সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। সাংবাদিকতা শুধু একটি পেশা নয়, এটি গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। একটি রাষ্ট্রের ভালো মন্দ দেখার মূল দায়িত্ব সাংবাদিকের কাঁধেই ন্যস্ত। রাজনীতিবিদরা দলীয় বা নিজের স্বার্থে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারেন কিন্তু একজন সাংবাদিক সেখানে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে থাকল বা না থাকল তা নিয়ে সাংবাদিকের কোন ফিলিংস থাকবেনা। সাংবাদিক দেখবে ক্ষমতাসিনরা তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করছে কিনা। এইজন্যই আবার সাংবাদিকদের বলা হয় ’গার্ডস অব গার্ডিয়ান’ অর্থাৎ অভিবাকদের পাহাড়া দেয়া, তারা যদি কোন ভুল করে তা সংশোধন করা। আর যদি কোন সাংবাদিক কোন দলকে সমর্থন করে বা দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তখন তিনি দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়বেন। নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা থেকে ছিটকে পড়বেন। তিনি চাইলেও সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন না, কারন তিনি তখন পেশার চেয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিবেন। সাংবাদিকদের ভূমিকা হলো সমাজকে সঠিক তথ্য দেওয়া, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ রাখা এবং সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরা। কিন্তু সাংবাদিক যদি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তবে সেই নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সাংবাদিকরা জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করেন, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার কর্মকাণ্ডকে নজরে রাখেন এবং সমাজের আয়না হিসেবে কাজ করেন। সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হলো নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও সততা। অন্যদিকে রাজনীতি হলো ক্ষমতার প্রয়োগ, নীতি নির্ধারণ ও দলীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্র। এই দুই ভিন্ন ভূমিকাকে একসঙ্গে ধারণ করলে দ্বন্দ্ব ও স্বার্থসংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাই সাংবাদিকদের রাজনীতি করা উচিত নয়, এটি শুধু নৈতিক প্রশ্ন নয়, বরং গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও সমাজের আস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
সাংবাদিকতার মূল শক্তি: নিরপেক্ষতা
সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর নিরপেক্ষতা। জনগণ বিশ্বাস করে সাংবাদিক তাদের সামনে সত্যকে তুলে ধরবেন, তিনি কোনো দলের প্রচারণা চালাবেন না। কিন্তু সাংবাদিক যদি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তবে তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখন পাঠক বা দর্শক ধরে নেন যে তিনি আর সত্য প্রকাশ করছেন না, বরং নিজের দলীয় স্বার্থকে এগিয়ে নিচ্ছেন। প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার ক্রোনকাইট একবার বলেছিলেন, গণতন্ত্র সচল রাখতে সাংবাদিকতা অপরিহার্য। কিন্তু এই সাংবাদিকতা যদি দলীয় রাজনীতির প্রভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মন্তব্য:
জুলাই গনঅভ্যুত্থানের ১ম বর্ষপূর্তিতে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত “সাংবাদিক ছাত্র জনতার সমাবেশে” সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ”বিএনপির সাংবাদিক হইয়েন না। আপনারা বিএনপির সাংবাদিক হওয়ারও দরকার নেই। আপনারা দেশের সাংবাদিক হন, বাংলাদেশের জনগণের সাংবাদিক হন, মানুষের সাংবাদিক হন। এটাই হচ্ছে নতুন বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা। সাংবাদিকতার নামে যারা স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়ায়, তারা আসলে সাংবাদিক না। তারা প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ব্যক্তির পক্ষে, একটি দলের পক্ষে অবস্থান নেয় তারা সাংবাদিকতার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তারা হয়ে গেছে দলীয় কর্মী। এই জিনিসগুলো আপনাদের অনুধাবন করতে হবে। আমাদের যেন তাদের মতো চলতে না হয়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।”
সংস্কার কমিশন প্রধানের মন্তব্য:
বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, ”সাংবাদিকতা পেশা থেকে রাজনৈতিক দলবাজি বন্ধ করা প্রয়োজন। পেশার জন্য এটা দরকার, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাংবাদিকতা এবং দলীয় রাজনীতির আদর্শ থেকে খবর সেন্সর করা অথবা বিকৃত করা এগুলো সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে।”
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংবাদিকদের সঙ্গে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, আখতার হোসেন খান, বেগম কামরুন্নেসা হাসান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মোস্তফা সবুজ প্রমুখ।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নৈতিকতা:
বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাংবাদিকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে কড়া বিধিনিষেধ রয়েছে।যুক্তরাজ্যের বিবিসি এডিটরিয়াল গাইডলাইন্স এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ”দর্শক যেন সংবাদ দেখে সাংবাদিকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অবস্থান বুঝতে না পারেন।”যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব প্রফেশনাল জার্নালিস্টস (এসপিজে) এর কোড অব ইথিকস এ সাংবাদিকদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, ”সাংবাদিকরা যেন এমন কোনো সম্পর্ক বা কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হন যা তাদের সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”এগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে সাংবাদিকদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার বিষয়টি কেবল ব্যক্তিগত নৈতিকতা নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পেশাগত মানদণ্ড।
সত্য, তথ্য ও আস্থা:
সাংবাদিকতা মূলত তথ্যনির্ভর একটি পেশা। তথ্য ছাড়া সত্য পাওয়া যায় না, আর সত্য ছাড়া জনগণের আস্থা গড়ে ওঠে না। নোবেল বিজয়ী ফিলিপিনো সাংবাদিক মারিয়া রেসা যথার্থই বলেছেন, ”তথ্য ছাড়া সত্য নেই, আর সত্য ছাড়া আস্থাও নেই।”
কিন্তু একজন সাংবাদিক যদি রাজনৈতিক কারণে তথ্য বিকৃত করেন, তবে জনগণ আর সংবাদমাধ্যমকে বিশ্বাস করবে না। বরং তারা সংবাদমাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ভাববে। এর ফলে সাংবাদিকতার প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে এবং গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়।
সাংবাদিকতার কাজ জনগণের সেবা করা:
সাংবাদিকতার মূল কাজ হলো জনগণের পক্ষে সত্য তুলে ধরা। কিন্তু সাংবাদিক যদি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তবে তার কাজ হয়ে যায় ক্ষমতার সেবা করা। বিখ্যাত মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন, যিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি উন্মোচন করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ”সাংবাদিকের দায়িত্ব হলো জনগণকে সত্য জানানো, ক্ষমতাকে সেবা করা নয়।”
রাজনীতিতে প্রবেশ করলে সাংবাদিকের স্বাধীন অবস্থান হারিয়ে যায়। তখন তিনি জনগণের হয়ে নয়, বরং নিজের দলের হয়ে কাজ করতে বাধ্য হন।
ব্যক্তিগত এজেন্ডা বনাম গণসচেতনতা:
সাংবাদিকতার লক্ষ্য হলো জনগণের সচেতনতা বাড়ানো, তাদের চিন্তাশক্তি উন্নত করা। কিন্তু সাংবাদিক যখন রাজনীতির সঙ্গে জড়ান, তখন তার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রচার করা।
দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রাক্তন সম্পাদক বিল কেলার বলেছিলেন, সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য জনগণের বোধগম্যতা বাড়ানো, সাংবাদিকের ব্যক্তিগত স্বার্থ বা এজেন্ডা সামনে আনা নয়।
জনগণের আস্থা ও ভাবমূর্তি:
ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক পি. সাইনাথ সতর্ক করে বলেছেন, ”সাংবাদিকরা যদি রাজনীতিবিদে পরিণত হন, তবে জনগণ তাদের আর সত্য প্রকাশকারী হিসেবে দেখবে না, বরং দলীয় মুখপত্র হিসেবে ভাববে।”
এই অবস্থায় সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা হিসেবে তার মর্যাদা হারায়। জনগণের চোখে সাংবাদিক আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর:
গণতন্ত্র টিকে থাকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের আস্থার ওপর। সাংবাদিকরা জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করেন। তারা সরকারের সঠিক কাজের প্রশংসা করেন, আবার ভুল-ত্রুটি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
কিন্তু সাংবাদিক যদি নিজেই রাজনৈতিক দলের সদস্য হন, তবে তিনি আর এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবেন না। তখন গণতন্ত্রের জন্য সাংবাদিকতার ভূমিকা ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সংবাদ হয়ে ওঠে প্রচারণা, আর সাংবাদিক হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক কর্মী।
সাংবাদিকের রাজনীতি: অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই সাংবাদিকেরা রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, অনেকে সফলও হয়েছেন। তারা কি ভুল করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি সরাসরি দিচ্ছিনা। তবে আপনারা একটু পিছনের দিকে খেয়াল করলে দেখবেন গত শতাব্দি বা এরও আগে মানুষ বা রাজনীতিবিদের চরিত্র ছিল একরকম। আর এখন তা অনেকটাই পরিবর্তণ হয়েছে। আগে মানুষ সত্য বলতে গর্ববোধ করতেন, ভালো কাজে প্রতিযোগীতা করতেন, দারিদ্রতাকে অহঙ্ককার মনে করতেন কিন্তু এখন আর সেই সততা নেই। এখন মিথ্যা বলার জন্য প্রতিযোগীতা হয়, মানুষকে ঠকানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। কাউকে ঠকাতে পারলেই নিজেকে বিজয়ী মনে করে। মিথ্যা বলে কাউকে খুশি করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আর সেই খুশিতে ক্ষমতাসিনরা তাকে অনৈতিক পুরস্কৃত করে। আর সেই পুরস্কারের লোভে একের পর এক অন্যায়ের পথে ধাবিত হয় বীরদর্পে। কতিপয় লোভী সংবাদকর্মী ক্ষমতাসিনদের অন্যায়কে সমর্থন দেয়ার ফলে শোষকের ভূমিকায় অবতির্ণ হন শাসকগোষ্ঠি। ফলে পুরো জাতির ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া।
উপসংহার:
সাংবাদিকতা ও রাজনীতি উভয়ই সমাজ ও গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এই দুটি ভূমিকাকে একসঙ্গে পালন করা সম্ভব নয়। সাংবাদিকের কাজ হলো জনগণকে সত্য দেখানো, রাজনীতিবিদের কাজ হলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নীতি প্রণয়ন করা। সাংবাদিক যদি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন, তবে তিনি নিরপেক্ষতা হারান, জনগণের আস্থা নষ্ট করেন এবং পেশার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেন। এজন্যই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সবই বলে সাংবাদিকদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত।একজন সাংবাদিকের হাতে থাকে কলম আর সত্য প্রকাশের ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যদি দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তবে সমাজের জন্য তা হবে মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই সাংবাদিকদের উচিত রাজনীতি থেকে দূরে থেকে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করা। এভাবেই সাংবাদিকতা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং সমাজকে সত্যের আলোয় আলোকিত করবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।
এমএসএম / এমএসএম

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া

মানবিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
