ঢাকা বৃহষ্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০২৫

এ যেন এক নতুন কক্সবাজার


জোহোরা জাবিন কারিম photo জোহোরা জাবিন কারিম
প্রকাশিত: ২২-১০-২০২১ দুপুর ৪:৩৮
করোনাকালীন সময়ে এক বছর গৃহবন্দী থাকতে থাকতে যথন হাপিয়ে উঠেছিলাম, তখন মনে হলো একটু নিঃশ্বাস নিয়ে আসি। এই সময় হয়তো কক্সবাজারে লোকজনের ভীড় কম থাকবে। তাছাড়া তখন সংক্রমনের হারও অনেক খানি কমে এসেছিল। আমি ও আমার স্বামী সঙ্গে আমার ভাবী, ভাইপো ও তাঁর স্ত্রী আমরা পাঁচজন আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ি কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। অবশ্যই মাস্ক পরে ও ব্যাগের ভেতর স্যানিটাইজার নিয়ে। আমার মেয়েরাই অনেকটা উদ্যোগী হয়ে আমাদের দুজনকে পাঠিয়ে দেয়। ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক , তখন অনলাইন ক্লাস চলছিল বলে ওরা যেতে পারেনি। নিদির্ষ্ট দিনে আমরা নোভো এয়ার লাইনসের একটি ফ্লাইটে কক্সবাজার যাই।
 
অনেক বছর পর আমাদের কক্সবাজারে আসা। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর পরই অর্থাৎ  ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই আমি আমার স্বামীর সাথে প্রথম কক্সবাজারে আসি। সেই সময়ের কক্সবাজারের সাথে এখনকার কক্সবাজার কোন ভাবেই মেলানো যায় না। তখন আমার স্বামীর কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রামে। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আমরা চট্টগ্রামেই ছিলাম। সেই সময়টায় খুব ঘন ঘন কক্সবাজার যাওয়া হতো। ১৯৮৬ সালে আমরা ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় আসার পর সম্ভবত ১৯৯০ সালের দিকে বাচ্চাদের নিয়ে একবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম। ত্রিশ বছর পর এবার যখন কক্সবাজার গেলাম, হঠাৎ করে পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো মনে হলো। যান্ত্রিক বা নগরায়নের কারণে সেই কক্সবাজার আর আজকের কক্সবাজারে যোযন যোযন পার্থক্য। 
 
আগে কক্সবাজার বলতে ছোট্ট একটা শহর বোঝাতো। একটি প্রধান সড়ক এর ওপর যা কিছু আছে এই নিয়েই কক্সবাজার শহর। এখন অনেক নতুন নতুন রাস্তা শাখা প্রশাখার মত চোখে পড়লো। নতুন নতুন বেশ কয়েকটা সরকারি অফিস চোখে পড়ার মতো। একটি বড় সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ, এছাড়াও অনেক সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। যা আগে ছিল না। আগে প্রধান সড়কের দু'পাশে ছোট ছোট আধাপাকা দোকান ঘর ছিল। টিম টিম করে আলো জ্বলতো বার্মিজ দোকান গুলোতে। রাস্তায় তেমন কোন আলোই ছিল না। ধরতে গেলে অন্ধকার শহর ছিল কক্সবাজার। শুধু সুমুদ্রই ছিল এর প্রধান আকর্ষণ। একমাত্র অভিজাত হোটেল ছিল 'হোটেল সাইমন'। আর একটু কম খরচে উঠা যেত 'হোটেল পানওয়াতে'। এছাড়া তখন সরকারি কয়েকটা মোটেল এবং একটি গেস্ট হাউজও ছিল। এখনতো প্রচুর উন্নত মানের আধুনিক হোটেল ও গেস্ট হাউজ তৈরী হয়েছে। তাছাড়া সেই 'সাইমন হোটেল' এখন আর নেই। ওটা ভেঙ্গে এখন নতুন করে একেবারে কলাতলি বীচের কাছে আধুনিক ধারার চার তারকা হোটেল তৈরী হয়েছে 'হোটেল সাইমন'। আমরা এই হোটেলেই উঠি এবং চারটি দিন আনন্দে কাটাই। খুবই সুন্দর হোটেল। যখন তখন বীচে চলে যাওয়া যায়। রুমে বসে, বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন, ফেনা তোলা ঢেউ এর আছড়ে পড়া, এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। 
 
এই হোটেলের চতুর্থ তলায় আছে একটি খোলা জায়গায় চমৎকার সুইমিং পুল। ঠিক তার পেছনেই সমুদ্র। সুইমিং পুলের পানির সাথে সমুদ্র মিশে যেন একাকার হয়ে আছে। অপূর্ব দৃশ্য! প্রতিরাতে এই সুইমিংপুলের পাশেই থাকে বারবিকিউ এর আয়োজন। 
 
কক্সবাজারের এই পরিবর্তন ২০০৭-৮ সালের সময় থেকেই শুরু হয়েছে। সেই সময় ঢাকা থেকে অনেক বড় বড় উদ্যোক্তারা চলে আসে কক্সবাজরে, তৈরী করে ভাল উন্নত মানের হোটেল, এপার্টমেন্ট। সেই সাথে অনেক ফ্রেঞ্চাইজ রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুডের দোকান, এছাড়া দেশীয় খাবারের দোকানও তৈরী হয় চোখে পড়ার মত। সব চাইতে উল্লেখযোগ্য হলো কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রের বিচের পাশ দিয়ে ৮০ কলোমিটার পথ বা মেরিন ড্রাইভ হবার পর থেকেই এখানে মানুষের সমাগম বেড়ে যায়। বর্তমানে সারা বছরই উপচে পড়া ভীড় লেগে থাকে। আগে কক্সবাজারে কেবল মাত্র শীত কালেই মানুষ বেড়াতে আসতো। এছাড়া এখন অনেক বিদেশী টুরিস্টদেরও আসতে দেখা যায়।
 
২০১৭ সালের ৬ মে এই মেরিন ড্রাইভ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সুন্দর মসৃণ বিস্তৃত পথ। এটা এখন পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ। 
 
আমরা কক্সবাজার যাবার পর দিনই বেরিয়ে পড়ি মেরিন ড্রাইভে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশ সেরে নেই হোটেলের ডাইনিং হলে। আগে থেকেই আমাদের মাইক্রোভ্যানের ব্যবস্থা করা ছিল। ঠিক সময়ে গাড়ি চলে আসে, আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করি সারাদিনের জন্য। মেরিন ড্রাইভে যেতে যেতে পুরোনো অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। হঠাৎ থমকে গিয়ে আবার বাস্তবে ফিরে আসি। কখনো ভাবতেই পারিনি নিজের দেশেই এমন দৃশ্য দেখতে পাব। একদিকে উচু পাহাড় অপর দিকে বিশাল সমুদ্র। মাঝখান দিয়ে একেবেকে চলে গেছে পিচ ঢালা পথ। বহুদুর বিস্তৃত মসৃণ এই পথ। একদিকে সমুদ্র সৈকত অন্যদিকে পাহাড়ের গা ঘেষে রয়েছে কোথাও ঘন বন, কোথাও ঝোপ ঝাড়ের মাঝে রয়েছে গুল্মলতায় ঘেরা নানা রঙের বুনোফুলের সমাহার। ফাগুনের হাওয়ায় সেই বুনো ফুলের গন্ধ আর সমুদ্রের রাশি রাশি ফেনা তোলা ঢেউ,তরঙ্গিত জলচ্ছ্বাস, কি অপূর্ব অনুভূতি, অপূর্ব দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি চোখ বুজে এখনও সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পাই। 
 
এই মেরিন ড্রাইভে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে লর্ন এ যাবার সময় গ্রেট ওশান রোডের মেরিন ড্রাইভের কথা। ২০০৬ সালে আমি অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে গেলে সেটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। মেলবোর্ন থেকে লর্ন এ পৌছাতে বাইরোডে তিন ঘন্টা সময় লাগে। তবে গ্রেট ওশান রোডের জার্নিটা ছিল এক ঘন্টার। দারুণ উপভোগ্য ছিল জার্নিটা, একদিকে সবুজে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড় অপর দিকে প্যাসিফিক মহাসাগরের উত্যাল ঢেউ। এই অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে গ্রেট ওশান রোড পার হয়ে আমাদের গন্তব্য লর্ন এ এসে পৌছি। তবে সেই জার্নিটা এতই অপূর্ব ছিল যে, আমি জীবনে কোন দিন ভুলব না। ভবিষ্যতে কোন দিন এই বিষয়ের ওপর লিখবার ইচ্ছে রইল। 
 
এখন আমাদের কক্সবাজারের মেনির ড্রাইভ প্রসঙ্গে আসা যাক। এই পথে ভারী যানবাহন চলাচল নিষেধ। এই মেরিন ড্রাইভে যেতে যেতে পাহাড় আর সমুদ্র ছাড়াও চোখে পড়বে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট। কিছুদুর পর পর বিভিন্ন নামকরণে আছে সমুদ্র সৈকত। যেমন- সুগন্ধা বীচ, সীগাল পয়েন্ট বীচ, কলাতলী বীচ, ইনানী বীচ, কোরাল বীচ, কাক্‌ড়া বীচ। এই সমস্ত বীচে মানুষের উপচে পড়া ভীড়। ত্রিশ বছর আগে ছিল শুধু একটি মাত্র বীচ, লাবনী বীচ। আজ কত বীচ, কত হোটেল রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে এই মেরিন ড্রাইভকে কেন্দ্র করে। আমরা ইনানী বীচ, কোড়াল বীচ, কাক্‌ড়া বীচ ঘুরে এসে একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করি। সেটা হলো কোড়াল বীচের ঠিক উল্টো পাড়ে, পাহাড়ের গা ঘেসে। রেস্টুরেন্টের নাম " কোরাল রেষ্টুরেন্ট"। চমৎকার পরিবেশে মন জুড়িয়ে যাবর মত। কন্টিনেন্টাল ও দেশীয় খাবারের চমৎকার পরিবেশন। 
 
আমরা দেশীয় খাবারের সাথে কন্টিনেন্টাল খাবারও গ্রহণ করি । অপূর্ব সুস্বাদু রান্না সেই সাথে পরিচ্ছন্ন সুন্দর পরিবেশ। সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে খাওয়া, এটা ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। আরও কিছু বীচ দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে আসার। আমরা বেশ ক্লান্গ ছিলাম, তবে হোটেলের সুইমিংপুলের পাশে বার্বিকিউ ডিনারটি একেবারে মন ভরিয়ে দেয়। 
 
পরদিন সকালে আমাদের এক কাছের আত্মীয়ার খামার বাড়ী দেখতে কক্সবাজার থেকে দেড় ঘন্টা ড্রাইভে চকোরিয়ার পেকুয়া গ্রামে যাই। যেতে যেতে দু'পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যে বিমোহিত হয়ে পড়ি। আমাদের গন্তব্য পেকুয়ায় চলে আসি সকাল ১১ টায়। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো একটি খামার বাড়ী। 
 
একটি টিনের বাংলা ঘর, তার সাথে দুই রুমের পাকা বিল্ডিং সংগে লাগায়া বাথরুম। খামার বাড়ীর পেছন দিকে গরু আর মুরগীর টানা লম্বা ঘর। চারদিকে নানা রকম ফলের গাছ। মাঝখানে সবজি বাগান, এক পাশে পুকুর ঘাটের সাথে একটি সুন্দর গ্যাজিবো। চারদিক খোলা গ্যাজিবোতে বসার জন্য রয়েছে দু'দিকে পাকা বেঞ্চি। তারপর কয়েক ধাপ সিড়ি দেয়া পুকুরের ঘাট। আমরা খামার বাড়ীটি ঘুরে ঘুরে দেখে এই পুকুর ঘাটের গ্যাজিবোতে যেয়ে বসি। এত ভাল লাগছিল পরিবেশটা যে ওখানে বসেই সারাদিন পার করে দেই। আমাদের আপ্যায়নের বহর ছিল দারুন। প্রথমে ডাবের পানি, জুস, কোমল পানিও তারপর পিঠা পায়েস। এরপর দুপুরের খাবারে বিশাল আয়োজন। বাঙ্গালির অষ্টব্যাঞ্জন আহারের পর মিষ্টান্ন না হলেই নয়। তাই পেকুয়ার বিখ্যাত দই খাঁটি গরুর দুধে তৈরী, এর সাথে রসগোল্লা মিশে একেবারে সোনায় সোহাগা। 
 
সন্ধ্যার আগেই পেকুয়া থেকে রওনা দেই কক্সবাজারের পথে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় হোটেলে ফিরে এসে সবাই একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে শহরের একটি সিফুড রেষ্টুরেন্টে ডিনার খেতে যাই। রেষ্টুরেন্টের নাম মারমেইড ক্যাফে। এত সুন্দর ভাবে সাজানো রেষ্টুরেন্ট, বিশ্বাস হচ্ছিলনা এটা কক্সবাজার, এক কথায় সুশোভিত মারমেইড ক্যাফে। খাবারও বেশ ভাল এবং অবশ্যই অথেনটিক সিফুড। খাবার শেষে পরিতৃপ্তি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। বেশ ক্লান্ত ছিলাম, তাই তাড়তাড়ি শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসছিল না। নানা কথা মাথায় এসে ভীড় করছিল। এই টুকুন একটি ছোট্ট শহর কক্সবাজার, সারাদেশের মানুষ আসে এখানে একটু বৈচিত্র খুঁজতে, নগর জীবনের ক্লান্তি দুর করতে। যদিও শহরের আয়তন এখন বহুগুন বড়েছে। মানুষের প্রয়োজনে বহু কিছু গড়েছে। দেখলাম পাঁচ তারকা হোটেল 'রেডিসন' তৈরী হচ্ছে, প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। এরপর তো বিদেশী পর্যটকদেরও ভীড় লেগে থাকবে। যদিও আমাদের দেশের জন্য এটা ভাল দিক। তারপরও মনে নানা প্রশ্ন জাগে মানুষের বিরামহীন ঢলের কথা ভেবে। তাই কর্তৃপক্ষকে এখন থেকেই অনেক ব্যাপারে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। 
 
পরদিন সকালে আবার বীচে চলে যাই। সেদিন ছিল আমাদের কক্সবাজারের শেষ দিন। কিছুক্ষণ বীচে থেকে, প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়ি শহরের বার্মিজ দোকান গুলোতে। এখন এই সমস্ত দোকানগুলোর অনেক উন্নতি হয়েছে। দোকানের সংখ্যা অনেকগুন বেড়েছে। বার্মিজ দোকান ছাড়াও পর্যটকদের জন্য অনেক ধরনের কেনাকাটার সুবিধা হয়েছে। আমরা কিছু কেনাকাটা সেরে একটি রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চ করি। রেষ্টুরেন্টের নাম 'সান ড্যান্সার'। সেদিন রাতে আমাদের সেই আত্মীয়ার বাড়ীর নিমন্ত্রণ গ্রহন করে চলে আসি হোটেলে। সব গুছিয়ে নেই রাতেই। কারণ পর দিন ফিরতে হবে ঢাকায়।

এমএসএম / এমএসএম