এ যেন আরেক চা বাগান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) সামনের মাঠে বসেছে পিঠার মেলা। সেই মেলার একটি দোকানে পিঠা তৈরির কাজ করেন রিনা বেগম। তাঁর বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায়। রিকশাচালক স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় ঘরে পড়ে আছেন দুই বছর ।দুই ছেলের পৃথক সংসার। আগে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। সাংসারিক স্বচ্ছলতার আশায় কাজ শুরু করেন পিঠার দোকানে। কিন্তু প্রতিদিন ৮-৯ ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পান মাত্র ১৫০ টাকা। যা দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়াও ঠিক মতো হয় না। শুধু মর্জিনা নয়, যাদের হাতে তৈরি হয় হরেক রকমের সুস্বাদু পিঠা সে সকল নারীই এই মজুরি বৈষম্যের শিকার। তাঁদের এই বৈষম্য দেখার কেউ নেই। সব মিলিয়ে এ যেন আরেক চা বাগান। আর নারীরা যেন সেই অবহেলিত চা শ্রমিক।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ‘পিঠা তৈরির কারিগরদের প্রতি এ ধরনের মজুরি বৈষম্যের ফলে তাদের জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি মানবাধিকারও খর্বিত হচ্ছে।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ‘কোনো শ্রমিক অভিযোগ দিলে তাঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
সরেজমিনে দেখা যায়, টিএসসিসি চত্বরে প্রায় ১২টি পিঠার দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি দোকানের মালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বাকি ৮টির মালিক বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার সাধারণ ব্যবসায়ী। দোকানগুলোতে নারীরাই পিঠা তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করেন। ১২টি দোকানে মোট ৮০ জনের মতো নারী শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত একাধারে চলে তাদের কর্মযজ্ঞ। এসময়ে ঘাড় ঘোরানোর সময়টুকুও পান না তারা। আর পিঠা তৈরির কাঁচামাল প্রস্তুত করার জন্য আরও দু-এক ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করতে হয় তাদেরকে। আর এই ৮-৯ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে অভিজ্ঞতা, কাজ ও দোকানভেদে দৈনিক মজুরি পান মাত্র দেড়শ থেকে আড়াইশ টাকা।
এসব দোকানে প্রায় ১৫ ধরনের পিঠা পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, তেল পিঠা, পাটিসাপটা, পুলি পিঠা, রস পিঠা, বকুল পিঠা, লাভ পিঠা, বিস্কুট পিঠা ইত্যাদি। এসব রকমারি পিঠাকে আরও সুস্বাদু করতে পাওয়া যায় সাত পদের ভর্তা। বেগুন, শুটকি ভর্তা, সরিষা, ধনিয়া পাতা, কাঁচা মরিচের ভর্তার সঙ্গে কালোজিরার ভর্তাও রয়েছে। পিঠাভেদে দামেরও তারতম্য রয়েছে। প্রতি পিস স্পেশাল ভাপা ২০ টাকা, নরম্যাল ভাপা পিঠা ১০ টাকা, তেল পিঠা ১৫ টাকা, পাটিসাপটা ১৫ টাকা, চিতই পিঠা ১০, পুলিপিঠা ৬ টাকা, রস পিঠা ১০, বকুল পিঠা ৮, লাভ পিঠা ১০ টাকা, বিস্কুট পিঠা ৬ টাকা এবং প্রতি প্লেট ভর্তা ১০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পরিধিভেদে প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক আয় হয় প্রায় ২০-৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এর কারিগরদের নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে অধিক মুনাফা লাভ করেন দোকান মালিকেরা। তবে মালিকপক্ষ বলছে, পিঠা তৈরির উপকরণের দাম বাড়তি হওয়ায় চাইলেও শ্রমিকদের এর বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া সম্ভব হয় না। আর পেটের দায়ে কোন কাজ না পেয়ে যৎসামান্য মজুরিতেই গতর খাটেন এসব নারী শ্রমিকেরা।
পিঠা তৈরির কারিগর রিনা বেগম বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ ধরে পিঠার দোকানে কাজ শুরু করেছি। যেদিন মালিকের ব্যবসা ভালো হয় সেদিন দুইশ টাকা, আর অন্যান্য দিন দেড়শ টাকা করে মজুরি দেয়। তা দিয়ে সংসার তো দূরের কথা, নিজের খরচটাই হয় না। তারপরও পেটের দায়ে অল্প টাকাতেই কাজ করি।’
দীর্ঘ ৭ বছর ধরে পিঠার দোকানে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মেহেরচণ্ডী এলাকার আমেনা বেগম। তিনি বলেন, ‘পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন থেকে এখানে কাজ করতে আসি। দীর্ঘ ৭ বছর ধরে পিঠার দোকানে কাজ করি। বিকেলে ৪টার দিকে কাজ শুরু করি রাত ১০ টা অবধি একাধারে কাজ করি। এর আগে পিঠার উপকরণ প্রস্তুত ও ভর্তা তৈরি মিলিয়ে আরও ২-৩ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এই ৮-৯ ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে কোনদিন ১৫০, আবার কোনদিন ২০০ টাকা দেয়। বর্তমান বাজারে এ টাকা দিয়ে পরিবার চলে না।’
পিঠার দোকানের আরেক কর্মচারী লাবনী আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছে ৩ বছর আগে। অভাবের সংসারে আমিই একমাত্র আয়ের উৎস। দুই ছেলে আর এক মেয়ের সংসার আমার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর ছোট ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ধারদেনা করে বড় ছেলেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে কোচিং এ ভর্তি করিয়েছি। বড় ছেলে আগে টিউশনি করাতো। কিন্তু এখন পড়ার চাপ বেশি তাই এখন পারে না। আমি ২টা বাসায় গিয়ে কাজ করি। শীতের সময় একটা বাসায় কাজ করি। আর বাকিটা সময় পিঠার দোকানে কাজ করি। দৈনিক দুইশো টাকা মজুরি দেয়। এতে কিছুই হয় না। তারপরও সংসারের টানে কাজ করতে হয়।’
নারী কর্মচারীদের নামমাত্র মজুরি দেওয়া ‘মাসুম আলীর শীতকালীন পিঠা’ দোকানের কর্ণধার মাসুম আলী বলেন, ‘মজুরি কম হয়ে যায় এটা আমিও বুঝি। কিন্তু সবকিছুর দাম খুবই উর্ধ্বমুখী। সবকিছুর খরচ মিটিয়ে তাদের এই টাকা দিতে পারি। নতুন যেসব নারী আমার দোকানে কাজ করেন তাদের দেড়শ টাকা দেই আর অভিজ্ঞদের দুইশ টাকা দেই। তবে যেদিন বেচা-কেনা ভালো হয় সেদিন তাদের মজুরিও বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’
মানবাধিকার কর্মী রাশেদ রাজন বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এতে মজুরি বৈষম্য করা হচ্ছে। তাদেরকে পারিশ্রমিকের অর্ধেকেরও কম দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই মজুরি দিয়ে তাদের সংসার চলতে পারে না। এতে করে তাদের জীবনযাত্রার মান যেমন ব্যাহত হচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে মানবাধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘এটি অবশ্যই ভাবনার বিষয়। এখানে নারী অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমি মনে করি এ বিষয়ে মালিক পক্ষের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা যদি অভিযোগ পাই তবে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখবো।’
T.A.S / T.A.S