বৈষম্যের শিকার হয়ে ন্যায্য পদোন্নতি পাননি সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ
এই লেখাটি লিখতে বসে নিজের কাছে লজ্জিতবোধ করছি। যখন পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ঘোষণা এলো যে হাসিব আজিজ সাহেবকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সাথে সাথে আমি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট সকলকে মন থেকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই এবং চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কারণ, সঠিক সময়ে একজন সঠিক মানুষকে মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং উপযুক্ত একজন পুলিশ কমিশনার হিসেবে আমরা হাসিব আজিজ সাহেবকে পাচ্ছি। এধরনের নীতিমালা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমরা জনবান্ধন একটি পুলিশ বাহিনী পাবো।
বিগত সময়ের রাষ্ট্রের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আমাদের গৌরবময় পুলিশ বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পুলিশ এবং জনগণকে মুখোমুখি করে রাজপথ রক্তাক্ত করা হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা, যা নিয়ে পরে বিস্তারিত আলাপ করব -আমি সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে মনে মনে বললাম, এই মানুষটির দোষ কী? দীর্ঘ বছর ধরে ন্যায্য পদোন্নতি না পেয়ে থাকার কী কারণ? আমার জানামতে, হাসিব আজিজ সাহেব একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, মেধাবী ও চৌকস পুলিশ অফিসার, যিনি কখনও নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী কাজ করেননি।
১৫ তম বিসিএস ব্যাচের একজন পুলিশ অফিসার হওয়ার পরও তিনি আজও পরিপূর্ণ ডিআইজি হতে পারেননি—এটা বলা ভুল হবে। বরং বলতে হবে, তাঁকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা দেওয়া হয়নি, যা একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও বিচক্ষণ পুলিশ অফিসারের জন্য বড় ধরনের অবমাননা ও অন্যায়। পদোন্নতি পাওয়া তাঁর আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এটা স্পষ্টতই রাষ্ট্রীয় অন্যায়। অন্যদিকে, ১৫ তম বিসিএসের অধিকাংশই ইতোমধ্যে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন; কেউ কেউ অতিরিক্ত আইজিপি পদেও রয়েছেন। এমনকি ২০তম বিসিএসের পুলিশ অফিসাররাও এখন ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি নুরে আলম মিনা, ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবসহ বহু কর্মকর্তাকে রাতারাতি ডিআইজি হতে দেখা গেছে, কারণ তাঁরা শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। আর এভাবেই তাঁরা নানা অপকর্মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। একজন সাবেক আইজিপির সন্তান এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হাসিব আজিজকে কেন পদোন্নতি দেওয়া হলো না? এতে বোঝা যায়, এটি কোন একমাত্রিক বৈষম্য নয়। এটা এক গভীর রাজনৈতিক পক্ষপাতের ফলাফল। আমাদের দেশে এই নিয়মটি যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে—গোপালগঞ্জ বা ফরিদপুর না হলে আওয়ামী লীগের সময়ে পদোন্নতি মেলে না, আর বিএনপির সময়ে না হলে বগুড়া বা ফেনি। এরশাদের আমলে যেমন রংপুরের লোকেরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতেন, এখন তেমনই গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বঙ্গবন্ধু কি শুধু গোপালগঞ্জের নেতা ছিলেন? তিনি তো সারা বাংলার নেতা, জাতির জনক। তাহলে কেন এই বৈষম্যের ছায়া?
আমরা দেখেছি, গোপালগঞ্জ হলে যেন কোনো অপরাধ নেই; কনস্টেবলের বাড়ি যদি গোপালগঞ্জ হয়, তাহলে তার কথা ওসিকে মানতেই হবে। আর যদি ওসির বাড়ি গোপালগঞ্জ হয়, তাহলে সেই এসপিকেও ওসির কথা মানতে হবে। এই ধরনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের ইতিহাস এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এমনকি যদি সেই ব্যক্তি রাজাকারও হন, তাতেও কোনো সমস্যা নেই, কারণ তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। আমার প্রশ্ন, গোপালগঞ্জে কি বঙ্গবন্ধুর বিরোধী কেউ ছিল না? সত্য কথা বলতে, গোপালগঞ্জের নামে আজ যে লুটপাট ও বৈষম্য চলছে, তা শুধু পুলিশ বিভাগেই নয়; দেশের প্রতিটি স্তরে এ অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম, লুটপাট, দুর্নীতি ও ঘুষের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে গোপালগঞ্জের কিছু মানুষ। এরা পুলিশের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে, এবং যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতি না পাওয়ার এই বৈষম্য তারা আরও জোরদার করেছে।
আজকের দিনে দেখা যাচ্ছে, গোপালগঞ্জের বাড়ি হলে যোগ্যতা না থাকলেও রাতারাতি বড় পদে বসানো হয়, আর অন্যদিকে সত্যিকারের যোগ্য ব্যক্তিরা ত্যাগ স্বীকার করতে বাধ্য হন। হাসিব আজিজের মতো যোগ্য অফিসারদের ওপর এই অবিচার কেন? ৭০ ভাগ পুলিশ কর্মকর্তা নানা ধরনের হয়রানি ও অবিচারের শিকার হয়েছেন, যা কোনো একদিন অবশ্যই প্রকাশ পাবে। শেখ হাসিনা তাঁর দলীয় আনুগত্য বজায় রাখতে গিয়ে সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসারদের উপেক্ষা করেছেন। আমরা জানি, জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া শেখ হাসিনার জন্য এক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। যার ফলে আজ বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এটি এক লজ্জার বিষয়, কারণ আমিও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিশ্বাস করতাম। কিন্তু আজ শেখ হাসিনার বৈষম্যমূলক নীতির কারণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
আমি আশা করি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের নতুন কমিশনার হিসেবে হাসিব আজিজ সাহেব তাঁর মতো যারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তাদের সঠিক মূল্যায়ন করবেন। কারণ তিনিও জানেন, পদোন্নতির বঞ্চনা ও অবহেলার কষ্ট কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। আমি একটু হাসিব আজিজ সাহেবের দায়িত্ব প্রাপ্তের উপর কিছু কথা বলে দেখে- হাসিব আজিজ: চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের নতুন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হচ্ছেন- হাসিব আজিজ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। দেশের এই সংকটময় সময়ে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধি এবং চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি এই পদে আসীন হয়েছেন। হাসিব আজিজ শরীয়তপুর জেলার শফিপুর থানার সন্তান। তিনি একজন সাহসী ও সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে তিনি ঢাকা সিআইডিতে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ১৪ দিন পর, ৩০শে ডিসেম্বর হাসিব আজিজের জন্ম। ১৯৯৫ সালে ১৫তম বিসিএস পাস করে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। যদিও তিনি একজন সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসেবে খ্যাত, তাঁকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ১৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও তিনি সময়মতো পদোন্নতি পাননি। যেখানে তাঁর সমসাময়িক অনেকে ইতোমধ্যে আইজি পদে পৌঁছেছেন, সেখানে তিনি এখনো অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে সিআইডিতে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে, হাসিব আজিজ একজন সুনামধন্য পুলিশের আইজিপি এম আজিজুল হক সাহেবের সুযোগ্য সন্তান। এম আজিজুল হক ১৯৮১ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদের মার্শাল ল'র সময় তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চার মাসের জন্য কমিশনার ছিলেন। ১৯৮২ সালে সিএমপি থেকে তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁর কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে, তিনি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এই হাসিব আজিজ সাহেবকে চট্টগ্রামের মানুষ তাঁর মতো একজন সৎ ও অভিজ্ঞ অফিসারকে পুলিশ কমিশনার হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তারা আশা করছে, তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে এবং পুলিশের গৌরব ও সুশৃঙ্খলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। হাসিব আজিজের নিয়োগ এমন একটি সময়ে হয়েছে যখন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটাপন্ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী হামলা এবং দলীয় ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় হাসিব আজিজের মতো একজন সাহসী এবং সৎ পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্ব চট্টগ্রামবাসীকে আশার আলো দেখাচ্ছে। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, এবং দায়িত্বশীলতা শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও সুসংহত করতে পারবে বলে সাধারণ মানুষ মনে করছে।
হাসিব আজিজের পেশাগত জীবন যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনেও তিনি একজন উচ্চ নৈতিকতার অধিকারী। সততা এবং ন্যায়পরায়ণতার মাপকাঠিতে তাঁকে অন্যান্য অনেক পুলিশ অফিসারের চেয়ে আলাদা মনে করা হয়। তাঁর বাবার মতোই তিনিও প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগে এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বসূরি এম আজিজুল হকের সুনাম ও শিক্ষাও চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নতুন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর, হাসিব আজিজ চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। সন্ত্রাস দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ, সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থা, এবং সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা পুনরুদ্ধার করা তাঁর প্রথম দিকের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাঁর নেতৃত্বের অধীনে পুলিশ প্রশাসনের সংস্কারের কাজটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা গেলে চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুতই আরও উন্নত হবে। চট্টগ্রামের মানুষ এবং সকল শুভাকাঙ্ক্ষীর পক্ষ থেকে আমরা তাঁর সফলতা কামনা করছি। আশা করছি, তিনি তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন এবং দেশের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করবেন।
লেখকঃ সাংবাদিক, গবেষক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক মঞ্চ, চট্টগ্রাম।
T.A.S / এমএসএম