ঢাকা রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৫

সৎ মানুষ অন্যায়ের প্রতিপক্ষ


এসএম পিন্টু photo এসএম পিন্টু
প্রকাশিত: ৭-১১-২০২৫ দুপুর ১:০

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ এই দ্বৈত প্রবাহ যুগে যুগে বিদ্যমান। কিন্তু এই প্রবাহের মধ্যে যারা আলোর পথ দেখায়, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তারাই হলো সৎ মানুষ। একবিংশ শতাব্দীর এই প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে সৎ মানুষের প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশি, কারণ নৈতিকতার পতন যত গভীর হচ্ছে, ততই সমাজে অন্যায়ের প্রভাব বাড়ছে। আর সৎ মানুষ সমাজ পরিবর্তণের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারা দেশ ও জাতির কল্যানে কাজ করে কিন্তু এই কল্যাণকর কাজ অনেকেই সহ্য করতে পারে না। অনেকেই আছেন যারা ব্যক্তি স্বার্থে নানারকম অন্যায় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সৎ মানুষ সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ফলে সেই ব্যক্তি তাকে শত্রু মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে সৎ মানুষ কোন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ নয়, সে অন্যায়ের প্রতিপক্ষ। সুতরাং যে অন্যায় করবে তারা সবসময় সৎ মানুষকে প্রতিপক্ষ মনে করে বাস্তবে সৎ মানুষ কারো প্রতিপক্ষ নয়, তারা শুধুমাত্র অন্যায়ের প্রতিপক্ষ। আর এই সততার কারণে তার শত্রু এমনভাবে বাড়ে তার সমমনা বন্ধু পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। তাকে তখন একা হয়ে পড়তে হয়। তাই সৎ মানুষকে প্রতিপক্ষ না ভেবে অন্যায় রোধে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ ব্যক্তির চেয়ে দেশ অনেক বড়। দেশের স্বার্থে ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়ার শর্তে প্রত্যেককেই সৎ হওয়া উচিৎ। তাই আসুন সৎ হই, সততার সাথে বন্ধুত্ব করি।
সততা ও নৈতিকতার সংজ্ঞা:
সততা মানে কেবল মিথ্যা না বলা নয়; সততা মানে নিজের বিবেকের কাছে সৎ থাকা। ন্যায়কে ধারণ করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, নিজের লাভের জন্য কারো ক্ষতি না করা, এই সবই সততার অংশ।
নৈতিকতা হলো সেই অন্তর্গত শক্তি যা মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়। এটি মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। যিনি নৈতিক, তিনি ভীত নন; কারণ তাঁর কর্মকাণ্ড সত্যের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে।
অন্যায়ের প্রকৃতি:
অন্যায় হলো ন্যায়ের বিপরীত। অন্যায় মানে এমন কাজ, যা সমাজের আইন, মানবতার নীতি, বা নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করে। ঘুষ, দুর্নীতি, শোষণ, মিথ্যাচার, বৈষম্য, সবই অন্যায়ের রূপ। অন্যায় কখনো একা আসে না; এটি আসে ক্ষমতা, অর্থলোভ ও আত্মকেন্দ্রিকতার হাত ধরে। সমাজে যখন অন্যায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন সততা দুর্বল মনে হয়, কিন্তু ইতিহাস বলে, শেষপর্যন্ত সত্যই জয়ী হয়।
সৎ মানুষের চরিত্র:
সৎ মানুষ কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে না। তিনি একা হলেও ন্যায়ের পথে হাঁটেন। সমাজে অনেক সময় সৎ মানুষকে কষ্ট পেতে হয়, অপমান সইতে হয়, কিন্তু তাঁদের আত্মসম্মান অটুট থাকে। একজন সৎ মানুষ, সত্যের পাশে দাঁড়ান, ভীত হন না ক্ষমতার সামনে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, নিজের স্বার্থের আগে সমাজের মঙ্গল ভাবেন। এমন মানুষই অন্যায়ের প্রতিপক্ষ, কারণ তাঁর বিবেক তাঁকে চুপ থাকতে দেয় না।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে সততা ও অন্যায়ের বিরোধিতা:
প্রত্যেক ধর্মই সততার গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামে বলা হয়েছে, “সত্যবাদী ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রিয়।” হিন্দু ধর্মে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, এর মধ্যে ‘ধর্ম’ই ন্যায় ও সততার প্রতীক। খ্রিষ্ট ধর্মে বলা হয়েছে, ”সত্য মোহকে মুক্ত করবে” বৌদ্ধ ধর্মে সততা হলো মোক্ষপ্রাপ্তির অন্যতম উপায়।
ধর্মীয়ভাবে স্পষ্ট, সৎ মানুষ শুধু সমাজের নয়, সৃষ্টিকর্তার কাছেও মর্যাদাপূর্ণ। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করা মানেই স্রষ্টাপ্রদত্ত দায়িত্ব পালন করা।
ইতিহাসে সৎ মানুষের ভূমিকা:
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রত্যেক যুগে কিছু সৎ মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী অহিংসার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অন্যায় প্রতিহত করেন। নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেন। সত্যেন সেন, বেগম রোকেয়া, লালন শাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, তাঁদের সকলের মূল শক্তি ছিল সততা ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান। এইসব মানুষ প্রমাণ করেছেন, সত্যিকারের শক্তি বন্দুক বা অর্থে নয়, থাকে চরিত্রে ও নৈতিকতায়।
আধুনিক সমাজে অন্যায়ের বিস্তার:
আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি উন্নত হলেও নৈতিকতা কমছে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, লোভ, ঘুষ, প্রতারণা, মিথ্যা প্রচারণা, এসব যেন সমাজের অংশ হয়ে গেছে। অন্যায়ের এই বৃত্তে মানুষ নিজেই বন্দী।
যখন শিক্ষক ঘুষ নেয়, চিকিৎসক দায়িত্বহীন হয়, প্রশাসক অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, তখন সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। এই অবস্থায় একমাত্র সৎ মানুষই পারে প্রতিরোধ গড়তে, কারণ তিনি ভয় পান না, বিক্রি হন না, এবং সত্যের পক্ষে থাকেন।
সৎ মানুষ বনাম অন্যায়ের শক্তি:
অন্যায়ের শক্তি সাধারণত সংগঠিত হয়, তাদের অর্থ, প্রভাব, ক্ষমতা থাকে। কিন্তু সৎ মানুষের শক্তি অদৃশ্য, এটি বিবেক ও আদর্শের শক্তি।
প্রথমে সৎ মানুষ একা মনে হয়, কিন্তু তাঁর সততা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। ধীরে ধীরে তাঁর চারপাশে গড়ে ওঠে এক নতুন সমাজচেতনা। ইতিহাসের প্রতিটি বিপ্লব শুরু হয়েছে এমনই কিছু সৎ মানুষের হাত ধরে।
পরিবার ও শিক্ষায় সততার ভিত্তি:
সততা জন্মগত নয়, এটি শেখানো যায়। পরিবার হলো সততার প্রথম বিদ্যালয়। বাবা-মা যদি ন্যায়পরায়ণ হন, সন্তানও তেমন হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে তার খেলার সাথি বা বন্ধুদের মধ্যে যদি কোন খারাপ লোক থাকে তবে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। বিদ্যালয়েও নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষার চেয়ে বেশি প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা। যদি স্কুলে শেখানো হয় “অন্যায়ের সঙ্গে আপস নয়”, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে।
গণমাধ্যম ও সমাজের ভূমিকা:
গণমাধ্যম সমাজের আয়না। কিন্তু যখন সংবাদ বিকৃত হয়, মিথ্যা প্রচার হয়, তখন সমাজ বিভ্রান্ত হয়। তাই সাংবাদিকদেরও হতে হবে সৎ, কারণ সত্য প্রকাশই তাদের ধর্ম। সৎ গণমাধ্যম অন্যায়ের প্রতিপক্ষ হয়ে জনমত গড়ে তোলে।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমেও সততার ভূমিকা জরুরি, যেখানে মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়ায়, সেখানে সৎ ব্যবহারকারীই সত্যের কণ্ঠ হতে পারে।
রাষ্ট্র ও প্রশাসনে সৎ মানুষের প্রভাব:
যদি প্রশাসনে সৎ মানুষ নেতৃত্ব দেয়, তাহলে রাষ্ট্রে অন্যায় টিকতে পারে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, জবাবদিহিমূলক সরকার, সবই সম্ভব হয় সৎ নেতৃত্বের মাধ্যমে।
সৎ রাজনীতিক মানে এমন নেতা, যিনি দেশকে নিজের পরিবার মনে করেন। তিনি জনগণের অর্থে বিলাসিতা করেন না; বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
সততা ও সাহস, দুটি অবিচ্ছেদ্য শক্তি, সততা ছাড়া সাহস টেকে না। একজন সৎ মানুষকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রলোভনের বিরুদ্ধে, ভয় ও হুমকির বিরুদ্ধে। সাহসই তাকে টিকিয়ে রাখে। তাই সততা মানে কেবল নৈতিকতা নয়, বরং দৃঢ়চেতা মনোবল।
সমাজ পরিবর্তনে সৎ মানুষের প্রভাব: 
সৎ মানুষ একা সমাজ বদলাতে না পারলেও তাঁর প্রভাব অনেক গভীর। তিনি অনুপ্রেরণা ছড়ান, ন্যায়বোধ জাগান। তাঁর উদাহরণে আরও মানুষ জেগে ওঠে। একটি সমাজে যদি শতকরা ১০ জন মানুষও সত্যিকারের সৎ হয়, তবে সেই সমাজ কখনো ধ্বংস হয় না। কারণ সততার আলো কখনো নিভে যায় না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ:
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে অন্যায়, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম দীর্ঘদিনের সমস্যা। কিন্তু এ দেশের মাটিতে সৎ মানুষের ঘাটতি নেই। অসংখ্য সৎ শিক্ষক, ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক, কৃষক, কর্মচারী প্রতিদিন নীরবে ন্যায়ের পক্ষে লড়ছেন। তাঁরা হয়তো আলোচনায় আসেন না, কিন্তু সমাজ তাঁদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, ও সত্যনিষ্ঠা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করবে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সৎ মানুষের প্রতিচ্ছবি:
বাংলা সাহিত্য সততা ও ন্যায়ের প্রতীক চরিত্রে পরিপূর্ণ, শরৎচন্দ্রের চরিত্ররা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, রবীন্দ্রনাথের “গোরা”, “চতুরঙ্গ”-তে দেখা যায় নৈতিক দ্বন্দ্বের জয়, বেগম রোকেয়া নারীর মুক্তিতে সততা ও ন্যায়ের মশাল জ্বালান। সাহিত্য আসলে সেই আয়না, যেখানে সমাজের সৎ মানুষকে দেখা যায় নায়ক হিসেবে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে কী হয়:
যখন সৎ মানুষ চুপ থাকে, তখন অন্যায় বাড়ে। “নীরবতা” হলো অন্যায়ের সহযোগী। জার্মান কবি মার্টিন নিমোলার বলেছিলেন, যদি আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ না করি, একদিন সেই অন্যায় আমাদেরও গ্রাস করবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বার্তা:
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেখাতে হবে, সত্যে থাকো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও। তাদের বোঝাতে হবে, সাফল্য মানে শুধু ধন নয়, চরিত্র। সৎ মানুষ কখনো পরাজিত হয় না, তাঁর জয় হয় সময়ের ব্যবধানে, কিন্তু হয় নিশ্চিতভাবেই।
উপসংহার:
সততা হলো সমাজের প্রাণশক্তি। অন্যায় যত বড়ই হোক, সৎ মানুষের দৃঢ়তা ততই অটল। সৎ মানুষ অন্যায়ের প্রতিপক্ষ, কারণ তিনি সত্যের সৈনিক। তাঁর প্রতিটি কাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব যুদ্ধ। যতদিন পৃথিবীতে এমন মানুষ থাকবে, ততদিন অন্যায়ের অন্ধকার পুরোপুরি ছায়া ফেলতে পারবে না। সত্যের পথ কঠিন, কিন্তু সেটিই আলোর পথ। অন্যায়ের প্রতিপক্ষ হতে পারাই মানুষ হওয়ার সবচেয়ে বড় গৌরব।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।

এমএসএম / এমএসএম

৭ নভেম্বর: “সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিপ্লব ও বাংলাদেশের নবজাগরণ”

নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতা মোটেও কাম্য নয়

সৎ মানুষ অন্যায়ের প্রতিপক্ষ

নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হোক

নাগরিক সমাজ ও মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার

গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন জিয়াউর রহমান

নাগরিক সচেতন হলে রাজা নীতিবান হতে বাধ্য

নাগরিক ভোগান্তি রোধে দরকার পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস ও জনসচেতনতা

জাতিসংঘের ব্যর্থতা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব

রাজনীতিতে রাজা আছে, নীতি নাই

গণতন্ত্রে উত্তরণে তারেক রহমানের যত চ্যালেঞ্জ

তুরস্কের প্রত্যাবর্তন: মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নতুন সম্ভাবনা

জীবনের জয়গানে সড়ক হোক মুখরিত