আমাদের প্রযুক্তি এবং আমাদের সমাজ
হসপিটালিটি বা আন্তরিকতার বন্ধনের দেশ বাংলাদেশ۔একটা সময় ছিল ৮0/ ৯০ দশকের দিকেও ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোয়া তেমন ছিল না তখন আমাদের দেশের সমাজের পরিবার গুলোর মধ্যে সম্পর্কের ধারাগুলো একটু অন্যরকমই ছিল ۔দেখা গেছে। অফিস থেকে বাবা কখন বাসায় আসবে সন্তান সেই অপেক্ষায় থাকতো।বাবারা তার সন্তানদের সাথে বই নিয়ে পড়াতেন,গল্প করতেন বা মা তার সন্তানকে রাজকুমারের গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে পাড়া মহল্লার ছেলেরা এক সাথে হয়ে গল্প করতো বা চোর পুলিশ খেলা খেলতো।পাড়া প্রতিবেশীরা সব এক সাথে হয়ে গল্প করতো।তখনকার সময়ে টিভিতে ডিস্ চ্যানেল না থাকার কারণে সবাই বিটিভি দেখতো।
প্রতি শুক্রবার দুপুর ৩টায় পূর্ণ দৈর্ঘ ছায়া ছবি দেখার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে থাকতো।রাত ৮টার সংবাদের পর আলিফ লায়লা দেখার জন্য ছেলে মেয়েরা আগেই পড়াশোনা শেষ করে রাখতো।সেই সময়ে সুস্থ বিনোদন এর মাদ্ধমেই সময় কাটতো সবার । ছিল না কোনো অসামাজিকতা বা অপরাধের মাত্রাও অনেক ছিল কম। ছোটদের ভিতর বড়দের প্রতি ছিল শ্রদ্ধা আর বড়োদের ছিল ছোটদের প্রতি স্নেহ। কিন্তু কাল ক্রমে সময়ের সাথে সাথে সেই দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ হ্রাসের কারণে ।বর্তমান প্রযুক্তির অবিরাম উন্নতির ফলে মানুষ এখন ডিভাইস প্রযুক্তি গুলোর উপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে যান্ত্রিকতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে ।
ধরুন আমাদের নিত্য নতুন প্রয়োজনীতার মধ্যে স্মার্ট ফোন অনিবার্য একটি বস্তু।কারণ স্মার্ট ফোন ব্যবহারের মাদ্ধমে আমরা সাড়া বিশ্বের সাথে নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারছি۔যার কারণে বিশ্বের ভালো এবং মন্দ দুটাই আমাদের হাতের মুঠোয় কেউ ভালো নিয়ে থাকে আর কেউ বা খারাপ দিকে ধাবিত হয় ।বিশেষ করে এখন একটি শিশু জন্মের পর থেকেই স্মার্ট ফোনে ইউটুবে এ ভিডিও দেখে দেখে বড়ো হয় এদেরকে আমরা টিউব জেনারেশন বলতে পারি । আর একটু বড় হওয়ার পর তাকে নামানো হচ্ছে এ+ নামক শীর্ষ মেধা তালিকায় থাকার সার্টিফিকেট পাওয়ার যুদ্ধে ।তার জন্য স্কুল এর পড়া প্রাইভেট এর পড়া কত পড়া না তাকে পড়ানো হচ্ছে !! কিন্তু এ অর্থে বাস্তবিক জ্ঞান সে কতটুকু লাভ করছে !?
এখন আর সেই ৮০/ ৯০ দশকের মত পরিবারের সম্পর্কের ধারা গুলোও ভিন্নতায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে ।দেখা গেছে একটি পরিবারের মধ্যে বাবা মা ভাই বোন সবাই এক সাথে বসে আছে কিন্তু সবার মনোযোগ তাদের যার যার হাতে থাকা স্মার্ট ফোনের মধ্যে ۔এখন আর বাবার অফিস থেকে আসার জন্য সন্তানরা অপেক্ষা করে না কারণ তারা ভার্চুয়াল জগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকছে ।এখন আর রাজকুমার এর গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো হয় না যেখানে স্মার্ট ফোনে কার্টুন দেখে ঘুমিয়ে যায় শিশুরা । বাবা মারাও এক সাথে গল্প করে না কারণ তারা নিজেরাই ব্যাস্ত থাকে ফেইসবুক,۔হোয়াটস্যাপ, ইনস্টাগ্রামে ঠিক তেমনি তাদের সন্তানরাও ব্যাস্ত থাকে অনলাইন ফেইসবুক চ্যাট এ ।আর এভাবেই পরিবারের সদস্যদের ভিতর একে ওপর থেকে দূরত্বের সৃস্টি হচ্ছে ।একটা বিষয় ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় ইদানিং কিশোর গ্যাং এর প্রভাব বেড়েছে ১৫/২০ বছরের ছেলেরা নানান রকম অপরাধ করে বেড়াচ্ছে ।এর জন্য দায়ী পরিবারের অসচেতনতা এবং সন্তানের বাস্তবিক জ্ঞানের অভাব ।আর মিডিয়ার অপসংস্কৃতির প্রভাব তো রয়েছেই
।নাটক ওয়েব সিরিজ দেখে এখনকার ছেলে মেয়েরা প্রেম ভালোবাসা ছাড়া আর কিবা শিখছে !!কারণ একটি ছেলে বা মেয়ে অনেক রোমান্টিক একটি নাটক দেখার পর তার ভিতর স্কুল/কলেজে বা পাশের বাড়ির কোনো ছেলে বা মেয়ের সাথে প্রেম করার ইচ্ছা জাগতেই পারে, এটা সাইকোলজিকাল দৃষ্টি থেকে স্বাভাবিক ।কিন্তু সেই ছেলে বা মেয়েরা যখন প্রেমে ব্যার্থ হচ্ছে তখন বেছে নিচ্ছে খুন/ধর্ষণ , আত্মহত্যার পথ বা মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে ।তাহলে এর জন্য আমরা মিডিয়ার অপসংস্কৃতিতে আসক্তি এবং সুস্থ বিনোদনের জন্য সচেতনতার অভাবকে দায়ী করতে পারি ।এ সব ব্যাপার হচ্ছে বাবা মার্ অন্তরালে যার ফলে ছেলে/মেয়ে আত্মহত্যা করে মারা গেলে বা মাদকাসক্ত হয়ে গেলে তার বাবা মা জানতে পারে ছেলে/মেয়ের প্রেমের কথা তার আগে নয়।তার মানে সম্পর্কের দূরত্বের কারণেই এসব হচ্ছে। স্বামী স্ত্রীর দূরত্বের প্রভাবও সন্তানকে প্রভাবিত করে এবং সন্তানের ভিতর হতাশা হিন্নমনোতা সৃষ্টি করে ,এটাও সন্তানের অপরাধ প্রবণতার একটা প্রথম সূত্র হতে পারে ।বাবা মা তাদের সময় পার করছেন যে যার ভার্চুয়াল জগতে সন্তান কি করছে তা নিয়ে ভাবার সময় কোথায় ? এর ফলে সম্পর্কের দূরত্ব যেমন বাড়ছে তেমনি দাম্পত্যের কলহ সৃস্টির প্রবাহও বিদ্যমান রয়েছে ।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী আমরাই ।আমরাই চাইলে পারি আমাদের নিজেদের সম্পর্ক গুলো সুন্দর করে ধরে রাখতে ।আমাদের সন্তান ভাইবোন কখন কোথায় কিভাবে সময় পার করে সে বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে ।সন্তান ভাই/বোনের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে হবে যাতে তার মনের কথা অন্যের সাথে শেয়ার না করে আপনার সাথে শেয়ার করে ।সে ছোট হলে তাকে প্রযুক্তির ভালো/মন্দ দিক সম্পর্কে ধারণা দিন।কোনটা করণীয় এবং কোনটা করণীয় না সে সম্পর্কে উৎসাহ দিন।এখনকার মস্ত বড়ো উচ্চ্য শিক্ষিত ছেলেরা/মেয়েরা তাদের বাবা মা কে বৃদ্ধাশ্রমে কেন পাঠায় জানেন ?একমাত্র তাদের জ্ঞানের ও সম্পর্কের দূরত্বের কারণে,যেটা ছোট বেলা থেকে তাদেরকে বাস্তবে শিক্ষা দেওয়া হয়নি শুধু মাত্র বইয়ের পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।আসুন আমরা সবাই পরিবারকে ভালোবাসি,প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং মিডিয়ার অপসংস্কৃতি থেকে নিজিদের বিরত রাখি এবং অপরকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করি।
এমএসএম / এমএসএম