মরতে বসেছে ন্যাচারাল মেগা ইন্ডাস্ট্রি হালদা

বাংলাদেশের ন্যাচারাল মেগা ইন্ডাস্ট্রি বলা হয় হালদাকে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। অপার জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যসম্পদে ভরপুর এ নদী জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে আসছে। এ নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয়, এটি যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস। হালদা থেকে আসে বছরে ৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক ওই মৎস্য প্রজনন কারখানাটি আজ মৃত্যু পথযাত্রী।
একসময় বাংলাদেশ ছাড়া হালদার পোনা ভারত ও মায়ানমার রপ্তানি হতো। অনিয়ন্ত্রিতভাবে নদীর বাঁক কেটে সোজা করা,ক্ষতিকর জাল দিয়ে মাছ আহরণ,অবাধে মা মাছ শিকার,বন উজাড়ের ফলে নদীর শাখা খালগুলো ক্রমাগত ভরাট ও অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট নির্মাণ প্রভূতি মানবসৃষ্ট নানা কারণে জীববৈচিত্র নষ্টসহ হালদা মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হতে বসেছে। বিগত কয়েক যুগ ধরে মিঠা পানির মাছের গুণগতমান সম্পন্ন পোনার আকাল চলছে। অবাধে পোনা ধরার কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে হালদার গলদা চিংড়ি। চার দশক আগে দেশের ৭০ ভাগ মাছের পোনার চাহিদা মেটাতো হালদা নদী। এখন অর্ধেকও মেলে না।
রুই জাতীয় মাছের (রুই,কাতলা,মৃগেল ও কালিবাউশ) পোনার জন্য এ নদীর আলাদা একটি বৈশিষ্ট থাকলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এবং পরিবেশ দূষণসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রাকৃতিক এ মৎস্য ভান্ডার এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এমনকি সরকারি টাকায় নিজেদের বাড়িতেই মৎস্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হ্যাচারি নির্মাণ করা হয়েছে। আর হালদার দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ ইট ভাটা আর বালু মহল। এশিয়ান পেপার মিল থেকে বানের মতো ঢুকছে শিল্প বর্জ্যযুক্ত বিষাক্ত পানি। কিন্তু চোখ বন্ধ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
নদীর উৎপত্তি :
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়নগরের পাহাড় হতে সৃষ্ট হয়ে এ নদী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সর্ব-উত্তরের সীমানা বাগানবাজার,আঁধারমানিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাউজান-হাটহাজারী উপজেলা অতিত্রম করে চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাট নামক স্থানে হালদা কর্ণফুলী নদীর সাথে মিশে গেছে। নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৫ কিলোমিটার।
যে কারণে ন্যাচারাল মেগা ইন্ডাস্ট্রি :
হালদা নদী বাংলাদেশের ্অন্যতম বৃহৎ রুই মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। ডিম থেকে উৎপাদিত রেনু পোনা থেকে মাছ হিসাবে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাতে হালদা নদী চার ধাপে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী একটি কাতলা মাছের ডিমের সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে ৩৫ লাখ (৫ কেজিÑ২০কেজি), সুতরাং নিশ্চিতভাবে এর গড় সংখ্যা হবে ২৫ লাখ। একটি মা মাছ থেকে এক বছরে চার ধাপে আয় করা যায়। ১ম ধাপে ডিম থেকে রেণু বিক্রি করে (৪ দিন বয়সের), ২য় ধাপে ধানী পোনা বিক্রি করে (২০-২৫ দিন), ৩য় ধাপে আঙ্গুলী পোনা বিক্রি করে (১-২মাস), ৪র্থ ধাপে এক বছর বয়সে মাছ হিসাবে বাজারজাত করে। এই প্রতি ধাপে মৃত্যু হার ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ বাঁচার হার ৬০% ধরে হিসাব করলে একটি কাতলা মাছ প্রতি বছর হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার। এই হিসেবে হালদার প্রতিটি মা মাছকে একেকটি প্রাকৃতিক এগ্রো মেগা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে অভিহিত করছে হালদা গবেষক এবং চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা।
জেলা মৎস্য কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হালদা নদী থেকে বিগত ১০ বছরে প্রাপ্ত রেণুর পরিমাণ হিসাব করলে দেখা যায় যে , গড় রেণু প্রাপ্তির পরিমাণ থেকে ৬০৪.৬৪ কেজি। একই পদ্ধতিতে এক বছরের চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ । নদী হিসেবে এককভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে হালদা। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। হালদাকে আঁকড়ে আছে প্রায় তিন হাজার জেলে পরিবার ।
প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সংকট :
শুষ্ক মৌসুমে হালদা নদীতে সমুদ্রের লবণাক্ততার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি নদীর অনেক ভিতরে প্রবেশ করে। ২০০৮ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে হালদা নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা এত বেশি ছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা এই পানি পানের অযোগ্য ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রের পানিতে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অশনি সংকেত বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। এ সময় রুই জাতীয় মাছগুলো অন্যান্য নদী থেকে মাইগ্রেট করে হালদা নদীতে আসে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে রুই জাতীয় মাছের মাইগ্রেশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রজনন ক্ষেত্রের পানির গুনাগুণ পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রজনন পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার আশংকা রয়েছে।
বিগত কয়েক দশক ধরে এ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের ডিমের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তার কারণ হিসাবে মৎস্য গবেষকরা বলেছেন,পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে লবণাক্ত পানির আগ্রাসন, কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ, নদীর দুপাশের উপ-খালসমূহে অপরিকল্পিত সুইস গেইট নির্মাণ। এতে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের লবণাক্ততা পানির আগ্রাসন আরো উজানের দিকে আসার সুযোগ পেয়েছে, যা হালদার নদীর মৎস্য প্রজননে যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হালদা নদী পুনরুদ্ধারের নামে অনেকগুলো বাঁক কেটে দেওয়ায় নদীর দূরত্ব কমে এসেছে, ফলে নদীর স্রোতের গতিবেগ স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিগত কয়েক বছর আগে হালদা পুনরুদ্ধারে কয়েকটি প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশগত বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে ইকোসিস্টেমের পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত, পানির ফুড চেইন পরিবর্তন এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের পাশাপাশি নদীর জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক হুমকির সম্মুখিন হচ্ছে।
হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা গ্রামের কামাল উদ্দিন তাঁর অতীত স্মৃতি রোমস্থন করে বলেন,‘দুই দশক আগেও হালদা মাছে ভরপুর ছিল। জাল নিয়ে নামলে কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন মাছ মারতে সারাদিন ব্যয় করেও এককেজি মাছ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।’
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া নদীটির গুরুত্ব সম্পকে বলেছেন, হালদা নদীর সম্পদ, ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক অবদান বিবেচনা করলে এ নদী বাংলাদেশের জাতীয় নদীর স্বীকৃতি পাওয়ার উপযুক্ত তেমনি বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য এটি আমাদের দেশের জাতীয় মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্যের দাবিদার। অথচ গুণগত গবেষণা, সঠিক তথ্য-উপাত্ত ও প্রচারের অভাবে এখনো হালদা নদীর জাতীয় ঐতিহ্যে সম্পর্কিত পরিচয় সবার দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে। হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। বর্তমানে ইনব্রিডিং-এর কারণে মাছের বৃদ্ধি মারাত্বক ভাবে ব্যহত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য হালদা নদী এই প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক সংরক্ষণের বিকল্প নেই।
বদলে যাচ্ছে হালদা নদী:
পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতির বলয়ে হালদা নদী। ২০টি উপ-খাল ও ৩৪টি ছোট পাহাড়ি ছড়ার সঙ্গে মিতালী রয়েছে হালদার। এ হালদার বুকে প্রতিদিন ঠাঁয় হচ্ছে কয়েকশ’ কলকারখানা,ইট-ভাটা,টেনারী ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য। হালদার স্বচ্ছ পানির নীলাবরণ পরিণত হয়েছে খয়েরি রঙ্গে। পানিতে উৎকট গন্ধ। অনেক জায়গায় মাছ নেই। জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণেও নদীর চরিত্রে নৈতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ১৯৯৫ সালে হালদা নদী থেকে যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির ৩২ কোটি ৬০ লাখ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। এবার অর্থাৎ (২০২১ সাল) তার সংখ্যা মাত্র সাড়ে ৬ হাজার কেজি। নদীতে আগের মতো মাছের রমরমা অবস্থা আর নেই। ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় ১৫ প্রজাতির মাছ। নদীর এ যাবত ১১টি বাঁক কেটে ফেলার কারণে নদীর গতি প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। রাক্ষুসে হয়ে উঠেছে নদীটি। ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। অল্প সময়ের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে হালদায়।
সরেজমিনে হালদা নদী ঘুরে এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে,দেশীয় মাছের বীজভান্ডার হালদা বিশ্বের একমাত্র স্্েরাতন্বিনী (টাইডাল) নদী। নদীর গতি প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। নদীর ১১ টি বাঁক কেটে দেয়ায় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে শত শত বসত বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান। নদী পাড়ের মানুষ পরাস্ত,পযুদস্ত হচ্ছে। ঢাকার শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গার ভাগ্যেবরণ করতে যাচ্ছে হালদা। নদীর অদূরে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা। যার সংখ্যা শতাধিক। এসব কারখানার নির্গত বর্জ্যে হালদার প্রজনন ক্ষেত্র চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। চট্টগ্রাম হাটহাজারী সড়কের নন্দিরহাট সংলগ্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে পেপার মিল, কুলগাঁও ও কালুরঘাট অবনক্্রাস শিল্প এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ট্যানারি, ক্ষতিকর বর্জ্য ও নিক্ষেপকারী শিল্প কারখানা। ২১টি ইট ভাটা রয়েছে হালদা নদীর দু’তীরে। হালদা অভয়াশ্রম এলাকায় রয়েছে ১৪টি ইটভাটা। ভাটাগুলো হালদা পাড়ের মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ইটভাটার কয়লার উচ্চ মাত্রার সালফার এবং হেভী মেটালস এর কারণে নদী দূষণ বাড়ছে। এছাড়া হালদার হাটহাজারী অংশে নির্মিত হচ্ছে অসংখ্য ছোট-বড় কারখানা। এসব কারখানার কোন কোনোটিতে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য পরিশোধনের ট্্িরটমেন্ট প্ল্যান্ট নেই। নদী পাড়ের বাসিন্দারা জানান, হালদা নদীকে সবচেয়ে দূষণের কবলে ফেলেছে এশিয়াটিক পেপার মিল। এর অবস্থান হালদা নদীর অভয়াশ্রম থেকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরে এবং হালদা নদীর প্রধান উপ-নদী মাদারী খালের কাছে। স্বাভাবিকভাবে এসব কারখানার নির্গত বর্জ্য মানিকছড়ি খাল,হারুয়ালছড়ি খাল,রুরং খাল এবং সর্তা খাল দিয়ে প্রবেশ করছে। তাতে দূষিত হচ্ছে হালদার স্বচ্ছ পানি। স্বাভাবিক ভাবে বিঘ্ন ঘটছে মাছের প্রজনন। এ যাবত হারিয়ে গেছে ১৫ প্রজাতির হালদার মাছ। বছরের পর বছর এখানে বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে তেমন আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। গুমানমর্দন,নাঈলমোড়া,নোয়াজিশপুর,ছিপাতলী,মুৎসুদ্দি পাড়া, সর্তা,ফটিকা, অংকুরীঘোনা, গড়দুয়ারা, চানখালি, পাড়াখালি, কাগতিয়া, সোনাইমুখ, মুন্সিরহাট, মাদারিকুল,কাটাখালি,বাড়িঘোনা, মইশকরম,বুড়িশ্চর ও কচুখাইনের ২০ হাজার জেলে এখন সম্পূর্ণ বেকার। কারণ নদীতে মাছ নেই।
হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্লান্টের বর্জ্যরে কারণে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা মৎস্য শুণ্য অবস্থা বিরাজ করছে। ওই এলাকার জেলে তপন জলদাস নামের প্রবীনব্যক্তি জানান, আগে যেখানে কিছু হলেও মাছ পাওয়া যেত, এখন বর্জ্যরে মাত্রাতিরিক্ততার কারণে মাছ নেই বললেই চলে।
হালদা নদীর বিভিন্ন জায়গায় চর জেগে উঠেছে। নদীর গভীরতাও কমছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে উল্লেখ করে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানান, হালদা এসময় ২০ থেকে ২৫ ফুট, ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত গভীর ছিল। এখন গভীরতা অনেক কমেছে। হালদা নদীর সবচেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১২টি স্লুইস গেইট। স্লুইস গেইটগুলোর কারণে মাছ চলাচল ও প্রজনন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। হালদা নদী থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা দীর্ঘদিন যাবত নগরীতে পানি সরবরাহ করায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে হালদার ওপর। কর্ণফুলী নদীর পানিতে বিপজ্জনক মাত্রার পরিশোধনের অযোগ্য রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত হওয়ায় তা হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে।
জলবায়ু পরিবতর্নের প্রভাব
জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে হালদা নদী রূপ পাল্টাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে হালদার জন্য সবচেয়ে বেশী জরুরী। হালদা নদী একটি টাইডাল নদী যেখানে সমুদ্রের জোয়ার ভাটার প্রভাব রয়েছে। সমুদ্র থেকে এ নদীর দূরত্ব মাত্র ১০-১২ কি. মি.। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে হালদা নদীতে। জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি নদীর অনেক ভিতরে প্রবেশ করে। সম্প্রতি হালদা নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা এত বেশি বেড়ে গেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা এই পানি পানের অযোগ্য ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রের পানিতে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অশনি সংকেত। এ সময় রুই জাতীয় মাছগুলো অন্যান্য নদী থেকে মাইগ্রেট করে হালদা নদীতে আসে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে রুই জাতীয় মাছের মাইগ্রেশন বাধাগ্রস্ত হয়। প্রজনন ক্ষেত্রের পানির গুনাগুণ পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রজনন পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার আশংকা রয়েছে।
মাছ ও জলজীবের শারীরবৃত্তিয় পরিবর্তন :
দুষণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে হালদা নদীর মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটছে। মৎস্য বিজ্ঞানীরা হালদার মাছ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যে রিপোর্ট দিয়েছে-এতে বলা হয়েছে ,প্রকারভেদে উল্লেখযোগ্য পরিমান কীটনাশক মাছের দেহে পুঞ্জীভূত বা শোষিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় মাছের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বৃক্ক,যকৃৎ , ফুলকা,পাকস্থলী,মস্তিস্ক,ত্বক ও মাংসপেশী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ বিভিন্ন প্রকার ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে। কীটনাশক ও রাসায়নিক বর্জ্যরে কারণে হালদার মাছের পরিপক্কতা ও প্রজনন ক্ষমতা হ্্রাস পাচ্ছে।
মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের রোগ বালাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে হালদা নদীতে প্রতি বছর প্রচুর মাছ ও অন্যান্য জলজবীজের ব্যাপক মৃত্যু ঘটছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো.মনজুরুল কিবরীয়া হালদা মৎস্য উৎপাদন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, বিগত কয়েক দশক ধরে এ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের ডিমের পরিমাণ কমে যাওয়ার উলেখযোগ্য কারণ হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে লবণাক্ত পানির আগ্রাসন, কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ, নদীর দু’পাশের উপ-খালসমূহে অপরিকল্পিত স্লুইস গেইট নির্মাণ। এতে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের লবণাক্ততা পানির আগ্রাসন আরো উজানের দিকে আসার সুযোগ পেয়েছে, যা হালদার নদীর মৎস্য প্রজননে যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
হালদার গলদা চিংড়ি:
হালদার গলদা চিংড়ির রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। ঠেলাজাল,ঘিরাজালের মত বিধ্বংসী জাল দিয়ে অবাধে পোনা ও চিংড়ি শিকারের কারণে বিলুপ্ত হতে চলছে হালদার বিখ্যাত গলদা চিংড়ি। গবেষকরা জানান, একটি পরিপক্ক গলদা চিংড়ি এক সাথে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার ডিম ছাড়ে। রুই জাতীয় মাছের পরে হালদার নদীর অন্যতম প্রধান ফিশারী হচ্ছে গলদা চিংড়ি। প্রতিবছর কর্ণফুলী মুখ থেকে মাদারীখালের মুখ পর্যন্ত প্রায় ৫৩০ জন লোক গলদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করে। এদের অধিকাংশই যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা বাগেরহাট অঞ্চলের বাসিন্দা। এসব গলদা পোনা যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা গলদা চিংড়ি খামারগুলোতে সরবরাহ করে। এভাবে প্রতি বছর মার্চ-জুন এই ৪ মাস গলদা রেণুর সাথে আসা হালদা নদীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মাছের পোনা তাঁরা নষ্ট করছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন একজন পোনা সংগ্রহকারী ১টি চিংড়ি পোনার জন্য ৯৭টি অন্যান্য মাছের পোনা ধ্বংস করছে। প্রতিদিন ১ জন লোক সর্বনিু ১৫০টি চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করে। সেই হিসাবে প্রতিদিন ৭ কোটি ৭১ লক্ষ ১ হাজার ৫ শত অন্যান্য মাছের পোনা ধ্বংস করছে। এভাবে চার মাসের হিসাব করলে হালদা নদীর মৎস্য সম্পদ ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র যেমন ফুটে উঠে, তেমনি এই নদীর সমৃদ্ধ গলদা চিংড়ি ফিশারীর অপার সম্ভাবনার ইংগিত বহন করে।
হালদা হতে পারে মেকং নদী :
হালদাকে তুলনা করা যেতে পারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদী মেকং-এর সাথে। মায়ানমার,চীন,কম্বোডিয়া, লাওস,ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড যৌথভাবে একটি সম্বনিত নদী কমিশন গঠন করে মেকং নদীতে মৎস্য চাষের মাধ্যমে তাঁদের সারাবছরের মাছের চাহিদা পূরণ করছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে,সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেয়া হলে হালদা খেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু এখানে যা হচ্ছে তা হলো অপরিকল্পিতভাবে মৎস্য পোনা নিধন ও মা মাছ শিকার । যা হালদার অমিত সম্ভনাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে,পৃথিবীর ৬টি দেশের ওপর দিয়ে প্রবহমান মেকং নদীর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার এলাকা নিয়ে একটি সম্বন্বিত নদী কমিশন গঠন করা হয়েছে।এই ছয় দেশ যৌথভাবে সিদ্ভান্ত নেয় যে,বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত (তাদের বর্ষা মওসুম) এ নদী থেকে মাছ শিকার বন্ধ থাকবে। এ সময় নদীতে মৎস্য প্রজননের সময়। কেউ মাছ ধরলে আইনগত শাস্তি ভোগ করতে হয়। এই ৫ মাস শিকার বন্ধ থাকার কারণে পরবর্তীতে নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত মাছ ধরার জন্য মেকং নদী উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। এসময় জেলেরা নদী থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করে বাজারজাত করে।
উল্লেখিত দেশগুলোর চাহিদার অধিকাংশ মাছ বর্তমানে সরবরাহ হয় মেকং নদী থেকে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের হালদা,কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীতে বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মাছ শিকাক্বন্ধ করে দেয়া হলে এ অঞ্চলের মাছের অভাব থাকবে না।
এমএসএম / জামান

ফেসবুক ছিল বিনোদনের জায়গা, এখন আয়ের মূল উৎস

তোমাদের মৃত্যুর দায় আমরা এড়াতে পারি না

সুফি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার ১ যুগ পার করল সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন

ব্যতিক্রমী ধারার আলো নেভার পথে

টেকসই কৃষির জন্য চাই জৈব বালাইনাশক

ঈদযাত্রা হোক দুর্ঘটনামুক্ত

রমজানে ভ্রমণে যে বিষয় মেনে চলা জরুরি

সুস্থ থাকার জন্য কেমন পানির ফিল্টার নির্বাচন করবেন

সাপের ক্ষিদে মেটাতে পাখিশূন্য দ্বীপ

একদিনের ট্যুরেই ঘুরে আসুন চীনামাটির পাহাড়ে

আধ্যাত্মিকর যাত্রা পথে সুফি মেডিটেশন এর গুরুত্ব

খাজা ওসমান ফারুকীর কুরআন দর্শন
