ঢাকা বৃহষ্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫

ব্যতিক্রমী ধারার আলো নেভার পথে


ইভা আক্তার, গবি photo ইভা আক্তার, গবি
প্রকাশিত: ২৪-৪-২০২৫ দুপুর ১:৩৯

এক সময় যে বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম নিয়েছিল একটি বিপ্লবী স্বপ্ন ও আদর্শিক দীপ্তি নিয়ে, আজ সেটির প্রাণশক্তি কি টিকে আছে? প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মানবিক দর্শন ও গণমানুষের জন্য শিক্ষা বিস্তারের যে স্বপ্ন থেকে গড়ে উঠেছিল গণ বিশ্ববিদ্যালয় (গবি), তা কি এখনো জীবন্ত? নাকি হারিয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট বাস্তবতায়? সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অভিমত তুলে ধরেছেন ইভা আক্তার

"আদর্শের দীপ্তি মাড়িয়ে ভণ্ডামির ধ্বংসস্তূপে"

এক সময় গণ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কেবল একটি শিক্ষালয় নয়—একটি আদর্শিক আন্দোলনের নাম। যেখানে অসাম্প্রদায়িকতা, গণমানুষের অধিকার আর নৈতিক দৃঢ়তা ছিল চেতনার ভিত্তি। ক্লাসরুমে শুধু পাঠ্য বই নয়, জন্ম নিত ভবিষ্যতের বিপ্লব। আমরা শিখতাম, শেখাতাম, প্রশ্ন তুলতাম, সত্যের পক্ষে দাঁড়াতাম। কলমে থাকত প্রতিবাদের শব্দ, কণ্ঠে থাকত বজ্রনিনাদ। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিপ্লবী দর্শন আমাদের চালিকা শক্তি ছিল। তাঁকে আমরা নিজের হাতে এনেছিলাম ক্যাম্পাসে—যদিও তার জন্য প্রশাসনের হুমকিও খেতে হয়েছিল। অথচ সেদিনের রেজিস্ট্রারই পরে তাঁর জন্য চেয়ার ঠিক করছিলেন—এটাই ছিল সময়ের দ্বন্দ্ব ও ভণ্ডামির সূচনা। আজ সেই বিদ্রোহী চেতনার স্থান নিয়েছে কর্পোরেট কাঠামো। জাফরুল্লাহ চেতনার যে আগুন একসময় জ্বলেছিল, তা আজ নিভু নিভু। বর্তমানের ‘গণস্বাস্থ্য কর্মী’রা কেবল খোলস ধরে রেখেছেন, আত্মা হারিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন ফি বাড়ানো, গ্রামে পাঠানো বন্ধ, ও নিয়োগে দুর্নীতির মতো সঙ্কীর্ণ চর্চায় লিপ্ত। এসবই ডা. জাফরুল্লাহর ভাবনার বিপরীত। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত নেতৃত্ব, সাহস আর সত্যের পীঠস্থান। ডিগ্রি নয়, গড়তে হবে মানুষ। মনে রাখো—ডা. জাফরুল্লাহকে মুখে নয়, হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। তাহলেই দীপ্তি আবার জ্বলবে, লেখা হবে নতুন ইতিহাস। 

ড. পবিত্র কুমার শীল
সাবেক শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
সিইও, চিকিৎসা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। 

"চেতনার যে আগুন নিভে যেতে চায় না"

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন চিকিৎসক হয়েও অনেক বেশি—একজন দূরদর্শী, এক স্বপ্ন নির্মাতা। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এমন এক প্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষা মানে ছিল মানুষ গড়া, পেশাদার নয়, নৈতিক নাগরিক তৈরি। আমি, একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে, সেই স্বপ্নের অংশ হতে চেয়েছিলাম। কল্পনা করেছিলাম এমন এক জায়গা, যেখানে শ্রদ্ধা, সহানুভূতি আর প্রতিবাদের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু আজ, গণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই হারাচ্ছে সেই প্রগতিশীল চেতনা। শিক্ষা হয়ে উঠেছে কর্পোরেট চাকরির সিঁড়ি। প্রতিবাদ করলেই হুমকি, নিঃশব্দতার দেওয়াল। একজন নারী হিসেবে দাঁড়াতে গেলে শুনতে হয়—“চুপ থাকো, সমস্যা হবে।” অথচ আমি জানি, স্যার বেঁচে থাকলে বলতেন, “এভাবেই দাঁড়াতে হয়, এখান থেকেই শুরু হয় বিপ্লব।” বিপ্লব মানে দেয়ালে স্লোগান নয়—প্রতিদিনের জীবনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমি জানি, এখনো অনেকে আছেন, যারা প্রশ্ন করেন, চুপ থাকেন না। তাঁদের মধ্যেই বেঁচে আছেন জাফরুল্লাহ। গণ বিশ্ববিদ্যালয় একটি নাম নয়, একটি চেতনা। প্রশ্ন হলো—আমরা কি তা ধরে রাখতে পারব, নাকি হারিয়ে ফেলব চিরতরে? আমি স্বপ্ন দেখি এমন এক শিক্ষাঙ্গনের—যেখানে শিক্ষক হবেন পথপ্রদর্শক, নারী হবেন নেতৃত্বের প্রতীক, আর প্রযুক্তি হবে মানবসেবার হাতিয়ার। 

নাহিদা আক্তার নূরী
৩য় বর্ষ, রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়।


"আমাদের লাল দুর্গ: এক আত্মজিজ্ঞাসা"

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল ইটের দেয়ালে পা রাখার প্রথম মুহূর্তে মনে হয়েছিল—প্রবেশ করছি এক বিকল্প স্বপ্নের ঘরে। এখানে শিক্ষা ছিল প্রতিরোধ, চিন্তা ছিল প্রতিবাদ। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কেবল ডিগ্রির জায়গা নয়, বরং অবস্থান জানানোর মাঠ। সেখানেই শিখেছিলাম—নীরবতা অনেক সময় অপরাধ, আর প্রশ্ন তোলা এক ধরনের দায়িত্ব। কিন্তু আজ, সেই আগুন যেন নিঃশব্দ ছাই হয়ে যাচ্ছে। যে প্রতিষ্ঠান একসময় শ্রেণিভেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াত, তা কি আজ নিজেই শ্রেণির প্রাচীর গড়ে তুলছে? আমরা কি এমন এক সমাজ তৈরি করছি, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে ভয় পায়? ভুলে যাচ্ছে, সব উন্নয়ন মানুষের জন্য নয়; কিছু উন্নয়ন কেবল ক্ষমতার টিকে থাকার কৌশল। আমার স্বপ্ন ছিল এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার, যেখানে শিক্ষক হবেন নৈতিক দ্রোহের কণ্ঠস্বর, শিক্ষার্থী হবেন মানবিক দায়ে উদ্বুদ্ধ। জাফরুল্লাহর স্বপ্ন ছিল ‘গ্রামসিয়ান বুদ্ধিজীবী’ গড়া—যিনি কেবল পরীক্ষায় পাশ করবেন না, বরং প্রশ্ন তুলবেন। এখন সময় এসেছে নিজেদের ফিরে দেখার—আমরা কি সেই পথেই হাঁটছি? নাকি পথ হারিয়ে ফেলেছি? প্রয়োজন এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব—যেখানে শিক্ষা হবে আত্মোপলব্ধির হাতিয়ার। “জীবন ও সমাজ” এমন এক পাঠ্য হোক, যেখানে শেখানো হবে—প্রশ্ন তোলা অপরাধ নয়, প্রশ্নহীনতা এক প্রজন্মের আত্মহনন। গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ভবন নয়—এক আন্দোলনের নাম। যারা এর সন্তান, তাদের দায়িত্ব শুধু স্মরণ নয়, পুনর্গঠন। 

নাসিম খান
৩য় বর্ষ, রসায়ন বিভাগ 
গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

এমএসএম / এমএসএম