয়? যে মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন আশ্বাস দিচ্ছে—“সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে,” ঠিক সেই মুহূর্তেই একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রাস্তায় মাথায় গুলি খেয়ে কোমায় পড়ে আছেন।
এটা কি সত্যিই “সমান সুযোগ”?
নাকি ভয়ঙ্করভাবে প্রতিষ্ঠিত “সমান ঝুঁকি”?
স্বাধীন প্রার্থীদের ভয় দেখানো, বার্তা দেওয়া, রাস্তায় আতঙ্ক সৃষ্টি করা—এমন ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়।
আজকের হামলা সেই পুরনো অন্ধকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্মম ধারাবাহিকতা—যেখানে দ্বিমত মানেই নিশানা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানেই রক্তপাত।
গণতন্ত্রে স্বাধীন প্রার্থী হলো জনগণের কণ্ঠস্বরের বিকল্প পথ, জনমতের অক্সিজেন।
আর প্রকাশ্য গুলি সেই কণ্ঠস্বরকে নিস্তব্ধ করার সবচেয়ে সরাসরি এবং বিপজ্জনক প্রয়াস।
এই হামলা তাই একজন ব্যক্তির ওপর নয়—
এটা গণতন্ত্রের ওপর হামলা,
রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ওপর হামলা,
এবং জনতার মতের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।
প্রশ্ন জাগে—এটা কি শুধু একটি হামলা, নাকি তফসিল ঘোষণার পরপরই প্রশাসনের নগ্ন ও দ্রুত ব্যর্থতার প্রকাশ্য প্রমাণ? দেশের সবচেয়ে জনবহুল এলাকার রাস্তায়, ব্যস্ত দুপুরে, মোটরসাইকেলে আসা কয়েকজন সশস্ত্র লোক একজন প্রার্থীকে লক্ষ্য করে মাথায় গুলি করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়—এ দৃশ্য কোনো সুসংগঠিত, দায়িত্বশীল বা শক্তিশালী নিরাপত্তা কাঠামোর পরিচয় দিতে পারে না; বরং উল্টো প্রমাণ করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভয়াবহ ভঙ্গুরতা।
যে রাষ্ট্র তফসিল ঘোষণার পর মাত্র একদিনও নির্বাচনী প্রার্থীর জীবন নিরাপদ রাখতে পারে না, যে প্রশাসন রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে একজন প্রার্থীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, সেই রাষ্ট্র কীভাবে ৩০০ আসনের কোটি মানুষের ভোটের নিরাপত্তা দেবে—
এ প্রশ্ন এখন আর সাংবাদিকতার নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রক্ষমতার মৌলিক বৈধতার প্রশ্ন।
এ ধরনের ঘটনা শুধু প্রশাসনের ব্যর্থতা নয়—
এটি জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম ভেঙে পড়ার সতর্ক ঘণ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন— ভালো কথা, কিন্তু নির্দেশ দিয়ে মৃত্যুমুখ থেকে কাউকে ফিরিয়ে আনা যায় না। এমন হামলা ঠেকানোর প্রাথমিক কাজটিই যখন ব্যর্থ হয়, তখন নির্দেশের মূল্য থাকে না।
তাই দেশের ভোটারদের পাশাপাশি, বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীরাও একে শুধু একজন হাদির ওপর হামলা হিসেবে দেখছেন না—তাদের চোখে এটি ‘তফসিল’ শব্দটির বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর সরাসরি ছোড়া গুলি।
তফসিল ঘোষণার মানে—দেশ এখন নির্বাচনমুখী সময়ের দিকে প্রবেশ করেছে। এর অর্থ—এখন থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সরকারি উদ্যোগ হতে হবে স্বচ্ছ, ন্যায়সংগত, এবং সম্পূর্ণ সহিংসতামুক্ত। কিন্তু বাস্তবতা কী দেখাল?
তফসিল ঘোষণার পরবর্তী প্রথম বড় খবর—
একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মাথায় গুলি। এই সংবাদ মানুষের মনে কী বার্তা পাঠায়? বার্তাটি অত্যন্ত স্পষ্ট, অত্যন্ত শীতল— “এই নির্বাচন নিরাপদ নয়। এই পরিবেশে আস্থা রাখা যায় না।”
এ ঘটনার পর শুধু দেশের ভোটাররা নয়, বিদেশে থাকা প্রবাসীরাও প্রশ্ন তুলতে বাধ্য— যে দেশে নির্বাচনী প্রার্থীই নিরাপত্তাহীন, সেই দেশে সাধারণ ভোটাররা কতটা নিরাপদ? একটি রাষ্ট্র যখন তার প্রার্থীকেই রক্ষা করতে পারে না, তখন সে রাষ্ট্র ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে— এ আশা করা কি বাস্তবসম্মত?
এই প্রশ্ন আজ লাখো প্রবাসীর হৃদয়ের ভেতর অস্থির ঢেউ তোলে— এরা সেই মানুষ, যারা দূর দেশ থেকে দেশের উন্নতি, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার আশা বুকে নিয়ে তাকিয়ে থাকে।আজ তাদের চোখেও বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে
ভয়, সন্দেহ ও অনাস্থার ছায়া আরও ঘন হয়ে গেছে।
এখানে উঠে এসেছে এক অতি গুরুতর প্রশ্ন—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যাদের দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ গড়ে তোলা, তারা এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে সক্ষম?
জাতির কাছে প্রশ্ন স্পষ্ট—কে দেবে নিরাপত্তা, কে বাঁচাবে গণতন্ত্রকে, এবং এই ভয় ও সহিংসতার আবরণ কবে পর্যন্ত বহাল থাকবে?
শরিফ ওসমান বিন হাদির মাথায় যে গুলি এখনো আটকে আছে—তা কেবল একটি অপরাধমূলক হামলার ফল নয়।
এটি প্রমাণ করে দিয়েছে—
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অক্সিজেন কতটা বিষাক্ত হয়ে গেছে।
তফসিল ঘোষণার মাত্র ২৪ ঘণ্টা পরই যখন গুলির শব্দ ভেসে আসে, তখন স্পষ্ট হয়ে যায়—নির্বাচন এখন শুধুমাত্র ভোটের আয়োজন নয়; এটি আমাদের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই।
আজ হাদির জীবন যুদ্ধ করছে, আর আমাদের লড়াই সত্য উচ্চারণ ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর।
যদি আজ আমরা নীরব থাকি, বিবেক অজাগ্রত রাখি, তাহলে আগামী দিনের তফসিল কেবল কাগজে থাকবে—বাস্তবে নয়, গণতন্ত্রের মর্যাদা হারিয়ে যাবে।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক
এমএসএম / এমএসএম
গুলির শব্দের মধ্যে তফসিল ঘোষণা,এ কোন গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, যখন লড়াই হয় অহিংস ও গণতান্ত্রিক!
দলবদলের রাজনীতিতে আদর্শ প্রশ্নবিদ্ধ
গাজায় যুদ্ধ বিরতি নাকি পশ্চিমাদের যুদ্ধের কৌশল
পুতিনের ভারত সফরে কী বার্তা পেল বিশ্ব
নৈতিক ও অস্তিত্বগত সংকটে বিশ্ব
পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি
তারেক রহমানের প্রতিশ্রুতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা
জ্বালানি ব্যবস্থায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে করণীয়
ইউরোপ আমেরিকার সম্পর্কের টানাপোড়েন
জুলাই সনদ, গণভোট ও নির্বাচন
বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার জরুরি