ঢাকা বুধবার, ৬ আগস্ট, ২০২৫

প্রায়শ্চিত্ত


জেসমিন আক্তার  photo জেসমিন আক্তার
প্রকাশিত: ২-১-২০২২ রাত ৮:৬
কুয়াশা এতো ঘন হয়ে পড়েছে যে, চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নদীর ঘাটেও জমাটবাঁধা অন্ধকার। এ অবস্থাতেই হাতরে হাতরে ঘাটে বাঁধা রশিটা খুলে ফেললো রেহমান, তারপর খুব হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে নৌকা ঠেলে পানিতে নামিয়ে লাফ দিয়ে পাটাতনে উঠে এলো। কুয়াশার পর্দা আলাদা একটা আড়াল তৈরি করেছে চারিদিকে। চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে লগিটা পানিতে ফেলে খুব সাবধানে নৌকাটাকে খালের মাঝখানে নিয়ে এলো সে। নিশব্দে বৈঠা চালাতে লাগলো যেন মাছেও টের না পায়।
গ্রামের পশ্চিম দিকে ধলেশ্বরী নদী। নদীর পানি ছোট্ট এই খালটি দিয়ে ঢুকে পড়েছে আর খালটি গিয়ে মিশেছে জলা মতো একটা জায়গায়। ভয়ে কেউ দিনের বেলাতেও আসে না এদিকটাতে, আর রাতের বেলা তো  প্রশ্নই আসে না। খালের পানিতে এখনো মানুষের খণ্ডিত পচাগলা লাশের দেখা মেলে। দুর্গন্ধে আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে আছে। কীসের যেনো ফিসফাস শব্দ শোনা যায়। কিন্তু রেহমানের এদিকে খেয়াল নেই। তার মাথায় এখন খুন চেপে গেছে, কোনো ডরভয় তাকে স্পর্শ করছে না। অসীম সাহসী রেহমানের নৌকা প্রামাণিক পাড়ার দিকে ভেসে চলেছে। সকালে বাবার সাথে কথোপকথনের দৃশ্য কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারছে না সে। 
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্রই। এখনো এখানে সেখানে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সাথে ছোটখাটো খণ্ডযুদ্ধ চলছে। ইতোমধ্যে নিজের এলাকা হানাদার মুক্ত করে দুদিন হলো বাড়ি ফিরেছে সে এবং গ্রামের অন্য কয়েকজন ছেলে। দেহের ক্ষত কিছুটা শুকালেও মনের দগদগে ঘা এখনো সতেজ। গোপনে রাজাকারদের একটা লিস্ট করছে তারা। ওরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে এদেরকে কোনোভাবেই ক্ষমা করবে না। একজন একজন করে শেষ করবে এদের। আজ সকালে বাবার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। উঠে বাইরে আসে রেহমান। বাবা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে, কপালে তার চিন্তার রেখা-
- বাবা, আমারে ডাকছো ক্যান?
- একটা কতা কইবার চাই কিন্তু কি কই কি করি কিছুই বুজতাছি না।
- কোন ব্যাপারে, বাবা?
- রাফিজার একটা বিয়ার কতা কইতাছে, জাহিদ?
- তা, পোলাডা কোন গ্রামের?
- আরে! অরই চাচতো ভাই, মোস্তফা প্রামাণিক।
- কি কও? হের তো বউ পোলাপান আছে।
- তা থাক! অগো অবস্থা ভাল, রাফিজা সুখেই থাকবো। তাছাড়া, বড় জামাই সাফ কইয়া গেছে ওইহানে মাইয়া না দিলে রাহিমারেও চির জীবনের মতো দিয়া যাইবো।
- তাইলে এই হইলো আসল কতা। 
রাজাকারে বাচ্চা রাজাকার! শালার কাছে বইন বিয়া দিছি দেইখ্যা এহনো বাঁইচ্যা আছে নাইলে কবে কচুকাটা করতাম । অগো মরণকাল আইয়া পড়ছে, বাবা!
- আমি ঠিক করছি এইহানেই রাফিজারে বিয়া দিমু। বড় মেয়াডার সংসার আমি নষ্ট করতে পারমু না।
- এইডা আপনে কী কইলেন, বাবা? একজনের সুখের জইন্যে আরেকজনের জীবন শ্যাষ কইর‍্যা দিবেন?
- দরকার অইলে তাই দিতে অইবো।
এরপর রাগে দুঃখে সেখান থেকে সরে এসেছে রেহমান। কিন্তু মনে মনে একটা কঠিন শপথ নিয়ে নেয় সে তখনই। 
রেহমানের বাবা রইজুদ্দি সরকার ধলেশ্বরীর পশ্চিমে ধুপখালি গ্রামের মাতুব্বর। পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে রেহমান তৃতীয়। বড়মেয়ে রাহিমার বিয়ে দিয়েছেন পুবে হাটখোলা গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার নশু প্রামাণিকের ছেলে জাহিদ প্রামাণিকের সাথে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নশু প্রামাণিকের ভাই নূর মুহাম্মদ প্রামাণিক মুক্তিযুদ্ধকালীন 'রাজাকার আলবদর' বাহিনীতে যোগ দিয়ে দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তখন রেহমান মুক্তিযুদ্ধে চলে যায় কাওকে কিছু না জানিয়ে। এই নূর মুহাম্মদ রাজাকার আর তার ছেলে এবং ভাইয়েরা তখন বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছে রেহমানের পরিবার সহ গ্রামের সব মানুষকে। রইজুদ্দি ও তার পরিবারকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়েছে রেহমান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াতে। তাদের মানসিক অবস্থা তখন চরম আকার ধারণ করেছিলো। সে কথা মায়ের চিঠিতে জানতে পেরেছিলো রেহমান। কী দুঃসহ সময় কেটেছে তাদের! এই বেইমানদের সে কিছুতেই ক্ষমা করবে না।
ষোলই ডিসেম্বরের পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অনেক রাজাকার মারা যাচ্ছে এই ভয়ে নজর আলী প্রামাণিক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে বাঁচার একটা উপায় খু্ঁজছে। একথা এখন দিনের মতো পরিষ্কার তার কাছে। এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। তার নিষ্পাপ বোনটিকে অসূরের হাতে সে তুলে দেবে না কিছুতেই।
এখন শুকনা মৌসুম হলেও খালে যথেষ্ট পানি আছে আর এর গভীরতাও কম নয়। তাই সাবধানেই এগুতে হচ্ছে তাকে। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এ সময় নামাজের জন্য মসজিদে যেতে অনেকেই বের হবে, এর আগেই তাকে কাজটা সারতে হবে। ঘাট লাগোয়া প্রামাণিক পাড়া আর প্রথম বাড়িটাই নশু প্রামানিকের। রেহমান শুনেছে যে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এসেছে শুনে সে নাকি গা ঢাকা দিয়েছে। মোস্তফা বদমাশটা শয়তানের চ্যালা। এর কাছে কোনো অবস্থাতেই তার বোন ভালো থাকতে পারবে না, তাতে আবার সতীনের সংসার! আর সে তো দেশের জন্যই জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলো, দেশের সাথে বেইমানি করতে সে কখনোই পারবে না।
ভাবনায় ডুবে গিয়ে আনমনা হয়ে গিয়েছিলো রেহমান। এরই মধ্যে ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। হঠাৎ সামনে কিছু একটা দেখে থমকে যায় সে। আবছা আলোয় পানিতে কিছু একটা ভাসছে মনে হচ্ছে। সাবধানে এগিয়ে যায় সে। লগি দিয়ে খোঁচা দেয় সে কিন্তু স্থির হয়ে আছে বস্তুটি। মনে হচ্ছে পানিতে উপুর হয়ে ভাসছে কোনো মানুষের প্রাণহীন দেহ। এবার সাহস করে কাছে যায় সে, বৈঠা দিয়ে সোজা করার চেষ্টা করে। তিনবারের বার সফল হয় সে। এবারে কোমরে গোঁজা টর্চটা জ্বালিয়ে মুখে আলো ফেলে সে, আর হঠাৎ 
- জয়বাংলা! বলে অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে। তারপর সন্তর্পণে নৌকা ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে বৈঠা চালাতে থাকে। বুকের ভেতর জমে থাকা ক্রোধের আগুন, ঝরে পড়া শিশিরের জলে আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে থাকে।
অনেক বেলায় রাফিজার ডাকে  ঘুম ভাঙে তার-
- ভাইজান ও ভাইজান, হোনো একটা কতা?
- কী কতা ক? তার আগে হুনি তুই এতো খুশি ক্যান?
- আরে, ওই পাড়ার মোস্তফা প্রামাণিক আছে না! হে নাকি শ্যাষ রাইতে অজু করতে গেছিলো ঘাটে, আর বাড়িত ফিরে নাই।  সকালে তার বাপ নশু, খালের পাড়ে গিয়া দেহে  পোলার লাশ  মইর‍্যা ভাইস্যা উঠছে।
ভাইজান, একটা কতা কি জানো! এহন আমার মনে অইতাছে যে, দ্যাশটা সত্যই আইজ স্বাধীন অইছে।

শাফিন / শাফিন