খাজা ওসমান ফারুকীর সুফি তত্ত্বের নিদর্শন
স্রষ্টার সৃষ্টিকে নিয়ে গভীর ধ্যান করা ইসলামে বড় ইবাদাত হিসেবে গণ্য। যেখানে কোরআন এই রকম গভীর চিন্তা করার কাজকে সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন যাতে প্রত্যেকে এই চিন্তাকে তার মেজাজ ও আধ্যাত্মিক অবস্থায় প্রয়োগ করতে পারেন। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষের বিরক্তিকর অনুভূতি, খারাপ অভ্যাস, একঘেঁয়েমী পরিবেশ থেকে বের হয়ে এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন চিহ্ন ও নির্দেশনাকে প্রজ্ঞার মাধ্যমে হৃদয়ে প্রবেশ করানো।ইসলামে ধ্যান এমন একটি অনুশীলন যা মুসলিমদের মানসিক শান্তি দেয়। ইসলামী শিক্ষা জুড়ে এটির ধারণা ভালোভাবেই পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ বলছেন “যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং (বলে,) হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এ নিরর্থক সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র। তুমি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা কর”। (সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)
মানুষের মস্তিষ্ক এই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ধাঁধাপূর্ণ। বিজ্ঞানের চোখ ধাঁধাঁনো যত আবিষ্কার হয়েছে সেগুলো মানুষের মাথার ভিতরে যে জৈব কম্পিউটার আছে তার সূক্ষ্মতা ও পারঙ্গমতা দেখে শুধু তাদের বিস্ময়কে বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র। হার্বাট বেনসন তার ‘টাইমলেস হিলিং’ গ্রন্থে লিখেছেন- মস্তিষ্ক এত জটিল, এত সুস্থির, এত গতিশীল, এত বহুমাত্রিক এবং এত সুসংযত যে তার কার্যাবলিকে বর্ণনা করার আমাদের সকল প্রচেষ্টা শুধু সাদামাটা চেষ্টার নামান্তর হয়। প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার আমরা করেছি তা শুধু ব্যাখ্যা করে দেখাচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক কত বড়, আর কত বড় এর সার্কিট; যা আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য, সুস্থ চলাফেরা, স্মৃতি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রদান করে! যা প্রত্যেক মুহূর্তের চলাফেরা, শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রত্যেক ঘটনা যা ঘটে, ঘটবে এবং ভাবা হয় বা যা স্বপ্নে দেখা হয় বা দেখা হবে তার চিহ্ন রেখে চলছে। এই জন্য স্বর্গীয় আহ্বান এবং মানবজাতির জন্য প্রশ্ন ছোড়া হয়েছে কীভাবে তারা তাদের নিজেদের সৃষ্টি করার অলৌকিকতা সম্পর্কে অন্ধ থাকতে পারে? – ‘বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর মহিমার অসংখ্য নিদর্শন জমিনের বুকে যেমন আছে, তোমার নিজের মধ্যেও রয়েছে। এরপরেও কি তোমরা সত্য অনুধাবন করবে না? (জারিয়াত: ২২-২৩) মানুষ হলো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিস্ময় কিন্তু সে নিজের মূল্য সম্পর্কে অমনোযোগী এবং বিশ্বাসের অভাবের কারণে স্বজাত-রহস্যে অজ্ঞাত।
সে তো স্রষ্টার নিয়ামতকে অস্বীকার করেই চলে। কিন্তু, তার শারীরিক গঠনের মধ্যে লুকিয়ে আছে শরীর, আত্মা ও আধ্যাত্মিক রহস্য। সে ভিতরে ও বাইরে রহস্যময় এক মহাবিশ্বের উপাদানের প্রতিনিধি। তাই, তুমি নিজকে এক ক্ষুদ্রবিশ্ব বলে মনে করতে পার; যদিও তোমার অবস্থান বড় এক মহাবিশ্বের ভিতর। যখন মানুষ নিজেকে নিয়ে গভীর চিন্তা করে, সে বিস্ময়কর ও চোখ ধাঁধাঁনো রহস্যের সন্ধান পায়। তার অঙ্গের গঠন, তার অবস্থান ও তার কার্যাবলির উপর নির্ভর করে তার কাজের পূর্ণতা পায় এবং তার আত্মার রহস্য এবং এর জ্ঞাত-অজ্ঞাত শক্তিসমূহ প্রকাশ পায়। কীভাবে সে তার ধারণা তৈরি করে এবং কীভাবে তা সে জমা রাখে এবং যথাসময়ে কীভাবে স্মরণ হয়? এই সকলের স্মৃতি ও ছবি কীভাবে মনে আসে- এই প্রতিচ্ছবিগুলো তো অসীম সংখ্যক! আর ঠিক তখনই মানুষের রহস্য কিছুটা বের হয়ে আসে। তারপর মানুষের প্রসার ও এগিয়ে চলা যেমন একটা কোষ সকল মানবজাতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকে, তার সাথে সেখানে থাকে তার বাবা-মা ও পূর্বসূরিদের তথ্য। সেগুলো কোথায় তাহলে লুকিয়ে থাকে এই ক্ষুদ্র ঘরে? আর সেই ক্ষুদ্র কোষ প্রতিক্ষণে কীভাবে সৃষ্টি করে আর একটা হুবহু মানুষ!
ইসলামে ধ্যানের ভূমিকা
ধ্যান ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি আধ্যাত্মিক সুবিধা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি দেয় এবং মননশীলতাকে উন্নীত করে।
আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন: ইসলামে ধ্যানকে গভীর স্তরে আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি মাধ্যম হিসাবে দেখা হয়। এটি ব্যক্তিকে আল্লাহর উপস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা করতে, তাঁর নির্দেশনা খুঁজতে এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। মনকে শান্ত করার পাশাপাশি মুসলিমরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে অনুভব করতে পারে।
সৃষ্টির চিন্তাভাবনা: কুরআনে বিশ্বাসীরা তাদের চারপাশের প্রাকৃতিক জগৎকে আল্লাহর মহত্ত্ব ও প্রজ্ঞা চেনার উপায় হিসাবে চিন্তা করে থাকে। এই চিন্তার অনুশীলন অন্যান্য ঐতিহ্যে পাওয়া ধ্যানের কৌশলগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সারিবদ্ধ। ধ্যানের মাধ্যমে মুসলিমরা তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি অর্জন করতে পারে এবং এর পিছনে থাকা ঐশ্বরিক হাতকে চিনতে পারে।
আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করা: ইসলামিক ধ্যান আত্মোপলব্ধি ও আত্মসচেতনতাকে বৃদ্ধি করে। কারণ ধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তি কুরআনের শিক্ষা দ্বারা পরিচালিত আত্মোন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালায়। এই অনুশীলন বিশ্বাসীদের নিজস্ব কর্ম, উদ্দেশ্য ও আচরণ সম্পর্কে বোঝাপড়া তৈরীতে করতে সাহায্য করে।
নামাজ ও জিকিরের মাধ্যমে মননশীলতাঃ নিয়মিত নামাজ ও জিকির ইসলামী ধ্যানের একটি রূপ। এই অনুশীলনের সময় মুসলিমদের লক্ষ্য তাদের মনকে জাগতিক বিভ্রান্তি থেকে দূর করে শুধুমাত্র আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্কের দিকে মনোনিবেশ করা। কারণ এটি দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে খোদার গুণাবলীর প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে।
অভ্যন্তরীণ শান্তির সন্ধান করা: আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা প্রায়ই মানুষকে চাপ ও উদ্বেগের দিকে নিয়ে যায়। ধ্যান এ বিষয়ে একটি প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে যা মানুষকে অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজে দিতে সক্ষম। ধ্যানের মাধ্যমে জাগতিক বিভ্রান্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের ভিতরের প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা বিকাশ করা: ধ্যান ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার মতো গুণাবলীর জন্ম দেয় যা ইসলামে অত্যন্ত মূল্যবান। নিয়মিত ধ্যান অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি কঠিন সময়েও খোদার রহমত বা করুণার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে।
প্রকৃতির সাথে সংযোগ: কিছু ইসলামিক ধ্যান অনুশীলন ব্যক্তিকে প্রাকৃতিক জগতের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে উৎসাহিত করে।
আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধি করাঃ ধ্যান মুসলিমদের আত্মসচেতনতা, কৃতজ্ঞতা, ক্ষমা, নম্রতা, সহানুভূতি ও সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মতো বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায়।
উপসংহার
ইসলামে ধ্যানের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। কারণ এটি কুরআনের শিক্ষার গভীরে নিহিত। সুফিবাদের মতো ইসলামিক ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্ম জুড়ে ধ্যানের অনুশীলন পাওয়া যায়, তবে সুফি মেডিটেশন যোগ্য শিক্ষকদের কাছ থেকে জ্ঞান ও নির্দেশনা নিয়ে অনুশীলনগুলো করা অপরিহার্য। সুফি ধ্যানের এই আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করার পূর্বে আল্লাহ সম্পর্কে নির্ভেজাল বিশ্বাস রাখা খুবই আবশ্যক।এ মহাজগতে বিদ্যমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনু থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি সবকিছুই আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ব্যাপারে কি তোমরা সন্দেহের মধ্যে রয়েছ? —(সূরা ইবরাহীম : ১০)
এমএসএম / এমএসএম