ঢাকা রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

নাগরিক ভোগান্তি রোধে দরকার পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস ও জনসচেতনতা


এসএম পিন্টু photo এসএম পিন্টু
প্রকাশিত: ২৫-১০-২০২৫ দুপুর ৩:৭

বাংলাদেশের দুই প্রধান মহানগর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম, আজ জনসংখ্যা ও যানবাহনের চাপে হাঁসফাঁস করছে। প্রতিদিন লাখো মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় হারাচ্ছে শুধু যানজটে। রাস্তা জুড়ে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাত দখল, আর নির্ধারিত পার্কিং স্পেসের অভাব, সব মিলিয়ে নাগরিক জীবনে নেমে এসেছে তীব্র ভোগান্তি। এক কথায় বলা যায়, পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থার অভাব এখন নগরজীবনের সবচেয়ে বড় অদৃশ্য শত্রু। এই বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিকল্পিত পার্কিং অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি জনসচেতনতা এখন সময়ের দাবি।
ঢাকা শহরের বাস্তবতা:
বর্তমানে ঢাকা শহরের আয়তন ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আর ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ। বিআরটিএ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৫৭ লাখ ৫২ হাজার মোটরযান নিবন্ধিত আছে, এরমধ্যে ঢাকায় ২০ লক্ষাধিক মোটরযান চলছে, কিন্তু শহরে নির্ধারিত পার্কিং স্পেস আছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ যানবাহনের জন্য। ফলে, অফিসের সামনে, মার্কেটের পাশে, হাসপাতালের গেটের সামনে, সব জায়গায় গাড়ি রাখা হচ্ছে এলোমেলোভাবে। ফুটপাত দখল হয়ে যাচ্ছে, ফলে পথচারীদের নামতে হয় রাস্তায়। সড়কের অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জায়গা ব্যবহার হয় পার্কিং ও ভাসমান দোকানের জন্য। ফলাফল, ট্রাফিক জ্যাম, শব্দদূষণ, জ্বালানির অপচয় এবং মানসিক ক্লান্তি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন পার্কিংজনিত জ্যামে প্রায় ৫০ লক্ষ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্য বছরে হাজার কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম শহরের বাস্তবতা:
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর চট্টগ্রামও এখন একই সমস্যায় আক্রান্ত। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ১৬১ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ লাখ। বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার মোটরযান রয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এলাকার সড়কগুলো মূলত নকশা করা হয়েছিল ১৯৬০ দশকে, তখন গাড়ির সংখ্যা ছিল খুবই কম। এখন সেখানে প্রতিদিন নতুন গাড়ি যোগ হচ্ছে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০টি। কিন্তু পার্কিং অবকাঠামো নেই বললেই চলে।

 

বাস্তব চিত্র:
আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়, নিউমার্কেট, চকবাজার, আন্দরকিল্লা, ও রেলস্টেশন এলাকায় অবৈধ পার্কিং এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। বেশিরভাগ বহুতল ভবনে পার্কিংয়ের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়নি। স্কুল ও হাসপাতালের সামনে সকাল–বিকেল গাড়ির ভিড়ে রাস্তায় স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। ফলাফল একই, নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর।
বেড়েছে জনসংখ্যা ও যানবাহন:
বিআরটিএ’র হিসেবে অনুযায়ী ২০১০ সালে বাংলাদেশে মোট নিবন্ধিত মোটরযান ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার আর বর্তমানে আছে ৫৭ লাখ ৫২ হাজার অর্থাৎ ১৫ বছরে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে ৪৩ লাখ ২৫ হাজার। সেই তুলনায় রাস্তা বড় হলেও পার্কিং স্পেস হয়নি। 
শুধু গাড়ির সংখ্যাই বাড়েনি বেড়েছে জনসংখ্যাও, ২০১০ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৭৭ লাখ আর ২০২৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ কোটিতে। অর্থাৎ ১৫ বছরে বেড়েছে ৪ কোটির ওপরে। এসব জনসাধারণের জন্য নতুন করে নির্মিত হয়েছে শিল্প কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক স্থাপনা।
পার্কিং সংকটের মূল কারণ:
ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের পার্কিং সংকটের মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতিরিক্ত যানবাহন, অবৈধ পার্কিং সংস্কৃতি, দুর্বল আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতার অভাব। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীনভাবে। বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের সময় পার্কিং ব্যবস্থা উপেক্ষিত থেকেছে। শহরে হাজার হাজার অননুমোদিত ভবন রয়েছে। আবার যা অনুমোদিত তারাও সঠিক পার্কিং স্পেস রাখেনি। পার্কিংয়ের স্থলে বাণিজ্যিক দোকান ভাড়া দিয়ে বসে আছে। জনসংখ্যার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, কিন্তু সড়ক বা পার্কিং জায়গা বাড়েনি। চালকেরা পার্কিং ফি এড়াতে রাস্তাতেই গাড়ি রেখে যান। অনেক সময় পার্কিং লঙ্ঘনের শাস্তি সামান্য বা প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। অনেক নাগরিকই জানেন না, নিজের সুবিধার জন্য করা অবৈধ পার্কিং অন্যদের কত বড় কষ্টের কারণ হয়।
পার্কিং সমস্যায় ভোগান্তির কারণ: পার্কিং সমস্যায় নাগরিক ভোগান্তির মূল কারন জনসচেতনতার অভাব। সচেতনতার অভাবে যে যার খেয়াল খুশিমতো রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করে রাখে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত পার্কি না থাকা ও যত্রতত্র পার্কিংয়ের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানার কার্যক্রম শুরু ও ছুটির সময় রাস্তায় প্রচুর জ্যাম সৃষ্টি হয়। এসব জ্যাম নিরসণে সকলেরই সচেতন হওয়া জরুরী।
নাগরিক ভোগান্তির রূপ ও প্রভাব: 
নাগরিক ভোগান্তির ফলে শুধু ব্যাক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়না, সামগ্রীকভাবে রাষ্ট্রও ক্ষতির সম্মূখীন হয়। যেমন,
সময় অপচয়: অফিসগামী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকেন।
অর্থনৈতিক ক্ষতি:যানজটে জ্বালানির অপচয় ও উৎপাদনশীল সময়ের ক্ষতি বছরে হাজার কোটি টাকার সমান।
মানসিক চাপ: দীর্ঘ যানজট থেকে মানসিক ক্লান্তি, বিরক্তি ও অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছে।
পরিবেশ দূষণ: ইঞ্জিন চালু রেখে পার্ক করা গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণ বাড়ায়।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি: পার্কিং নিয়ে ঝগড়া, তর্ক-বিতর্ক এমনকি মারামারির ঘটনাও প্রতিদিন ঘটছে।

সম্ভাব্য সমাধান:
১.রাস্তা ও ফুটপাতের ব্যবহার নিশ্চিত করা:
যানযটের কবলে নাগরিক ভোগন্তি রোধে রাস্তা ও ফুটপাতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে মানুষ ফুটপাত দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে আর অবৈধ পার্কিং বন্ধ করতে হবে কোন গাড়ি দাড়িয়ে গেলে যাতে অন্যটি ওভারটেক করে যেতে পারে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তা অনেক প্রশস্ত নিয়ম মেনে গাড়ি চললে যানযট হওয়ার কথা নয়।
২.রাজনৈতিক সদিচ্ছ: নাগরিক ভোগান্তি রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ঠে। রাজনীবিদরা যদি চান চান তাহলে তা মুহুর্তেই সমাধান সম্ভব। শহরের অধিকাংশ এলাকায় দেখা যায় ভাসমান দোকানদাররা ফুটপাতগুলো দখল করার পাশাপাশি সড়কের অনেকটা অংশ দখল করে বসে আছে। পুলিশ অনেক সময় অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার কাজ করতে চাইলেও রাজনীতির পরিচয়দারি অনেকের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। ফলে এই কাজটি করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা অত্যন্ত জরুরী।
৩. বহুতল পার্কিং ভবন নির্মাণ:
প্রধান বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে (মতিঝিল, গুলশান, আগ্রাবাদ, নিউমার্কেট) বহুতল পার্কিং ভবন নির্মাণ করতে হবে। এতে অল্প জায়গায় শতাধিক গাড়ি রাখা সম্ভব।
৪. স্মার্ট পার্কিং সিস্টেম:
ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে গাড়ির অবস্থান, খালি পার্কিং স্পেস, ও পেমেন্ট অনলাইনে পরিচালনা করা যেতে পারে— যেমন টোকিও বা সিঙ্গাপুরে প্রচলিত।
৫. বিল্ডিং পারমিটের নিয়ম কঠোর করা:
নতুন ভবন নির্মাণে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ পার্কিং স্পেস রাখতে হবে, নইলে অনুমোদন দেওয়া যাবে না।
৬. অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা:
নগর পুলিশ ও সিটি করপোরেশনকে যৌথভাবে আইন প্রয়োগে আরো কঠোর হতে হবে। 

৭. গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন:
যদি নিরাপদ, দ্রুত ও স্বাচ্ছন্দ্য গণপরিবহন থাকে, তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমে যাবে, ফলে পার্কিং চাপও কমবে।
৮. নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি:
স্কুল-কলেজে, মিডিয়ায়, ও নাগরিক সমাজের মাধ্যমে পার্কিং শৃঙ্খলা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
বিশেষ উদ্যোগের উদাহরণ:
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সম্প্রতি মতিঝিল ও নিউমার্কেট এলাকায় বহুতল পার্কিং প্রকল্প হাতে নিয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আগ্রাবাদে “অটোমেটেড পার্কিং সিস্টেম” চালুর উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এসব উদ্যোগ এখনও নগণ্য, এগুলো বিস্তৃতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিক্ষা ও পরিকল্পনার সংযোগ:
এই সংকটের মূল সমাধান শিক্ষায়। শহর পরিকল্পনা, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও সিভিল আর্কিটেকচারে পার্কিং নকশাকে বাধ্যতামূলক পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। শিক্ষিত প্রজন্ম যদি নগর নকশার গুরুত্ব বোঝে, তাহলে ভবিষ্যতের শহর হবে সচেতন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ।
উপসংহার:
ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো মহানগরীতে নাগরিক ভোগান্তির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে পার্কিং সংকট অন্যতম। সময় এসেছে এটিকে শুধু ট্রাফিক সমস্যা হিসেবে নয়, বরং “নগর টেকসই উন্নয়নের বাধা” হিসেবে চিহ্নিত করার।
একটি আধুনিক, সুন্দর ও বাসযোগ্য শহর গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন পরিকল্পিত পার্কিং অবকাঠামো, কঠোর আইন, এবং সচেতন নাগরিক সংস্কৃতি। “নাগরিক ভোগান্তি রোধে পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস শুধু প্রয়োজন-ই নয়, এটি এখন টেকসই নগরজীবনের অপরিহার্য শর্ত।”
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।

এমএসএম / এমএসএম

নাগরিক ভোগান্তি রোধে দরকার পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস ও জনসচেতনতা

জাতিসংঘের ব্যর্থতা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব

রাজনীতিতে রাজা আছে, নীতি নাই

গণতন্ত্রে উত্তরণে তারেক রহমানের যত চ্যালেঞ্জ

তুরস্কের প্রত্যাবর্তন: মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নতুন সম্ভাবনা

জীবনের জয়গানে সড়ক হোক মুখরিত

এক ভয়ংকর সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

জয় হোক বিশ্ব মানবতার

আলোর উৎসব দীপাবলি :শান্তি ও সম্প্রীতির জয়গান

কর্পোরেট দুনিয়ায় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিলুপ্তির সম্ভাবনা: প্রযুক্তির ঝড়, না কি মানবিক পুনর্জাগরণ?

জুলাই সনদ স্বাক্ষর হলো, সংশয় কি কাটলো

পুলিশ - সাংবাদিক দূরত্ব কাম্য নয়

গাজার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ