ঢাকা রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

" যমুনা একটি মেয়ের নাম "


ফারজানা আহমেদ  photo ফারজানা আহমেদ
প্রকাশিত: ১৩-৬-২০২১ রাত ১১:৪২
যমুনার বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ঢেউ।কেউ তা জানে না,এই ঢেউ ওকে ভাঙে! বুকের ভেতরের শক্ত মাটিকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলে। ও কাঁদতে পারে না,চোখের জল নদীর ঘোলাটে জলে মিশে! 
 
যমুনা একটি নদীর নাম, যমুনা একটি মেয়ের নাম।যমুনায় সাঁতার কেটে বড় হওয়া একটি মেয়ে।রূপ নেই,গুণ নেই বাপ মরা একটি মেয়ে।মায়ের নতুন সংসারে ঠাঁই হয়নি ওর।তাই ও ভেসে বেড়ায়। কচুরিপানার মতো অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে ও।
 
হেলেঞ্চা শাক উঠাতে বলে মামী,যমুনা ছুটে আসে নদীর ধারে। নদী ওকে টানে,জড়িয়ে ধরে। নানান রকম নৌকা, কোনটায় পাল তোলা, কোনটা পাল ছাড়া, বড়  ছোট লঞ্চ নদীতে ভেসে যায়। সুদূরের পানে ওকে টানে,কোন অজানার পানে ওর মন চলে যায়! 
 
মায়ের উপর রাগ হয় যমুনার। কেন ওকে ফেলে রেখে গেছে মামা মামীর কাছে! কেন মা ওকে সাথে নিয়ে যায়নি? মায়ের বিয়ের পর একদিন যমুনা লঞ্চে উঠেছিল!তখন ওর পাঁচ কী ছয় বছর বয়স। যমুনা হারিয়ে যেতে চায়,কোন অচেনা অজানা জায়গায়। যেখানে ওর মা বা পরিচিত কেউ থাকবে না।
মায়ের এক মামাতো ভাই সেই লঞ্চে ছিল, ওকে দেখে বলে,
- কীরে যমুনা গেদী? তুই কনে যাচ্ছিস?
- যমুনা ভয়ে কোন কথা বলতে পারে না। চুপ করে বসে থাকে লঞ্চের মেঝেতে।
- এই গেদি ওঠ ওঠ।
যমুনা উঠে দাঁড়ায়, ভয়ে আতঙ্কে শরীর কাঁপতে থাকে ওর।
তারপর মামার বাড়ি ফিরায়ে নিয়ে আসে মার সেই ভাই।মামা মামী সব শুনে মারতে থাকে। 
- মামা বলে, এতো আদরে রাখিচ্ছি।কোন মামা তা করবি? আরামে থাকা পছন্দ হইতাছে নারে!
- মামী চুলের মুঠি ধরে বলে, এরপর কোনদিন পালাতি চাইলে তোরে কইলাম জানে মাইরে ফেলাবো বুঝলি?
তারপর আর কখনো যমুনা পালায় নাই কিন্তু ওর দুইচোখে অজানায় ছুটে যাওয়ার নেশা।
 
একদিন মায়ে আইসা চুপ চুপ কইরা কইল,গেদী তোর জন্য আমি বিয়া করছিলাম কিন্তু ওই বেটা বিয়ার পর কয় তোরে রাখবো না। আমি কী করমু, কতো বুঝাইছি বোঝে না।এখন আমারে প্রতিদিন মারে।বিয়া কইরা কী লাভ হইলো? তারচেয়ে মায়ে মেয়েতে না খাইয়া একসাথে থাকতাম তাও ভালো আছিলো। মায়ের কথা শুনে ওর বুকে ব্যথা করে,দম বন্ধ হয়া আসে।
 
যমুনা নদী থেকে ফেরার পথে, হেলেঞ্চা শাক তুলে আনে।
- মামী কয়, এতো দেরী হলি ক্যা? নবাবের বেটি কোনে গিছিলু? হাওয়া খাতি গেছিলু? তোর জানে ভয়ডর নাই! 
- হেলেঞ্চা শাক কোনো পাথারেও পাওয়া গেলি না।তাই দূরে যাইয়া লিয়া আসলাম।
- মিথ্যা কথা কইতে পারিস খুব! আমি দেখলাম পাগাড়ের পাশে পলাশগির খেতে অনেক হেলেঞ্চা শাক?  তোর চোখত পড়ে নাই!
- মামী, কে জেন তুলি লিয়া গেছে।আমি যাওয়ার আগেই।
- নবাবের বেটি এখন যা, হাড়ি পাতিল তাড়াতাড়ি মাইজা দে। তারপর ঘর উঠান ঝাড়ু দে। খড়ি পাড় গাছ থিকা বুঝলি নবাবের বিটি।
- আচ্ছে মামী।
 
যমুনার চোখে কালো মেঘে ঢাকা আকাশ, বেদনার ঢেউ,অজানা ভয়। মা বাবা ভাই বোন হারা এক কিশোরী। রাতের আঁধার হলি বুক ধরফর করে। মায়ের বুকের ওম খুঁজে। ফুটফুটে জোছনার আলো পড়ে উঠানে,যমুনা উঠানের বড় জামগাছটারে জোছনার আলোতে ঝলমল করে ওঠতে দেখে!ওর জীবনে কোন জোছনা নাই, আমাবস্যা রাইত থাকে! বাপ যখন বাঁইচা আছিলো তখন ওর বয়স  চার বছর। বাপ মায়ে আদর করতো, কোলে নিতো।হঠাৎ একদিন বাপটা মইরা গেল। মা ওরে নিয়ে মামার বাড়িতে আসলো।তখন মামা মামী মিলা মায়েরে বিয়া দিয়া দিলো।
 
মা চইলা গেলো, আর ফিরলো না।ওরে একবার দেখতেও আসলো না।একা একা শুইয়া রাতের আঁধারে মায়ের গায়ের ঘ্রাণ খুঁজতো।মামার বাড়িতে কাজ করে আর সবার খাওয়ার পর যা বাচে তাই খায়। মামার ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে, যমুনার খুব সখ লেখাপড়া করবো কিন্তু কে ওরে লেখাপড়া করাবো? স্কুলে গেলে কে মামীর সংসারের কাজ করবো?মায়ের বিয়ার একবছর পরে মা আইসলো একদিন, কোলে ফুটফুইটা একটা গেঁদা! যমুনা মায়েরে জিজ্ঞেস করলো, 
- এইটা কার গেঁদা মা?
- এইটা তোর ছোটভাই।
- কী মা! এইটা আমার ভাই? যমুনা খুশি হইয়া গেদারে কোলে লিতি চাইলো।
- মায়ের স্বামী কয়, গেঁদারে ওর কোলে দিওনা যেন।
মায়ে আর যমুনার কোলে দিল না গেঁদারে।যমুনার বুকে ঢেউ উঠে, কষ্টের কান্নার।  
 
- মায়ে কইল, আমি চইলা যামু।তুই ভালো থাকিস।মামীর কথা মতো চলবি।
- ছয় বছরের যমুনা বুকের ঢেউ লুকাতে পারে। মাথা নেড়ে মায়ের কথার উত্তর দেয়। 
- দশটা টাকা হাতে দিয়া বলে, কিছু কিনা খাইস।
- যমুনা মায়ের হাতটা জড়ায়া ধরে। বলে, মাগো তুমি আমার সাথে থাকো।
- মায়ের কোলে গেঁদা, মা কয় কয়দিন পর আইসা থাকমু তোর সাথে।
মায়ে চইলা যায়, যমুনার চোখে কান্না, বুকে কষ্টের ঢেউ।যমুনার বয়স এখন চৌদ্দ। গায়ের রঙ কালো,শরীর যেন পাটখড়ি। নাক চোখ তাও ভালো না। গ্রামের মানুষেরা কয় কে ওরে বিয়া করবো? বাপ নাই মা বিয়া কইরা চইলা গেছে। দেখতেও ভালো না।এমন মাইয়ারে কে বিয়া করবো? যমুনা বিয়া বোঝে না! যমুনা সুন্দর বোঝে না! যমুনা পাখির মতো আকাশে উড়তে চায়। যমুনা অপেক্ষায় থাকে মায়ের।মা আসে একবছর দুই বছর পর পর। কোলে থাকে আরো একটা গেদা বা গেদী।
মনে মনে কথা কয় ও।অনেক কষ্টের কথা, অনেক নালিশ।একা ছেঁড়া মলিন কাঁথা গায়ে দিয়া পার করে শীত।পার করে একটা একটা কইরা বছর।
(শেষ)

এমএসএম / এমএসএম