ঢাকা বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

দরজায় কড়া নাড়ছে দেবী দুর্গার আগমনীবার্তা


সফি সুমন, আশুলিয়া photo সফি সুমন, আশুলিয়া
প্রকাশিত: ১৭-৯-২০২৫ দুপুর ১১:৫১

‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥
পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥’’
অর্থ: হে ভরতবংশী (অর্জুন), যখনই ধর্মের অধঃপতন ঘটে এবং অধর্মের উত্থান হয়, তখনই আমি (জীবাত্মা) অবতীর্ণ হই। সাধু সজ্জনদের রক্ষা করতে, দুষ্টদের বিনাশ করতে এবং ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই। (ইহা ঈশ্বরাবতার নয়, ইহা জীবাবতার, “ভাবং জৈমিনিঃ বিকল্পামননাৎ”)
শরৎ আসলেই বাংলার আকাশে মেঘের খেলা শুরু হয়। নীলিমার বুক চিরে ভেসে বেড়ায় তুলোর মতো সাদা মেঘ, বাতাসে ভেসে আসে শিউলির গন্ধ। শিউলি ফুলের গন্ধ, কাশবনের দোলা আর আকাশে সাদা মেঘ সবই জানান দেয় দেবী মা দুর্গার আগমন খুব সন্নিকটেই। শরতের এই পূর্ণিমাতেই বাংলার আকাশ বাতাস জুড়ে আলোড়ন তোলে ঢাকের বাদ্যি আর ধূপের সুগন্ধি। দুর্গাপূজা আজ বাঙালির পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক, যা একদিকে ধর্মীয় আচার, অন্যদিকে সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামাজিক সম্প্রীতির মহাযজ্ঞ। প্রকৃতিই যেন ঘোষণা দেয়, আসছেন দেবী দুর্গা। বাংলার মানুষের হৃদয়ে এক অনাবিল আনন্দ ও আবেগ নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ছে মহামায়ের আগমনীবার্তা।
দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শেকড়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অপার আবেগ। কেবল হিন্দু সম্প্রদায় নয়, বাঙালি জাতির সার্বজনীন উৎসব হিসেবে দুর্গাপূজাকে সবাই আপন করে নেয়। গ্রাম থেকে শহর, পাড়া থেকে মহল্লা, সর্বত্র পূজার প্রস্তুতি এখন জোর কদমে চলছে। প্রতিটি মণ্ডপে চলছে মাটির প্রতিমা গড়ার ব্যস্ততা, শিল্পীরা তুলির আঁচড়ে প্রাণ দিচ্ছেন দেবী দুর্গার রূপে।
আসছে পূর্ববাংলা (তিথি) গ্রেগরিয়ান তারিখ অনুযায়ী ৬ আশ্বিন ১৪৩২ বাংলা, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইংরেজি, রোজ রবিবার মহালয়ার মাধ্যমে দেবীর সঁচে আসনের দরজায় কড়া নাড়ার প্রথম বার্তা দিবে। মহালয়া দুর্গাপূজা উৎসবের সূচনা করে, কারণ এই দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার জন্য মর্ত্যে আগমন করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দিনে মাতৃপক্ষের সূচনা হয়, যা অশুভ শক্তির বিনাশের প্রতীক এবং শুভ সূচনা বোঝায়।
বাংলা ১২ আশ্বিন, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার পঞ্চমী বা খুঁটি পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পঞ্চমী বা খুঁটি পূজা মূলত দুর্গাপূজার একটি প্রাথমিক আচার, যা রথযাত্রার দিন বা তার কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজার মাধ্যমে আসন্ন দুর্গাপূজার জন্য মণ্ডপ বা প্যান্ডেল তৈরির কাজ শুরু করা হয় এবং প্যান্ডেল তৈরির জন্য প্রথম খুঁটি পোঁতা হয়। এই প্রথাটি বহু পুরনো এবং এটি দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে ধরা হয়। এটি দুর্গাপূজার প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে।
১৩ আশ্বিন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রবিবার ষষ্ঠী বা শোভন সূচনা আরম্ভ হবে। ষষ্ঠী বলতে বোঝায় দুর্গাপূজার শুরুর দিনটিকে, যা আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালিত হয় এবং এই দিনে দেবীর অকাল বোধন বা জাগ্রত করা হয়। এটি মূলত দেবীপক্ষে দুর্গোৎসবের প্রথম আনুষ্ঠানিক দিন, যেখানে কল্পারম্ভের মাধ্যমে দেবীর মর্ত্যে আগমনের প্রস্তুতি শুরু হয়। যদিও দুর্গাপূজা ১০ দিনের উৎসব, তবে সাধারণ মানুষ ষষ্ঠী থেকেই এটিকে পূজার প্রথম দিন হিসেবে গণ্য করে এবং এই দিন থেকেই উৎসবের মূল আমেজ শুরু হয়। ষষ্ঠী কেবল একটি দিনই নয়, বরং এটি দেবীর মর্ত্যে আগমনের প্রতীক এবং দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা পর্ব।
১৪ আশ্বিন ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সোমবার মহাসপ্তমী অনুষ্ঠিত হবে। দুর্গাপূজার সপ্তমী হলো পূজোর দ্বিতীয় দিন। এটিই মূল উৎসবের সূচনা করে। এই দিন নবপত্রিকা বা কলাবউ মহাস্নান (নবপত্রিকাকে গণেশ ঠাকুরের স্ত্রী হিসেবে মনে করা হয় এবং একে দেবীর প্রতিমূর্তির সঙ্গে পূজিত হয়), দেবীর আবাহন বা এই দিনে দেবীর সপরিবার লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিককে আবাহন করা হয়। দেব দেবী ও নবগ্রহের পূজা এবং ষোড়শ উপাচারসহ দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে জনশ্রুতি আছে যে, এই দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে পরাজিত করার জন্য পৃথিবীতে অবতরণ করেন। এই কারণে সপ্তমী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
১৫ আশ্বিন ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ মঙ্গলবার অষ্টমী বা সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হবে। দুর্গাপূজার অষ্টমী, যা মহাঅষ্টমী নামেও পরিচিত। নবরাত্রি উৎসবের অষ্টম দিন এবং এটি দেবী দুর্গার একটি অত্যন্ত মহাগুরুত্বপূর্ণ ও শুভ দিন। এই দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন, যা অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির বিজয়কে নির্দেশ করে। অষ্টমী তিথিতে দেবী দুর্গার অষ্টম রূপ (ব্রাহ্মণী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নসিংহী, ইন্দ্রাণী এবং চামুদা) মহাগৌরীর পূজা করা হয়। এই দিনে দুর্গার হাতে থাকা অস্ত্র বা সমরকলারও পূজা করা হয়, তাই এটি বীর অষ্টমী নামেও পরিচিত। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবীর চরণে ১০৮টি পদ্মফুল নিবেদন করা হয়। যা সন্ধিপূজা নামে পরিচিত। লৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী এই সময়ে দেবী প্রতিমায় আবির্ভূত হন। অনেকেই এই পবিত্র দিনে উপবাস করেন ও নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে পূজা মণ্ডপে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেন।
১৬ আশ্বিন ১ অক্টোবর ২০২৫ বুধবার দুর্গাপূজার মহানবমী। শারদীয় নবরাত্রির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। যা দুর্গাপূজার শেষ দিন হিসেবে পালিত হয় এবং মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার মহাজয়ী যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বকে নির্দেশ করে, যা মন্দের উপর শুভ শক্তির বিজয়কে উদযাপন করে। এই দিনে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। চণ্ডীপাঠ ও দেবীর 'মহাআরতি' অনুষ্ঠিত হয়।
১৭ আশ্বিন ২ অক্টোবর ২০২৫ বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমী বা বিসর্জন। প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে দুর্গাপূজার সকল আনুষ্ঠানিকতা। এই দিনে দেবী দুর্গা তাঁর পিতৃগৃহ ছেড়ে কৈলাসে তাঁর স্বামী মহাদেবের কাছে ফিরে যান, তাই এটিকে তাঁর বিদায়ের দিন হিসেবেও ধরা হয়। এই দিনে মিষ্টিমুখ করা এবং সিঁদুর খেলা (মহিলাদের জন্য) এক অন্যতম রীতি। মানুষ একে অপরের বাড়িতে যায়, বড়দের চরণে প্রণাম করে এবং ছোটদের আশীর্বাদ দিয়ে 'শুভ বিজয়া' জানায়।
খুব শীগ্রই ঢাকের বাদ্যি, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির সঙ্গে মণ্ডপগুলোতে জমে উঠবে এ মহোৎসব। বাংলাদেশে দুর্গাপূজার ইতিহাস অনেক পুরনো। মোগল আমলে জমিদারদের উদ্যোগে পূজা প্রচলন হলেও পরবর্তীতে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আজ তা দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর দেশজুড়ে প্রায় ৪০ হাজার পূজামণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয় এই মহোৎসব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় রীতি নয়, বরং মিলনমেলা ও সৌহার্দ্যরে প্রতীক। সবাই মিলে এ উৎসব উদযাপনে অংশ নেওয়ায় এটি হয়ে উঠেছে সম্প্রীতির এক সেতুবন্ধন।
দুর্গা প্রতিমার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি একেকটি প্রতীক বহন করে। তিনি আসেন অসুর নিধন করতে, অন্যায় অবিচারকে দমন করে ন্যায় ও সত্যের জয় ঘোষণা করতে। বর্তমান সময়েও এই বার্তাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গাপূজা শুধূ ভক্তির নয়, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিরও উৎসব। নাটক, সংগীত, কবিতা আবৃত্তি, আর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এটি বাঙালির হৃদয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে।
যখন ঢাক বাজবে, উলুধ্বনি উঠবে, আর অঞ্জলি দিতে ভিড় জমবে ভক্তদের, তখনই মনে হবে সত্যিই দরজায় কড়া নেড়েছেন দেবী দুর্গা। এই আগমনী বার্তা আমাদের সকলকে উজ্জীবিত করুক, অন্যায় দূর হোক, শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।

 

Aminur / Aminur