নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, যখন লড়াই হয় অহিংস ও গণতান্ত্রিক!
২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক উত্তেজনা, একদলীয় কর্তৃত্ববাদের বিরূপ প্রভাব, জোট রাজনীতির পুনর্গঠন এবং তরুণ ভোটারদের উচ্ছ্বাস ও আশা—সব মিলিয়ে এই নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি, জামায়াত–ইসলামী নেতৃত্বাধীন ৮‑দলীয় জোট, এনসিপি জোট, জাতীয় পার্টি, সূন্নী ঐক্যজোটসহ একাধিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। অন্যদিকে, ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের সীমিত বা নিষিদ্ধ অবস্থার প্রভাব নির্বাচনী অক্ষকে নতুনভাবে রূপান্তরিত করেছে। ভোটের মাঠ এখন কেবল সংখ্যার লড়াই নয়, বরং আদর্শ, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন কৌশলসমূহের মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে—প্রথম, বিএনপি কি প্রায় ১ কোটি ৫৫ লাখ প্রবাসী ভোটসহ আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে? এবং দ্বিতীয়, জামায়াত-ইসলামী নেতৃত্বাধীন ৮‑দলীয় জোট ও এনসিপির অংশগ্রহণ কি নির্বাচনে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বৈচিত্র্য নিশ্চিত করবে? এই দুই প্রশ্নই ২০২৬ সালের নির্বাচনকে শুধুমাত্র ভোটের লড়াই নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক পুনর্গঠন, জোটসমীকরণ এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের কঠিন পরীক্ষা হিসেবে পরিণত করেছে।
এই প্রথম বিএনপি অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। দলের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা কৌশলটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক ও কৌশলগত পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ বিএনপির দূরদর্শিতা ও নির্বাচন-কেন্দ্রিক কৌশলের প্রতিফলন, যা আসন্ন নির্বাচনকে একপেশে প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মধ্যে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ তৈরি করেছে। যদি এই পদক্ষেপ না নেওয়া হতো, তবে ২০২৬ সালের নির্বাচন সম্ভবত একটি একতরফা নির্বাচনের মতোই সীমাবদ্ধ থাকত।
গত কয়েক নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চিরায়ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে বিএনপি ও জামায়াত একসাথে চলেছে। তবে আদর্শিক দিক থেকে—বিএনপি জাতীয়তাবাদী, আর জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। অতীতের রাজনৈতিক সুবিধাবাদী মুহূর্তগুলোতে এই ভিন্নতা প্রায় চাপা পড়েছিল, কিন্তু ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে ১৯৭১ সালের স্মৃতি স্মরণ করে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি জামায়াতের দিকে নির্দেশ করে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট—বিএনপি নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী প্ল্যাটফর্মে পুনর্গঠিত করছে, যাতে আওয়ামী লীগের পতনের পরে ফাঁকা হয়ে যাওয়া আদর্শিক অক্ষ দখল করে আসন্ন নির্বাচনে একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারে।
আট দলীয় জামায়াত-ইসলামী জোটের ভোটব্যাংক অক্ষুণ্ণ থাকলেও তাদের সামগ্রিক অবস্থান কিছুটা দুর্বল। জামায়াত এখনও নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি ও স্থানীয় স্তরের ভোটব্যাংক ধরে রেখেছে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে তাদের শাখা-সংগঠন ও প্রচারযন্ত্র সক্রিয়। প্রশাসনিক সক্ষমতা, শক্তিশালী অনলাইন মিডিয়া এবং দলের আর্থিক সক্ষমতার সমন্বয় এই জোটকে বিএনপির সঙ্গে কঠিন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার একটি দৃশ্যমান সক্ষমতা দিয়েছে। তবে বিএনপির ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী পুনর্গঠন এবং শহুরে ও প্রবাসী ভোটারের প্রতি তাদের আকর্ষণ জোটের প্রভাবকে সীমিত করতে পারে, যা ২০২৬ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক ভারসাম্যের নতুন মানচিত্র তৈরি করতে পারে।
এদিকে, এনসিপি জোট, জাতীয় পার্টি ও বৃহত্তর সূন্নী ঐক্যজোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ, শহুরে মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত ভোটারদের মধ্যে নতুন প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এনসিপি বিশেষভাবে শহুরে যুবসমাজ, পেশাজীবী ও সামাজিক আন্দোলন–মনস্ক ভোটারদের লক্ষ্য করে নিজেদেরকে “উদার গণতান্ত্রিক বিকল্প” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। জাতীয় পার্টি বরাবরের মতো “কিংমেকার” ভূমিকা পালন করতে চাইছে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের নির্বাচনী শক্তির ওপর নির্ভর করে। এই তিনটি প্ল্যাটফর্ম সম্মিলিতভাবে নির্বাচনী মাঠে প্রতিযোগিতা তৈরি করবে, যদিও তারা বিএনপি বা জামায়াত-ইসলামী জোটের মতো বড় রাজনৈতিক শক্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। তবে শহুরে মধ্যবিত্ত, তরুণ ভোটার এবং উদারপন্থী ভোটারদের উপস্থিতি ভোটের ফলাফলের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। নির্বাচনী বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ও প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস নির্বাচনকে ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন হিসেবে গড়ার জন্য প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, RPO–র যথাযথ প্রয়োগ এবং পর্যবেক্ষক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করছেন। এই প্রেক্ষাপটে, এই তৃতীয় ধারা ২০২৬ সালের নির্বাচনী মাঠকে আরও প্রতিযোগিতামূলক, বহুমাত্রিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলবে।
এবারের নির্বাচন বিশেষভাবে নজর কাড়বে কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ অবস্থায় থাকবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক, মানবাধিকার সংস্থা এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতা মূল্যায়নকারী সংস্থাগুলো মনোযোগী হবে—আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন কতটা প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে, বিরোধী দলগুলো সমান সুযোগ পাচ্ছে কি না, এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্বের ছায়া কতটা দূর করা সম্ভব হয়েছে তা তারা খুঁটিয়ে দেখবে। সংবিধান ও RPO–এর বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পরিবেশ, ভোটারদের নিরাপত্তা, প্রচারণার স্বাধীনতা এবং পর্যবেক্ষক সংস্থার অবাধ চলাচল—এসব আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার মূল সূচক হিসেবে বিবেচিত হবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিশ্লেষক এবং প্রবাসী ভোটদাতারা ভোটের পরিবেশ ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুষ্ঠুতা মনিটর করবে, যা নির্বাচনের বৈধতা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইমেজের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, নির্বাচন শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিযোগিতা নয়, বরং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার কঠিন পরীক্ষা হিসেবেও পরিণত হচ্ছে।
২০২৬ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিরোধী অক্ষ পুনর্গঠিত হয়েছে, বিএনপি প্রবাসী ভোট ও শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে শক্ত অবস্থানে রয়েছে, সেই সাথে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে। জামায়াত-ইসলামী জোট, এনসিপি জোট, জাতীয় পার্টি ও সূন্নী ঐক্যজোট নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক রাখবে। প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও RPO–র অধীনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই নির্বাচন শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং রাজনৈতিক পুনর্গঠন, আদর্শিক পরিবর্তন ও নতুন ভোটার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মান যাচাই করার মঞ্চ। আসন্ন নির্বাচন সত্যিই একটি বহুমাত্রিক ও নজরকাড়া রাজনৈতিক পরীক্ষা হিসেবে দেখা দিচ্ছে, যেখানে বিশ্লেষকরা বিভিন্ন দলের ক্ষমতার ভারসাম্য ও প্রভাবের সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি নাকি আট দলীয় জামায়াত-ইসলামী জোট সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করবে?
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক
এমএসএম / এমএসএম
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, যখন লড়াই হয় অহিংস ও গণতান্ত্রিক!
দলবদলের রাজনীতিতে আদর্শ প্রশ্নবিদ্ধ
গাজায় যুদ্ধ বিরতি নাকি পশ্চিমাদের যুদ্ধের কৌশল
পুতিনের ভারত সফরে কী বার্তা পেল বিশ্ব
নৈতিক ও অস্তিত্বগত সংকটে বিশ্ব
পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি
তারেক রহমানের প্রতিশ্রুতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা
জ্বালানি ব্যবস্থায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে করণীয়
ইউরোপ আমেরিকার সম্পর্কের টানাপোড়েন
জুলাই সনদ, গণভোট ও নির্বাচন
বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার জরুরি
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সচেতনতার বিকল্প নেই