জিনিস যেটা ভালো , দাম তার একটু বেশি

দু হাজার বারো সাল। তখন আমি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। জেড মোড়ে (জইল্লার মোড়) এক কৃষি অফিসারের বাসায় মেসে থাকতাম। আশেপাশে শিক্ষিত মানুষ বলতে তিনিই। উনার পৈতৃক নিবাস হাতিয়া। নদীভাঙ্গনের শিকার। বছর দশেক হলো এখানে বিশাল জমি কিনে বাড়ি করেছেন। বাড়িতে ফুল-ফল-কাষ্ঠল বৃক্ষের অভাব নেই। অভাব শুধু বিনোদনের। তবে উঠতি বয়সী ছেলেপেলেরা থাকলে বিনোদনের অভাব থাকে না। অল্প ক'দিনের মধ্যেই সবাই বিনোদিত হতে লাগলো। তবে একটা অভাব থেকেই গেলোঃ বাড়িওয়ালা প্রায় বৃদ্ধ মানুষ। থাকেন কর্মস্থলে। বাড়িতে উনার মা, সহধর্মিণী আর বোনের ছেলের বসবাস। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেপেলেরা আশা করে বাড়িওয়ালার সুন্দরী মেয়ে, নয়তো নাতনী থাকবে। মাঝেমধ্যে চোখে চোখ পড়বে। একদিন দু'দিন করে করে একটা চোখাচোখি সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। আজকে লবণ নেই, কালকে চিনি নেই - এজাতীয় নানা বাহানায় একটু দরজায় কড়া নেড়ে কথা বলবে। আস্তে আস্তে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আইডি বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালিত হবে। বিধি বাম! কপালে কিছুই জুটেনি। অন্তত পিচ্চি একটা বাচ্চা তো থাকতে পারতো? যাকে একবেলা পড়াতে গিয়ে মোবাইল টিপতে টিপতে দু'টা ভালোমন্দ নাস্তা আর মাস শেষে ক'টা "থাক এসবের কি দরকার ছিলো আন্টিঃ নেক্সট ইয়ারে আরেকটু বাড়ায় দিয়েন" জুটতো। টিউশনিটা আমার পেশা নয়; নেশা। জীবনের প্রথম টিউশনিটা ছিলো অম্লমধুর অভিজ্ঞতার। সেকথা আরেক দিন না হয় বলবো। নোয়াখালীতে আমি প্রথম টিউশনি শুরু করি সাতশো পঞ্চাশ টাকায়- অষ্টম শ্রেণির দুজনকে সপ্তাহে পাঁচ দিন! একজন পার্শ্ববর্তী স্কুলে পড়ে, আরেকজন আট ক্রোশ দ্বিচক্রযানে প্যাডেল মেরে জিলা স্কুলে। ছেলেগুলো খুব কষ্ট করেই মানুষ হচ্ছে। শুধু তারা নয় ঐ এলাকার সব শিশুরাই প্রতিকূল পরিবেশেই বেড়ে উঠে। দ্বিতীয় বর্ষে আমি শহরমুখী হলাম। মোটামুটি আন্টি সমাজে দক্ষ,মেধাবী,আন্তরিক,ভালো শিক্ষক হিসেবে একটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলাম। একটানা ছয়টা টিউশনও করিয়েছি। আমার রেটও বাড়িয়ে দিলামঃ বেড়েও গেলো। নোয়াখালীর টিউশনির বাজারে নোয়াখালী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নোবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সম্মুখীন হতোঃ আড়াই হাজার টাকার টিউশনি তাঁরা এক হাজার কিংবা আরও কমেও করাতো! যতটুকু জানি বর্তমানে নোবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের মধ্যেই টিউশনির বাজারে অসম প্রতিযোগিতা চলছেঃ 'কার আগে কে? কার চেয়ে কে? কম রেটে পড়াবে!' কিচ্ছু করার নেই! ছাত্রাবস্থায় অল্প ক'টা টাকার যে কি মূল্য? সেটা মধ্যবিত্ত - নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের চেয়ে বেশি বুঝেঃ একমাত্র ঈশ্বর। তারউপর প্রেম-ট্রেম করলে তো আর কথাই নেই! ধূম্র শলাকার প্রীতি থাকলে তো আরও দুর্দশা! একবার এক আন্টির রেফারেন্সে আরেক আন্টির মেয়ের জন্য টিউটর হিসেবে চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। বাড়িঘর এবং আংকেলের কর্মক্ষেত্রের বর্ণনা দেখে মনে হলো "বাহ্! বেশ ভালোই একটা প্রকল্প পেতে যাচ্ছি। ভবিষ্যৎ চিন্তা করা যায়।" কিছুক্ষণের মধ্যেই আশায় গুড়ে বালি! -- আমার মেয়ে খুবই ব্রিলিয়ান্ট! সব বোর্ড পরীক্ষায় A+ ~ জ্বি আন্টি। -- তোমার কোন কষ্ট করতে হবে না। ~ (মুচকি হাসলাম!) -- তো তোমাকে কত দিবো? ~ সাবজেক্ট তো চারটা, সপ্তাহে চারদিনঃ পাঁচ হাজার টাকা দিবেন, আন্টি। -- কি বলো? পাশের বাসায় অমুক তমুককে পড়ায়ঃ মাত্র পনেরো শো টাকা। আমি উনার আশ্চর্য হওয়া দেখে বিব্রত হলাম। স্বভাবত টিউশনির শুরুতে টাকাপয়সা নিয়ে আমি কথা বলতাম না। শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের বিবেকের উপরই ছেড়ে দিতাম। সে টিউশনিতে যে আন্টি পাঠিয়েছিলেন, তিনিই বলেছিলেন একটু টাকার বিষয়টা ফিক্সড করে নিতে। ভদ্রমহিলা বলতে পারতেনঃ আমরা তো "এতো" দিতে চাচ্ছিলাম; কিংবা তোমার আংকেলের সাথে কথা বলে জানাবো বলে ঐ আন্টির মাধ্যমে মানা করতে পারতেন। তিনি দরদাম করতে লাগলেন! -- কমায় বলো- কত দিবো? ~ আন্টি, আপনিই একটু বিবেচনা করে দেখুন। -- নাহ্! এতো টাকা হলে কিভাবে!? ~ আন্টি, টিচার যে ভালো, রেট তাঁর একটু বেশিই। আজ বহুদিন পর সেদিনের সে ঘটনাটা মনে পড়লো বাংলাদেশের একমাত্র ট্যাবলয়েড দৈনিক পত্রিকা মানবজমিনের একটা শিরোনাম দেখেঃ "টকশো তারকারা আন্দোলনে"! আজকাল তারকার অভাব নেই! টিকটক থেকে শুরু করে সমাজের নানা স্তরে নানান নামে নানান ঢঙে নানান রঙের নানান রকমের ক-ত যে তারকা আছে? আল্লাহ মালুম! বাংলাদেশে যে পরিমাণ তারকা- আকাশেও এতো তারকা আছে কিনা সন্দেহ! যাইহোক, নিরপেক্ষ টকশো যেমনঃ জিল্লুর রহমানের তৃতীয় মাত্রা, মতিউর রহমান চৌধুরীর (মতি ভাই) ফ্রন্টলাইন, খালেদ মুহিউদ্দীনের ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন (পূর্বতনঃ খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়) এজাতীয় টকশোগুলোতে নিরপেক্ষ আলোচকদের অনুষ্ঠান কখনো মিস করি না। বিশেষত নুরুল কবীর, জিল্লুর রহমান, সাইয়েদ আব্দুল্লাহ, মতিউর রহমান চৌধুরী (মতি ভাই), খালেদ মুহিউদ্দীনের টকশো এবং টকশোর বাহিরের আলোচনাও শুনি, শুনতে ভালো লাগে, চিন্তার খোরাক জাগে। এই মানুষগুলোকে আমার সততা এবং নিরপেক্ষতার প্রেমিক বলেই মনে হয় না শুধু; বিশ্বাস করি, আস্থা রাখি। ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিলোঃ এখনো ইচ্ছে করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, আইন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবো আর টকশোতে অংশ নিয়ে মা, মাটি ও মানুষের কথা বলবো। চাকরি থেকে অবসরে গেলে কিংবা ভবিষ্যতে চাকরি বিধিমালায় সে সুযোগ সৃষ্টি হলে চেষ্টা করে দেখবো। আমার বিশ্বাস আমি জনগণের কথা বলতে পারবো। কারণ আমি অতি সাধারণ। শিরোনামটা দেখে প্রথমে অবাকই হলাম। গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির জন্য অহরহ রাস্তা অবরোধ করতে শোনা যায়। তবে কি উনারাও? উনারা তো শিক্ষিত মানুষ। জাতির বিবেক। উনারা নিশ্চয়ই রাস্তা অবরোধ করবেন না। কয়েকজনের ফেইসবুক প্রোফাইল ঘুরে আসলাম। দেখলাম কেউই "রাজুতে আয়" বলেও ডাক দেননি। হাফ ছেড়ে বাঁচা গেলো। চিন্তায় ছিলাম বেচারা ইউনুস সাহেবকে নিয়ে। অন্তর-ভর্তি-সরকার এর দায়িত্ব নিয়ে কি বিপদেই না পড়লেন লোকটা! তন্মধ্যে আবার যদি টকশো তারকাদের মতো শিক্ষিত মানুষজন রাস্তায় নামে!? তাহলে তো মহা মুশকিল! জাগতিক সব সমস্যার মূল হচ্ছে শিক্ষিত ব্রাহ্মণ শ্রেণির দুষ্ট লোকজন। চিন্তা-দুশ্চিন্তার পাল্লা ভারী না করে নিউজের ভিতরে ঢুকলাম। পড়ে দেখি উনারা সম্মানী বৃদ্ধির জন্য অবরোধ পালন করছেন! নাহ্! কোন রাস্তা অবরোধ নয়। টকশোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকছেন। কি চমৎকার! কি জনবান্ধব আন্দোলন! বিভিন্ন দাবিদাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনকারীরা প্রায়শই জনদুর্ভোগের কথা ভুলে গিয়ে রাস্তা অবরোধ করে বসেন। এতে করে সাধারণ পথচারী, অফিসগামী, জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষের কষ্টের কোন সীমা থাকে না। টকশো তারকাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের এজাতীয় ফর্মুলাটি ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়ঃ ক'জন শিখবে? ক'জন মানবে? কি হওয়া উচিত আমরা বলতে পারি। কি করা উচিত তা-ও বলতে পারি। কিভাবে করতে হবে তা-ও বলতে পারি। কিন্তু কিছু করতে গেলে কাউকেই পাওয়া যায় না। তবে ড. ইউনুস নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য একটা ইতিবাচক দিক হচ্ছে- এখনো পর্যন্ত উনার ডাকে সবাই মশাল হাতে দাঁড়িয়েছে অন্ধকার দূর করতে। ভবিষ্যতে সেই মশালে অন্ধকার দূর হবে নাকি ঘর পুড়বে; তা সময়ই বলে দিবে। সময় সময় আমরাও জানতে পারবো কি হয়? কি হচ্ছে? কিভাবে হচ্ছে? কে কি করছে? নিশ্চয়ই টকশো তারকাগণ তাঁদের মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার দিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপের চুল চেরা বিশ্লেষণ করবেন। এই মেধা, এই দক্ষতা, এই অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করা উচিত। আমাদের একটা নেতিবাচক সংস্কৃতি আছে- আমরা যথাসময়ে যথাযথভাবে গুণী লোকের কদর বুঝি না/করি না। নতুন দিনে এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাঁদেরকে সম্মান করতে হবে; সম্মানীও দিতে হবে। শুকনো কথায় তো আর চিড়া ভিজে না, তাই-না? একটু আনমনে ভাবলামঃ গার্মেন্টস শ্রমিকের জন্য যা 'বেতন'; তাই তারকাদের জন্য 'সম্মানী'। অর্থাৎ সম্মানী হইলো বেতনের ব্রাহ্মণীয় রূপ। উর্ধ্বমূল্যের বাজারে সকল শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। সেই সাথে বেতনের ব্রাহ্মণাঙ্গীয় সম্মানীও বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। বাজারের আগুন লুটেরা, ঘুষখোর, দূর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, স্বৈরাচারীদের ঘরে না লাগলেও সৎ লোকের ঘরে লাগছে। অচিরেই এই আগুন নেভাতে হবে; অন্যথায় সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। সেই সাথে বাড়াতে হবে শ্রমিকের মজুরি, প্রেমিকের সম্মানী। একথাও মনে রাখতে হবে খাঁটি প্রেমিকের মূল্য আর প্লেবয়দের মূল্য কিন্তু এক না; একটু বেশি। এজন্যই কবি বলেছেন, "জিনিস যেটা ভালো, দাম তার একটু বেশি।" লেখক: ফারহান রাজিব নিরাপদ খাদ্য অফিসার, চট্টগ্রাম
এমএসএম / এমএসএম

জিনিস যেটা ভালো , দাম তার একটু বেশি

মব জাস্টিসের প্রভাবে বর্তমান বাংলাদেশ

সুস্থ জাতি গঠনে দরকার নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা

রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও একুশে বইমেলা

বিশ্ব জলাভূমি দিবস: টিকে থাকার জন্য জলাভূমি সুরক্ষা এখন সময়ের দাবি

দেবী সরস্বতী: বিদ্যা, জ্ঞান, ও শুভ্রতার বিশুদ্ধ প্রতীক

স্বাস্থ্যসেবায় বায়োকেমিস্টদের অবদান: এক অপরিহার্য দৃষ্টিভঙ্গি

আতঙ্ক আর হতাশার মধ্যেই ট্রাম্পের যাত্রা

কন কনে শীতে অযত্নে -অবহেলায় কাটছে পথশিশুদের জীবন

দাবি আদায়ের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন সাংবাদিক নেতা আলতাফ মাহমুদ

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৫: স্থায়ী শান্তির জন্য শেখা

জেন-জির হাত ধরে আগামীর নেতৃত্ব: সম্ভাবনা ও করণীয়
