ঢাকা রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৫

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?


আবু সাঈদ photo আবু সাঈদ
প্রকাশিত: ২০-৮-২০২৫ বিকাল ৫:৩৫

বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতের প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক সেবা না পাওয়ার বিষয়টি বহু বছর ধরে নাগরিকদের এক বড় হতাশার কারণ। ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন সরকারি দফতর—এসব প্রতিষ্ঠান দেশের মেরুদণ্ড হলেও প্রায়শই দেখা যায়, জনগণ এখানে এসে প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেবাগ্রহীতাদের প্রতি কিছু কর্মচারীর আচরণ এতটাই অবমাননাকর যে তা একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ যেন মনিব-চাকরের সম্পর্ক। যেখানে সরকারি চেয়ারে বসা ব্যক্তি নিজেকে প্রভু মনে করেন আর সেবা নিতে আসা মানুষটি তার দয়া ও করুণার পাত্র।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপের ফলাফল এই চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। জরিপ অনুসারে, মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ স্বেচ্ছায় ঘুষ দেয়। কিন্তু এর পেছনের বাস্তবতা আরও ভয়াবহ: ৩৩ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি ঘুষ গ্রহণ করেন, আরও ৩৩ শতাংশ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ নেন এবং অবশিষ্ট ২১.৬৩ শতাংশ বিভিন্ন অজুহাতে পরোক্ষভাবে ঘুষ আদায় করেন। এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের সামনে একটি কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরে: স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের সমাজ কি আসলেই বদলালো? পরিবর্তন কি শুধু সরকারের দলীয় কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ?
প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের প্রবণতা এক গভীর সমস্যার জন্ম দিয়েছে। যখন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদেরকে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে ভাবতে শুরু করেন, তখন তাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় দলের স্বার্থ রক্ষা করা, জনগণের সেবা নয়। এর ফলস্বরূপ, দক্ষতা, সততা এবং নিরপেক্ষতার মতো মৌলিক গুণগুলো উপেক্ষিত হয়। একজন কর্মকর্তা যখন জানেন যে তার পদোন্নতি বা বদলি নির্ভর করে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ওপর, তখন তিনি জনসেবার পরিবর্তে রাজনৈতিক নেতাদের তুষ্ট করার দিকে মনোযোগ দেন।
এই পরিস্থিতি দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। যোগ্য এবং নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা অনেক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়েন। কারণ রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এতে করে প্রশাসনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কমে যায়।
যখন সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করেন, তখন তারা নিজেদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সরকারি পদকে ব্যবহার করেন। এটি কেবল পেশাগত নীতিমালার লঙ্ঘন নয়, এটি জনগণের আস্থাকেও চরমভাবে আঘাত করে। এ ধরনের আচরণ সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। যখন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, তখন তারা রাজনৈতিক মঞ্চে থাকা প্রকৃত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায়ও লিপ্ত হন।
এর সমাধানের একটি দিক হতে পারে, যারা প্রশাসনিক পদে থেকে রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, তাদের জন্য একটি স্পষ্ট নীতি প্রণয়ন করা। হয় তারা রাজনীতি করবেন, নতুবা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। যারা রাজনীতিতে আগ্রহী, তাদের চাকরি ছেড়ে পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিতে যোগদানের সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে করে একদিকে যেমন প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে, তেমনি সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের জন্যও একটি সুষম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হবে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মানে জনগণের সেবক। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আচরণ থাকে উল্টো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের 'শাসক' মানসিকতা আজও অনেকের মধ্যে বিদ্যমান। তারা ভুলে যান যে তাদের বেতন আসে জনগণের করের টাকা থেকে, এবং তাদের প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের সেবা নিশ্চিত করা।
এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য একটি বড় ধরনের মানসিকতা এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন। প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে যে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলি যেন মেধা, যোগ্যতা এবং সততার ভিত্তিতে হয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়। দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত নৈতিকতা ও আচরণবিধি বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি, যেখানে তাদের জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখানো হবে।
একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং জনবান্ধব জনপ্রশাসন। যে প্রশাসন হবে জনগণের বন্ধু, রাষ্ট্রের কর্মচারী—কোনো রাজনৈতিক দলের ভৃত্য নয়। যে পুলিশ হবে জনগণের নিরাপত্তার প্রহরী, শাসক নয়। যে আমলা হবেন নীতি বাস্তবায়নের কারিগর, রাজনৈতিক খেলায় অংশ নেওয়া খেলোয়াড় নয়।
আমাদের স্বপ্ন, একদিন আমরা এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দেখব যেখানে আমলা এবং কর্মকর্তারা হবেন জনগণের সেবক। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হবে জনগণের জন্য সেবা নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক চাপ বা দলীয় আনুগত্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হবে সবার জন্য সমান। তারা কোনো দলীয় স্বার্থে কাজ না করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। প্রতিটি সরকারি দফতর হবে স্বচ্ছ। সেখানে সেবা পেতে কোনো ধরনের হয়রানি বা ঘুষের শিকার হতে হবে না। এই পরিবর্তন একদিনে আসবে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের সচেতনতা। জনগণের পক্ষ থেকে যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ আসবে এবং সরকার যখন সত্যিকার অর্থে প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার পদক্ষেপ নেবে, তখনই আমরা দেখতে পাব এক নতুন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের কর্মচারীরা সত্যিকার অর্থেই জনগণের কর্মচারী হিসেবে কাজ করবেন।
লেখক:মো: আবু সাঈদ; ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

এমএসএম / এমএসএম

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া

মানবিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস ২০২৫ : গল্পের মাধ্যমে গড়ে উঠুক সচেতনতার বাঁধ