মব জাস্টিসের প্রভাবে বর্তমান বাংলাদেশ

মব জাস্টিস বা মব সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল আফ্রিকার রাষ্ট্র উগান্ডায়। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে এর সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে তা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মারাত্মক আকার ধারণ করে।উগান্ডা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দেশটিতে উত্তেজিত মবের হাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৪২৬টি। সেখান থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে এভাবে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৪৬-এ। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, উগান্ডায় মব সহিংসতার সূচনা হয়েছিল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি দেশটির সাধারণ জনগণের অনাস্থা থেকে। পরে তা সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মব জাস্টিস প্রতিরোধে ২০১৯ সালের পর আলাদা একটি বিভাগ খুলতে হয়েছিল উগান্ডা সরকারকে।
শুধু উগান্ডা নয়; দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া ইত্যাদি দেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মব জাস্টিসের ঘটনা বেড়েছে। বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী ও মারাত্মক আকার নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২০২২ সালে দেশটিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৯৪টি বা প্রায় ৭ শতাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে মব সহিংসতায়। আর ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসেই দেশটিতে মব সহিংসতায় ১ হাজার ৪৭২টি প্রাণহানির ঘটনার তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গত অক্টোবরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, নাইজেরিয়ায় গত অক্টোবর পর্যন্ত ১০ বছরে দেশটিতে অন্তত ৫৫৫টি মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে বহু মানুষের। বিশেষ করে বাজার বা ব্যস্ত সড়কের মতো জনাকীর্ণ এলাকাগুলোয় মব সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। গত এক দশকে নাইজেরিয়ায় মব সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে দেশটির সরকারের জনসাধারণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার বিপর্যয়কে দায়ী করা হয় সবচেয়ে বেশি। দেশটিতে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী ও অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিরা প্রায়ই সহিংস জনতার টার্গেটে পরিণত হন। এ সমস্যার কারণে এ ধরনের ব্যক্তিরা প্রায়ই মব সহিংসতার খুব সহজ টার্গেট হয়ে ওঠেন বলে অ্যামনেস্টির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
মহাদেশটির আরেক দেশ ঘানায় ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরেও নানা অভিযোগ তুলে অভিযুক্তদের মব সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়ার প্রচুর নজির রয়েছে। সেখানেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মব সহিংসতার মাত্রা বাড়তে দেখা গেছে। দারিদ্র্য দেশটিতে এ ধরনের ঘটনা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত নানা পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
আফ্রিকার এসব দেশের মতো সম্প্রতি বাংলাদেশেও এখন মব জাস্টিসের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত মব সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনোভাবে মব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ পুলিশ বাহিনীর মধ্যেই রয়েছে আতঙ্ক।
গত ছয় মাসে বাংলাদেশে চুরি বা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহেসহ অথবা পতিত সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিযোগ দেখিয়ে আইনের হাতে সোপর্দ না করে নির্মম ভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো। শিক্ষা খাতে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে মব দিয়ে চাপ প্রয়োগে বদলে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মব দিয়ে জোরপূর্বক শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের শ্লীলতাহানি, লাঠিপেটা, জুতাপেটা দিয়ে জোরপূর্বক পদত্যাগ বা চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটেছে অনেক। হামলা ও ভাংচুর হয়েছে ভাস্কর্য, স্থাপনা, শিল্প-কারখানায়। অনেক শিল্পকারখানায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে মব সহিংসতার নজির। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নারী ফুটবল ম্যাচ। দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সামনে অবস্থান, হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে একের পর এক মব জাস্টিসের ঘটনায় সাধারণ জনগণের মধ্যে এখন আতঙ্ক বাড়ছে। উদ্বেগ বাড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও। পুরো দেশময় চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানুষ বাস করছে। দীর্ঘ ১৭ বছর আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় ছিলো কয়েক নির্বাচনও করেছে সকল দলের অংশগ্রহণ বাদ দিয়ে। একক ক্ষমতার আধিপত্যের কারণে জনমনে চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের কারণে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর মব জাস্টিসের নামে তাদের হাজারো ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, লুটপাটসহ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেককে ঘরবাড়িতে আটকে রেখে বাইরে আগুন দেয়া হয়েছে, শিশুসহ অনেক পরিবারের সদস্যদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাদ যায়নি মসজিদ মাদ্রাসাও। চট্রগ্রামে একটি কবরেও আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। ছেলে আওয়ামীলীগ করার কারণে মাকে গাছের সাথে বেধে বেধড়ক পেটাতেও দেখা গিয়েছে। আওয়ামিলীগের পক্ষে শ্লোগান দেয়ার কারণে নারীকে জনতা প্রকাস্য দিবালোকে মারধরসহ শ্লীলতাহানি করতে দেখা গিয়েছে। সকলের মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে, কখন কে কাকে পতিত আওয়ামীলীগের নেতা কর্মী আখ্যা দিয়ে গনপিটুনি দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। ৫ আগস্ট রাতে ঢাকার উত্তরায় একদল জনতা একজনের পা উপরে বেঁধে মাথা-পা কেটে ফেলেছে, অঝোরে রক্ত ঝরছে, উন্মত্ত জনতা হাসি-ঠাট্টার ছলে ভিডিও করছে, কেউ কেউ মৃত মানুষকে পিটাচ্ছে, এমন আরও একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এসব দেখে রীতিমতো নিজেকে মানুষ পরিচয় দিতে ঘৃণা হয়। কখনো দেখাযায় হাত-পা বেঁধে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, বস্তা বন্দি করে ডোবায় কিংবা পুকুরে ফেলে দেয়া হয়েছে, মেরে কুকুর বিড়ালের মতো টেনে নিতে দেখেছি, এমন ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। এর ফলে সাধারণ মানুষও পথে বের হতে ভয়পায়। খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পুলিশও একাকী কিংবা রাতের টহল দিতে ভয়পায়।
৫ আগস্টের পর দেশটা প্রায় অনিয়ন্ত্রিত ভাবেই চলছে কেউ কাউকে মানছেনা। গত ছয় মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সন্দেহভাজন অপরাধী, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজ গ্রেপ্তার হলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। এ কারণে নাগরিকদের বড় একটি অংশ নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় দিনের আলোয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এতে সন্ধ্যার পর বের হতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই।
জনরোষ ও মব জাস্টিসের নামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনলাইনে বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ও বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই বাড়িটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আতুড়ঘর। এখানেই বাস করতেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের সকল আন্দোলন ও সংগ্রাম ও ঘোষণা এই বাড়ি থেকে আসতো। প্রতিহিংসা ও শেখ হাসিনার অপশাসনের ধুয়া তুলে সেই বাড়িটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব কিছুই ঘটেছে এই মব জাস্টিস নামক বিশৃঙ্খলার কারণে। জনতা শুধু ৩২ নম্বরের বাড়িই পুড়িয়ে, ধ্বংস করে ক্ষান্ত হয়নি, পাকিস্তানী জঙ্গি আইএসআই-এর পতাকা নিয়ে নেচেছ। যা এদেশের জন্য একটি ভীতির কারণ। গত কিছুদিন আগেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ নিয়ে গলা ফাটিয়ে দিয়েছেন। শুধু ধানমন্ডি ৩২ নম্বরই পোড়ায়নি উন্মত্ত জনতা ও দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ বহু নেতাদের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী শুধু নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে দেখেছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রশাসন শুধু দায়সারা বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে। দেশের আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই। প্রতিদিনই দেশে কোথাও না কোথাও সহিংসতা লেগে আছে। বিগত ১৬-১৭ বছর আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন নির্যাতন ও নিপিড়নের স্বীকার হওয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আজ গোটা দেশব্যাপী আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া, লুটপাট, পটিয়ে হত্যা,গুম ও খুন করাহচ্ছে যা রীতিমতো অন্যায় ও মানবাধিকারের চরম অবস্থায় পৌছেছে বলে সাধারণ জনগণের ধারনা। মব জাস্টিসের নামে শুধু সহিংসতাই চলছে না দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে গলিত, অর্ধ গলিত, মুখে কাপড়, কসটেপ পেচানো, কখনো হাতপা বাঁধা নারী-পুরুষের লাশ। দেশটা যেন লাশের উপত্যকায় পরিনত হয়েছে। বিগত ছয় মাসে অপরাধ প্রবর্তনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে সরকারি তথ্যেও। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে, ডাকাতির মামলা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে পুলিশ। এই সময়ে ডাকাতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২৪৩টি, যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৯৮টি।
এই চার মাসে ৫৫৩টি ডাকাতির ঘটনা, ৩০২টি অপহরণ এবং ৯৪৯টি চুরির ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ৩৯৬টি ডাকাতি, ১৬০টি অপহরণ এবং ৮৫৯টি চুরির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৯৪৭টি খুনের ঘটনা থানায় রিপোর্ট করা হয়েছে।
গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গণপিটুনিতে ২০২৪ সালে ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৯৬ জন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫১।
এ সময়ের মধ্যে মাজার ও দরগায় বহু হামলার ঘটনা ঘটে। গত ২৩ জানুয়ারি, 'গ্লোবাল সুফি অর্গানাইজেশন' এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে যে গত ছয় মাসে দেশজুড়ে ৮০টিরও বেশি মাজার ও দরগায় উগ্রবাদী গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে ৪ আগস্ট থেকে কমপক্ষে এরকম ৪০টি স্থাপনায় ৪৪ বার হামলা হয়েছে।
কয়েকদিন আগে একুশে বইমেলার একটি স্টলে হট্টগোল ও বাকবিতন্ডার ঘটনা ঘটে। এর আগে সামাজিক যোগাযোগ বাকবিতন্ডায় স্টলটির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে এটিকে গুঁড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে একাধিক পোস্ট দেয়া হয়। স্টলটিকে ঘিরে বাকবিতন্ডা ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।
বিষয়টি নিয়ে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ধরনের বিশৃঙ্খল আচরণ বাংলাদেশে নাগরিকের অধিকার এবং দেশের আইন উভয়ের প্রতিই অবজ্ঞা প্রদর্শন করে উল্লেখ করে বিবৃতিতে তিনি জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে।
কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন। আর যদি মব করেন তাহলে আপনাদেরও ডেভিল হিসেবে ট্রিট করা হবে। আজকের ঘটনার পর আর কোনো অনুরোধ করা হবে না। আপনাদের কাজ না আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া। কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করব। রাষ্ট্রকে অকার্যকর ও ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেয়া হবে না।’
তিনি আরো লেখেন, ‘তৌহিদী জনতা! আপনারা দেড় দশক পর শান্তিতে ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের সুযোগ পেয়েছেন। আপনাদের আহাম্মকি কিংবা উগ্রতা সে শান্তি বিনষ্টের কারণ হতে যাচ্ছে। জুলুম করা থেকে বিরত থাকেন, নইলে আপনাদের ওপর জুলুম অবধারিত হবে।...জুলুম করবেন না, জুলুমের শিকারও হবেন না। এটাই আপনাদের কাছে শেষ অনুরোধ!’
প্রমাণিত-অপ্রমাণিত বা কথিত কোনো অপরাধের বিচারের ভার আইনি প্রক্রিয়ার পরিবর্তে উত্তেজিত জনতা হাতে তুলে নিলে সেটিকে বলা হয় মব জাস্টিস। এর সঙ্গে সহিংসতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে বলে একে মব ভায়োলেন্সও বলা হয়। আফ্রিকার দেশগুলোয় মব সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ব্যাপক দুর্নীতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাবে জনগণ আইনের শাসনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলা এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়ে পড়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য বলে অভিমত তাদের।
দেশের শিক্ষা খাতে এ মুহূর্তে বড় এক প্রভাবক হয়ে উঠেছে মব। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকগুলো জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর ঘটানো ঘটে। শুধু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনমন নয়, গত ছয় মাসে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত মব দিয়ে বদলে ফেলার নজির রয়েছে অনেক। এমনকি গত ছয় মাসের শিক্ষা খাতের বড় সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে অন্যতম প্রধান অনুঘটক ছিল মবসৃষ্ট চাপ। ২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষা বাতিল থেকে শুরু করে পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ গ্রাফিতি তুলে নেয়া, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি বাতিল, সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথকীকরণ, নিবন্ধিত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি অনেক সিদ্ধান্তে মব বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এর অনেকগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নও আছে।
রাষ্ট্র যথাযথভাবে উদ্যোগী হয়ে উঠলে এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখন যা চলছে, সেটিকে রাষ্ট্রের অস্থিরতা বলা যাবে না। এটি হলো নাগরিকদের অস্থিরতা বা উদ্বেগ। এখনো যদি সরকার প্রচেষ্টা চালায় তাহলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এর জন্য সরকারকে কয়েকটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, অপরাধী ও অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে, যাতে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি না হয়। দ্বিতীয়ত, যারা এটিকে উপলক্ষ করে বেআইনি কাজ করতে চাইবে তাদের দমন করার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে নিতে হবে। তৃতীয়ত, যারা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করার চেষ্টা করছে তাদেরও রাষ্ট্র খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রকে এ তিনটি কাজ একই সঙ্গে করতে হবে।’
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন বেশ কয়েকটি মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে দফায় দফায় পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে গত মাসের শেষ দিকে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেয়া হয়। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হামলা ও ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে। পরে একটি জেলায় বন্ধ হওয়া ম্যাচ পুনরায় আয়োজন করা হলেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির জোর আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ছয় মাসের প্রায় পুরো সময় এভাবে জনমনে বড় ধরনের আতঙ্ক সঞ্চার করে রেখেছে মব সহিংসতা। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে একই দিনে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে দুজনের মৃত্যু দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এমন এক গণপিটুনির পর হাসপাতালে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লার। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারসহ নানা অভিযোগ থাকলেও আইনি পথে বিচারের পরিবর্তে এভাবে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি সে সময় বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়। সে সময় এমন আরো বেশকিছু ঘটনা ঘটে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শুধু সেপ্টেম্বরেই দেশে গণপিটুনির ৩৬ ঘটনায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মব জাস্টিসের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতির বিষয়টি প্রমাণ হয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এভাবে মব জাস্টিস যদি চলতে থাকে তাহলে দেশে আইনের শাসন, জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্র—সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা দেশকে এক নৈরাজ্যকর অবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। এর সুবিধা সে মহলই নেবে, যে মহল দেশটাকে অস্থিতিশীল প্রমাণ করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে বলি আর গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বলি, এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। মব জাস্টিসের মধ্য দিয়ে একটি জিনিস প্রমাণিত যে দেশে আইনের শাসন অনুপস্থিত।’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর বিগত কয়েক মাসে মব জাস্টিসের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে ঘটা এ ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ক্রমাগত হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এভাবে মব জাস্টিস বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিগত সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদরা। গত দেড় দশকে জনমানসে যে ব্যাপক মাত্রার ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, বর্তমানের ঘটনাগুলো এরই বহিঃপ্রকাশ বলে অভিমত তাদের। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘কেউ অন্যায় করলে বা অপরাধী হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিচারের বিধান রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো ব্যক্তি অন্যায় ও অপরাধ করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না। কোনো ব্যক্তি অন্যায় বা অপরাধের মুখোমুখি হলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ অথবা নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করতে পারেন। পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
মব জাস্টিস ইতোমধ্যে বাংলাদেশে মব ভায়োলেন্সে রূপলাভ করেছে। যা দেশের জন্য একটি ভীতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। আইনের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে যদি মব ভায়োলেন্স চলতে থাকলে এদেশটি অচিরেই একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিনত হবে। বিগত ১৬/১৭ বছর আওয়ামীলীগ সরকারের নীতিনির্ধারকদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে তাদের প্রতি জনগণের ক্ষোভ থাকতে পারে, সেজন্য মব জাস্টিসের তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে, লুটপাট করা, হত্যাসহ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়। বর্তমান অন্তবর্তিকালীন সরকারের উচিত এসব মব জাস্টিসকে শক্ত হাতে দমন করা। সংস্কারের নামে দমনপীড়ন পরিহার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, এটাই সাধারণ জনগণের বহুদিনের চাওয়া,আশা ও আকাঙ্খা।
মো. জাহিদুর রহমান, লেখক ও সাংবাদিক
এমএসএম / এমএসএম

জিনিস যেটা ভালো , দাম তার একটু বেশি

মব জাস্টিসের প্রভাবে বর্তমান বাংলাদেশ

সুস্থ জাতি গঠনে দরকার নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা

রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও একুশে বইমেলা

বিশ্ব জলাভূমি দিবস: টিকে থাকার জন্য জলাভূমি সুরক্ষা এখন সময়ের দাবি

দেবী সরস্বতী: বিদ্যা, জ্ঞান, ও শুভ্রতার বিশুদ্ধ প্রতীক

স্বাস্থ্যসেবায় বায়োকেমিস্টদের অবদান: এক অপরিহার্য দৃষ্টিভঙ্গি

আতঙ্ক আর হতাশার মধ্যেই ট্রাম্পের যাত্রা

কন কনে শীতে অযত্নে -অবহেলায় কাটছে পথশিশুদের জীবন

দাবি আদায়ের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন সাংবাদিক নেতা আলতাফ মাহমুদ

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৫: স্থায়ী শান্তির জন্য শেখা

জেন-জির হাত ধরে আগামীর নেতৃত্ব: সম্ভাবনা ও করণীয়
