ঢাকা বুধবার, ৬ আগস্ট, ২০২৫

একটা আগুন পাখি উড়ে গেল মহাশূন্যের বুকে


ফারজানা ইসলাম ভূঁইয়া ও মো. শাহিন রেজা photo ফারজানা ইসলাম ভূঁইয়া ও মো. শাহিন রেজা
প্রকাশিত: ১-১২-২০২১ বিকাল ৭:৫৭

ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়া জেলার নবীনগর থানার ছোট্ট একটি গ্রাম গুড়িগ্রাম। ১৯৪৭ সালে ১৫ অক্টোবর সেই গ্রামের আলো জ্বলে জন্ম নিয়েছিলেন প্রফেসর জোহরা আনিস। ছোট বেলা থেকেই প্রচন্ড রকম আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর কাজ-কর্ম, দায়িত্ববোধ এবং কর্তব্য পালনে বড়ত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন আজীবন। শত বাঁধাকে উপেক্ষা করেও হাসি মুখে স্বপ্ন ফেরী করে বেড়িয়েছেন আমৃত্যু। এই স্বপ্ন সারথি তাঁর বর্ণ্যাঢ্য কর্মজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনে রেখে গেছেন অনন্য স্বাক্ষর। প্রফেসর জোহরা আনিস ব্যক্তিগত জীবনে একজন শিক্ষক, সমাজসেবী, রাজনৈতিক কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সফল সংগঠক ছিলেন। 

তৎকালীন ব্রিটিশ পাকিস্তানের সময় সৎ ও আদর্শ স্কুল শিক্ষক বাবা এবং অত্যন্ত মেধাবী ও বিচক্ষণ বুদ্ধিসম্পূর্ন একজন মায়ের সন্তান জোহরা আনিস। যিনি বাবা মায়ের ছয় ছেলে মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়। কেবল সন্তান হিসেবেই তিনি বড় ছিলেন না, তিনি তার কাজ-কর্ম, দায়িত্ববোধ এবং কর্তব্য পালনেও বড়ত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন সব সময়। তিনি সারা জীবন তাঁর বাবা মায়ের আদর্শকে বুকে লালন করে পথ চলেছেন। বাবা এবং ভাইকে হারিয়ে কেবল মা এবং বোনদের সাথে নিয়ে একটি গ্রামের সহজ সরল মেয়ের পক্ষে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কাজ করা খুব একটা সহজ কথা নয়। নানা কুসংস্কার আর পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীকে পদদলীত করে সমাজে নারীর জয়গান গাওয়া কোন সহজ গল্প নয়, কিন্তু সেই সব কিছুই জোহরা আনিস করেছেন নির্বিঘ্নে এবং নির্ভয়ে। সেই স্বপ্ন সারথিকে নিয়েই আজকের উপাখ্যান।

স্কুল শিক্ষক বাবা মায়ের মতো তাদের জ্যেষ্ঠ সন্তান জোহরা আনিসও নিজের জীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। জোহরা আনিসের বাবা মাস্টার আব্দুল কুদ্দুস ভূঁইয়া এবং মা ফাতেমা কুদ্দুস ভূঁইয়া।আমরা জানি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশই হলো গ্রাম ও পল্লি এলাকায় বসবাস করা নারী , যারা উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে। সেই জায়গায় বাংলাদেশের মতো একটি একটি উন্নয়নশীল দেশ এখনও যে দেশে নারীর সমঅধিকার নিয়ে নিত্য আন্দোলনে পদদলীত হতে হয় লাখো নারীকে অথচ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নারীদের জন্য কেমন ছিল তা আমাদের সকলের জানা কিন্তু সেই সময়ের কোন বাঁধাই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি জোহরা আনিসের চলার পথে। তৎকালীন সময়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও জোহরা আনিস তার মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে পরিবার, গ্রাম, সমাজ তথা দেশের কল্যানে কাজ করে গেছেন নীরবে।

এক শতাব্দী আগে যে বেগম রোকেয়া নারী মুক্তির কথা বলে গেছেন , দেখিয়ে গেছেন নারী মুক্তির পথ সেই পথে জোহরা আনিস ছিলেন একজন সারথি। একজন নারীর জন্য পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। জোহরা আনিস নারী মুক্তিসহ সমাজের নানা স্তরে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে অংশগ্রহন করেছেন।

সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে জোহরা আনিস ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী গ্রহন করেন। তিনি ছাত্র জীবনে অর্থাৎ ৬০’ এর দশকে ছাত্র আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় উত্তাল ঢাকার রাজপথে সকল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি পেশাগত দ্বায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নারী শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি অন্যায় আচরনের বিরুদ্ধে পরিচালিত নানা কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ সহ সমাজ সেবা এবং জনকল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

পেশাগত জীবনে তিনি কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং কুমিল্লা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ২০০৫ সালে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহন করেন প্রফেসর জোহরা আনিস। তিনি তার শিক্ষকতার যে জিয়ন কাঠি হাতে তুলে নিয়েছিলেন তার স্পর্শে আলোকিত হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী। তিনি শিক্ষক হিসেবে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন তেমনি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণা এবং ভালবাসার একজন আদর্শ মানুষ। তাই পেশাগত জীবনে অবসর গ্রহন করলেও বাবা মায়ের লালিত স্বপ্ন এবং তার নিজের অন্তরে স্বপ্ন জয়ের যে সুর বেজে চলত সেই সব থেকে কোন দিন অবসর নেননি প্রফেসর জোহরা আনিস।

পেশাগত দায়িত্ব শেষ করে সমাজের মানুষের জন্য যতটা কাজ করেছেন অবসরে গিয়ে তার থেকে শতগুনে বেশি কাজ করেছেন প্রতিনিয়ত। তিনি তার অবসর জীবনে প্রবেশের পাশাপাশি যে নারীর উন্নয়ন, নারী শিক্ষার অগ্রগতি, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, সমাজের পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানো এবং জনকল্যাণের জন্য যে আলোর মশাল হাতে তুলে নিয়েছেন, সেই মশাল হাতে কখনো রাজপথে, কখনো মিছিলে, কখনো মিটিংয়ে, কখনোবা সভা সমিতিতে উপস্থিত থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন নীরবে। শুধু সামাজিক দায়িত্ব পালন নয় তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও রেখেছেন অন্যন্য সাক্ষর। সুস্থ্য শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার আন্দোলনের মাঠেও তিনি রেখেছেন সফল পদচারনা।

প্রফেসর জোহরা আনিস কুমিল্লা মহিলা সংস্থার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ সুদীর্ঘ সময় ধরে কুমিল্লা জেলা ক্রিড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ হিসেবে অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করেছেন।

শুধু তাই নয় তিনি কুমিল্লা বঙ্গবন্ধু মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে।এছাড়াও ওল্ড ভিক্টোরিয়ান্স এই নারী বিএনসিসি’র প্রতিষ্ঠাতা প্লাটুন কমান্ডার ও পরে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সুজন, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, অন্ধ কল্যান সমিতির সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। প্রফেসর জোহরা আনিস কুমিল্লা পূর্বাশা ও মধুমিতা, কচিকাঁচার মেলা, নারী প্রগতি, কুমিল্লা সমিতি, ব্লাস্টসহ আরো কিছু সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রফেসর জোহরা আনিস তার জীবনে শুধুমাত্র যে সমাজসেবা এবং জনকল্যাণ করে রাজপথে সাক্ষর রেখেছেন তা নয় তিনি যেমন শক্ত হাতে মশাল ধরে রাজপথে আলো ছড়িয়েছেন ঠিক তেমনি তার মেধা এবং বিচক্ষনতা দিয়ে আলোকিত করেছেন নিজের পরিবার পরিজনকেও। কর্মজীবনে যেমন একজন সফল নারী তিনি ব্যক্তি জীবনেও অসম্ভব সফল এজজন সন্তান, মা, বোন। তিনি কেবল নিজের পরিবার নয় তিনি তার অন্য বোনদের চলার পথেও মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে, উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা দিয়ে পাশে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন মমতাময়ী মায়ের মতো করে।

তারই ধারাবাহিকতায় তিন মেধাবী সন্তানের জননী প্রফেসর জোহরা আনিস জাতীয়ভাবে “রত্নগর্ভা মা” পদকে ভূষিত হন। তার প্রতিটি সন্তান মেধা এবং কর্ম দিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে দেশের জন্য , মানুষের কল্যানের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে  ডাক্তার আর দুই মেয়ে পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। হবে আদর্শবান মানুষ। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাঁর ছেলে কুমিল্লার বিখ্যাত ডাক্তার আরিফ মোর্শেদ খান, দুই মেয়ের মধ্যে একজন জোবেদা কনক খান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অন্যজন রাশেদা রওনক খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি নিজ সন্তানদের পড়াশোনা শেখানোর সাথে সাথে বাড়ি দেখাশোনা কাজে কর্মরত দুইজনকেও পড়িয়েছেন। যাদের একজন সরকারি এবং অন্যজন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। শিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে তাঁর মেয়ে জোবেদা কনক খানকে জাফর ইকবাল স্যার একবার বলেছিলেন, " তোমাদের বাসায় যদি বিড়াল পোষতেন তোমার আম্মা তা হলে সেও মানুষ হয়ে যেত”। সত্যিকারের মানবিক গুনে গুণান্বিত তাঁর সন্তানেরা ফুলের মত চারদিক সুভাষিত করছেন, মানুষকে ভালোবাসা দিচ্ছেন যেমনটা তিনি চেয়েছিলেন। 

দেশ, সমাজ এবং সর্বপরি নারী সমাজের জন্য অসামান্য আত্মদানের ফলস্বরূপ এই মহিয়সী নারী এ যাবৎ বহু পুরষ্কারে পুরুষ্কৃত হয়েছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বড়  প্রাপ্তি হল তিনি ২০১৮ সালে ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া পদকে ভূষিত হয়েছেন। প্রফেসর জোহরা আনিস এমন একজন স্বপ্নবাজ মানুষের নাম যিনি সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, ভাই-বোন, সন্তান, নাতি, নাতনিসহ অগুনিত মানুষকে। সমাজের তথা দেশের একজন আলোকবর্তিকা, একটা আগুন পাখি ৭৫ বছর বয়সে ২১ অক্টোবর ২০২১ তারিখে তাঁর বর্ণ্যাড্য কর্মজীবনের ইতি টেনে সকল মায়ার বাঁধন আলগা করে উড়ে গেল মহাশূন্যের বুকে।

 

লেখক: ফারজানা ইসলাম ভূঁইয়া

সহ-কোষাধ্যক্ষ, ফাতেমা কুদ্দুস ফাউন্ডেশন।

ও মো. শাহিন রেজা,

সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 

এমএসএম / এমএসএম