এডিনবরায় পাঁচ দিন

আমার ছোট মেয়ে রুবাবা এম.এস.সি করতে যায় ‘ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরায়’ - ২০১১ তে। ওর অনার্স ছিল ফার্মেসিতে এশিয়া প্যাসেফিক ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৯ এ। এরপর একবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের একটি রিসার্চের কাজ করে। এর ভিতর বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে মাস্টার্সের জন্য। ‘ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরা ’ আমার মেয়ে রুবাবাকে 'ড্রাগ ডিসকভারির'- ওপর মাস্টার্স করার সুযোগ দেয়।
আমার মেয়ে জীবনে প্রথম বিদেশে পড়তে যাবে একা তাই বেশ নার্ভাস ছিল। আমি নিজেও খুব চিন্তিত ছিলাম। যদিও রুবাবা দু'বছর কানাডায় ছিল ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত। কানাডায় রুবাবা 'মিডিল' স্কুলে পড়তো সেখানে বাবা-মার সাথে পরিবারে থাকতো। এবার যাচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ হোস্টেল জীবনে সবকিছু চিন্তা করে আমি ওর সাথে রওনা দিই এডিনবরায়।
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা। এখানকার অধিবাসীরা স্কটিশ নামে পরিচিত। এটি গ্রেট বৃটেনের একটি স্বায়ত্তশাসিত দেশ। ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫৮২ সালে। এখানকার অধিবাসীরা এডিনবার্গকে এডিনবরা বলে । শহরটির দু'টি ভাগ 'ওল্ড সিটি' আর 'নিউ সিটি'। আমাদের গন্তব্য হলো ওল্ড সিটি কারণ এখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা।
নানা ঝক্কি ঝামেলা শেষ করে নির্দিষ্ট দিনে এডিনবরায় এসে পৌঁছি। হিথ্রো বিমানবন্দরে আমরা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হয়ে এডিনবরা এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছাই।
মজার ব্যাপার হলো, ঢাকা থেকে এডিনবরা পর্যন্ত আমাদের ল্যাগেজের বুকিং ছিল তাই হিথ্রো এয়ারপোর্টে আমাদের কোন চেকিং হয়নি,এডিনবরা এয়ারপোর্টেও কোন চেকিং হয়নি ছোটখাটো একটি এয়ারপোর্ট লোকজনের তেমন ভিড় নেই, আমরা ল্যাগেজ নিয়ে একজন সিকিউরিটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের চেকিং কোথায় হবে? সে বললো, তোমরা লাগেজ পেয়েছো? আমরা হ্যাঁ বলতেই, বললো চলে যাও।
ট্যাক্সির জন্য এগোতেই দেখি ছোটখাটো লাইন, আমরা সেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম ট্যাক্সির জন্য। সিরিয়াল অনুযায়ী আমাদের ট্যাক্সি আসতেই আমরা ঠিকানা দেখিয়ে গাড়িতে উঠলাম তখন বেশ রাত হয়ে গেছে আনুমানিক সাড়ে নয়টা। গাড়িতে বসেই শুরু হয়ে গেল আমার টেনশন ঠিক জায়গামতো পৌছাতে পারবো তো? কিন্তু মেয়েকে একবারই বুঝতে দিচ্ছি না। এয়ারপোর্ট ছিল শহর থেকে বেশ দূরে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগে যাই।
ইউনিভার্সিটি থাকার কারণে এই শহরে হোটেল-মোটেল এবং গেস্ট হাউজ রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে।আমরা আগেই একটি গেস্ট হাউস বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম।গেস্ট হাউজটি ক্যাম্পাসের কাছেই ছিল। এই গেস্ট হাউজের মালিক মওরিন এল্ডারফিল্ড নামে একজন বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা। বয়স আনুমানিক ৭৫-৭৬ বছর। নিজ বাড়িতে গেস্ট হাউস তিনি নিজেই পরিচালনা করেন। তিন'তলা বাড়ির (একটু পুরনো ধাঁচের) একটি কক্ষে উনি নিজে থাকেন বাকিটা গেস্ট হাউজ হিসেবে ভাড়া দেন (প্রাতরাশের ব্যাবস্হাসহ)।
মওরিনকে পূর্বেই জানানো হয়েছিলো আমাদের আসবার দিনক্ষণ। গেস্ট হাউজের কাছে যখন পৌঁছি তখন বেশ রাত হয়ে গেছে আনুমানিক রাত এগারোটা। আমরা বেল বাজিয়ে নক করতে থাকি কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেশ কয়েকবার বেল বাজাবার পরেও দরজা যখন খুলছে না আমি তখন ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম!
এদিকে ট্যাক্সি ড্রাইভার ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তারও হয়তো তাড়া আছে, আমি তাকে অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললাম, দেখো এখানে যদি এরা দরজা না খোলে তাহলে আমরা অনেক বিপদে পড়ে যাব, তুমি আমাদের একটা হোটেলে পৌঁছে দিও। তাঁরপর আবারো বেল টিপে শেষ চেষ্টা করলাম একটু পর দেখি খানিকটা আলো দেখা যাচ্ছে একজন বৃদ্ধা মহিলা দরজা খুলে দিলেন। আমরা আমাদের পরিচয় দিলে উনি হেসে আমাদের ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন। এদিকে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিল পরিশোধ করে বিদায় জানালাম। আমার তখন যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো।
গেস্ট হাউজে আসতে অনেক রাত হয়েছে, বাড়ির সামনে বিভিন্ন গাছ- গাছালি দিয়ে ঢাকা। কোনো আলোও ছিল না পুরো বাড়িটাই ছিল অন্ধকারে ঢাকা। হঠাৎ করে কারো ভূত-প্রেতের কথায়ই মনে পড়ে যাবে, তাঁর উপর আমরা দু'জন মহিলা সাথে অপরিচিত ড্রাইভার। এডিনবারায় আমার এখানে কোনো আত্মীয়- পরিজন বা বন্ধু-বান্ধব ছিলনা এমন একটা অবস্থার সম্মুখীন ছিল আমার জীবনের অবিস্মরনীয় ঘটনা।
আমাদের মওরিন দো-তালায় একটি বেশ বড় কক্ষে নিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে রুমের চাবি দিয়ে চলে গেলেন। সুন্দর পরিচ্ছন্ন কক্ষে ধবধবে সাদা বিছানা প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে যেন কোন ঐতিহ্যপূর্ণ জমিদারবাড়ির কামরা। প্রতিটি আসবাব যেন তারই পরিচয় বহন করছে। কক্ষের একপাশে বারান্দা, বারান্দার পাশেই বেশ বড় বাথরুম। বাথরুমে টাওয়াল থেকে নিয়ে সবকিছু সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের বেশ ভালো লাগলো।পরদিন সকালে আমরা বেরোতে যাবার সময় দেখলাম এক তলায় ডাইনিং রুমে প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা। মওরিন আমাদের দেখে গুড মর্নিং বলে কুশল বিনিময় করে তাঁরপর একটি সিমকার্ড এনে দেয়। আগেই রুবাবার এক বান্ধবী লন্ডন থেকে সিম কার্ডটি পোস্ট করে পাঠিয়ে দেয় যাতে ওর এখানে এসে কোনো সমস্যা না হয়।
আমরা কয়েক রকম ফল, জুস, জ্যাম বাটার, টোস্ট, ডিম দিয়ে সকালের নাস্তা ও চা পান করে নওরিনকে বাই বলে বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি নিয়ে প্রথমে এডিনবরা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে চলে যাই। ওখানে নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন থেকে যা যা করণীয় সবকিছু করা হলো সাথে রুবাবা ব্যাংকের কাজটিও সেরে নিলো। এরপর দুপুরের লাঞ্চের জন্য আমরা ক্যাম্পাসের ভেতরেই একটি রেস্টুরেন্টে আসি যার নাম 'মস্ক কিচেন'।
মুসলিমদের নামাজের জন্য বিরাট বড় একটি মসজিদ। মসজিদের এক পাশে রেস্টুরেন্ট। কাশ্মীরি মুসলিম মালিকানাধীনে এই মসজিদ ও রেস্টুরেন্টি চলে। এটা একেবারে ক্যাম্পাসের মাঝামাঝি জায়গাতেই বলা চলে। এখানের খাওয়াটা আমাদের মা- মেয়ের ভীষণ ভালো লাগে। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকরা এখানে প্রতিনিয়ত খেয়ে থাকে। তাছাড়া এই দেশের সাদা চামড়ার মানুষরাও এই ক্যাম্পাসের খাবারের ভীষণ ভক্ত।
ইচ্ছা ছিল ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার কিন্তু এত অল্প সময়ে এই বিশাল ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা সম্ভব নয় তাই রুবাবার অবশিষ্ট কাজগুলো সেরে আমরা গেস্ট হাউসে ফিরে যাই। যে কয়দিন আমরা গেস্ট হাউজে ছিলাম রাতের খাবার শাপলা( যার মালিক একজন সিলেটি) নামে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করে আনিয়ে নিতাম।
এডিনবরা শহরটি চারপাশে সমুদ্র আর পাহাড় দিয়ে ঘেরা, হঠাৎ দেখলে মনে হবে পাহাড়গুলো মিশে গেছে আকাশে, রাস্তাগুলো পাহাড়ি এলাকার রাস্তার মতো ওঠানামা করে আছে। ওল্ড সিটিতে শহরের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটি উঁচু টিলার ওপর দৃষ্টিনন্দন বিশাল বড় একটি রাজপ্রাসাদ বা ক্যাসেল আছে যা দেখবার জন্য বিশ্বের বহু দেশের পর্যটকদের ভিড় থাকে অহরহ।
পরদিন আমরা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস ঘুরে দেখব বলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি। এতো বিশাল ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে হলে কয়েকদিন লেগে যাবে তাই আমরা প্রথমে বিজ্ঞান অনুষদের ক্যাম্পাসে যাই, সেখানে এক এক বিষয়ের ওপর এক এক বিল্ডিং। তারঁ নামও দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব বৈজ্ঞানিকদের নামে যেমন: রুবাবার যে বিল্ডিং-এ ক্লাস হবে তার নাম 'ডারউইন বিল্ডিং' তেমনি ‘ড্যানিয়েল রাদারফোর্ড বিল্ডিং’, ‘আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল’, ‘মাইকেল সোয়ান’ ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বিল্ডিং-এর সামনে খোলা বিশাল জায়গা রয়েছে। যেখানে এইসব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের বিরাট বিরাট স্ট্যাচু বানিয়ে রেখেছে। ক্যাম্পাসের ভেতরে মুসলিম স্টুডেন্টদের জন্য মসজিদ রয়েছে। এছাড়া একটু পরপর ফুলের বাগান রয়েছে নজরকাড়া সৌন্দর্য নিয়ে।
এডিনবরার আবহাওয়ার কোনো ঠিক -ঠিকানা নেই, এই বৃষ্টি এই রোদ, কখনো এলোমেলো বাতাস। হঠাৎ এমন বাতাস হয় যেন হালকা পাতলা মানুষকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। এখানে সবাই সবসময় সঙ্গে একটি ছাতা রাখে বৃষ্টির কারণে। যখন তখন বৃষ্টি হওয়াটাই এদেশের আবহাওয়া। আর্টস ফ্যাকাল্টির বিল্ডিং দেখার আর সুযোগ হয়নি তবে ওল্ড কলেজ নামে সেই বিখ্যাত বিল্ডিং টি দেখার মতো ছিল। ঠিক রাজকীয় একটা ভাব লক্ষ্য করা যায়। সেই যুগের অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা এবং বড় বড় জমিদাররা এখানে আসতো আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে। ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম তারপর আবার ঘুরলাম কখনো হেঁটে কখনো ট্যাক্সি নিয়ে রুবাবার কিছু কেনাকাটা ছিল সেগুলো সারলাম।
পরের দিনের কর্মসূচী ছিল মিউজিয়াম আর ক্যাসেল দেখব কিন্তু বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার কারণে ক্যাসেল দেখা হয়নি। এটা আমার অনেক বড় দুঃখ রয়ে গেল তবে মিউজিয়াম দেখে অসম্ভব চমৎকৃত হয়েছি। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার মিউজিয়াম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। তবে এই মিউজিয়ামটি ছিল একটু অন্য ধরণের বিশেষ কয়েকটা জিনিসের কথা না বললেই নয় যেমন:- গ্রামোফোন কবে প্রথম আবিষ্কার হয় সেটি দেখতে কেমন ছিল সেই রকম একটি গ্রামোফোন তাঁরপর পর্যায়ক্রমে কিভাবে পরিবর্তন হয়ে ষাটের দশকের গ্রামোফোন হলো এভাবে সন-তারিখ দিয়ে ষোলটি গ্রামোফোন পরপর সাজিয়ে রেখেছে। প্রথমে বাইসাইকেল কেমন ছিল প্রথম আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে আজকের এই বাইসাইকেল কিভাবে আসে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মমি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। যদিও আমি বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকার ক্যানসাসের একটি মিউজিয়ামে মমি দেখেছিলাম সবচাইতে বিস্ময়কর ছিল এডিনবরা ইউনিভার্সিটির আবিষ্কার- ‘ডলিশিপ’ দেখে। এটি একটি ভেড়া। মেডিসিনের মাধ্যমে যা সতেজ করে রাখা হয়েছে এই মিউজিয়ামে।
১৯৯৬ সালে ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরার বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে আবিষ্কার করা হয় ক্লোনিং টেকনোলজির মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম তৈরি করা একটি ভেড়া।যার নামকরণ করা হয়েছিলো ‘ডলিশিপ’। ১৯৯৬ সালে সেই খবরটি পত্রিকার প্রথম পাতায় হেডলাইন ছিল। টেলিভিশনের খবরে মানুষের মুখে মুখে তখন এই আবিষ্কারের কথা চলছিল আমি কি তখন কস্মিনকালেও ভেবেছিলাম যে, একদিন সেই ডলিশিপ আমি নিজের চোখেই দেখতে পাব।
আরমাত্র একদিন হাতে আছে অর্থাৎ এডিনবরায় পাঁচ দিনের ভিতরে চারদিন পার হয়ে গেছে সেদিন মিউজিয়াম দেখার পর আমি আর রুবাবা ওর হোস্টেলে যায় সেখানে কিছু ফর্মালিটিস সেরে ওর রুমটা দেখতে যায়। সুন্দর পরিচ্ছন্ন হোস্টেল, নিয়ম-কানুন খুবই কড়া, তিনবার সিকিউরিটি লক পার হয়ে ভিতরে যেতে হলো। পাঁচ তলায় রুবাবার রুমে যাবার জন্য লিফটে উঠে লিফট থেকে নেমে সোজা করিডর দিয়ে যেতে দু'পাশে পরপর ছাত্রীদের রুম।রুবাবার রুম নাম্বার অনুযায়ী দরজা খুলে দেখি ছোট একটি পরিচ্ছন্ন সুন্দর রুম সাথে সংলগ্ন সুন্দর আধুনিক বাথরুম। একটি ডাবল খাট কুইন সাইজের চেয়ে একটু ছোট সেই সাথে লেখাপড়ার জন্য বেশ বড় একটি টেবিল।টেবিলে কম্পিউটারের মনিটর দেওয়া আছে সাথে চেয়ার। একটি বুক সেলফ, একটি আলমিরা, একটি ওয়ার ড্রপ, আর একটি এক্সট্রা চেয়ার দেয়া আছে। রুম দেখে আমার মেয়ে বেশ খুশি হলো তাঁরপর কিচেন দেখতে গেলাম বিরাট বড় রান্নাঘর যাকে বলে এলাহি কারবার! এক এক ফ্লোরে প্রায় ২০'জন ছাত্রীর জন্য একটা বৃহৎ কিচেন অনেকগুলো চুলা, বেশ কয়েক'টা করে অভেন, ফ্রীজ, মাইক্রোওভেন, প্লেট, চামচ, হাড়ি-পাতিল কোন কিছুর যেন কমতি নেই। রুবাবা আগে থেকেই নিজের ব্যবহারের জন্য কিছু রান্না সামগ্রী কিনে রেখেছিলো। ক্লিনিং-এর মহিলা এসে দু'বেলা রান্নাঘর ক্লিন করে যায়। এছাড়া রুম ক্লিনার মহিলাও প্রতিদিন একবার রুম পরিস্কার করে যায় কিচেন দেখে আমাদের মন ভরে যায়।
পরেরদিন রুবাবা হোস্টেলে উঠবে। তারপরের দিন খুব সকালে আমার ফ্লাইট, ভোরে আমাকে এয়ারপোর্টে রওনা দিতে হবে তাই ঠিক করলাম হোস্টেলে রুবাবার সাথে একরাত থাকব। তাঁদের রেসিডেন্ট এডমিনের সাথে কথা বললাম। তিনি বললেন, কোন অসুবিধা নেই শুধু একটা আবেদন করতে হবে হোস্টেল সুপারকে। পরদিন সকালবেলা নাস্তা করে আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে গেস্ট হাউজের মওরিনের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাব।
আমার মনে হলো, এই কয়দিনে উনি যেন আমাদের কত আপন করে নিয়েছেন। একটা করুণ ব্যাথিত মুখে তাঁকিয়ে ছিলেন আমাদের দিকে। যেন, কত আপনজনকে বিদায় দিচ্ছেন! আমি তাঁর হাতটি ধরে বললাম, তোমার এখানে এই-কয়দিন আমারা খুব ভালো ছিলাম।ভবিষ্যতে যদি আমার হাজব্যান্ডসহ আসি, আমি তোমার এখানে উঠবো। উনি শুনে ভীষণ খুশি হলেন। আমি আমার মেয়ের জন্য অনেক চিন্তা নিয়ে যাচ্ছি শুনে আমাকে বললো, কোনো চিন্তা করোনা, তুমি থাকবে না তো কি হয়েছে, আমি ওর আরেকটি মা! আমি ওকে দেখবো, খোঁজখবর রাখবো রুবাবার দিকে তাকিয়ে বললো, কোন সমস্যা হলেই যেন তাঁকে ফোন করে। আবার আমাকে বললো, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমি অবাক হলাম মাত্র চারদিনে একজন বর্ষীয়ান মহিলা কতটা আপন করে নিয়েছে ভিন্ন ধর্ম,ভিন্ন কালচার, ভিন্ন রেইস হওয়া সত্ত্বেও মানুষের অনুভূতিগুলো যেন এক। ঠিক যেন একজন বাংলাদেশের মা। আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ে! উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
গেস্ট হাউজ থেকে বিদায় নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠি রুবাবার হোস্টেলের উদ্দেশ্যে। গত কয়েক দিনের ঘটনা মনে পড়লো কয়দিন বেশ কয়েকজন স্কটিশ মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে মনে হলো, স্কটিশরা মানুষ হিসেবে খুবই ভালো, এরা মানুষের সাথে মিশতে পারে, আপন করে নিতে পারে নিমিষে। স্কটিশ মেয়েরা দেখতে ভারী সুন্দর। এই কয়দিনে একটিও অসুন্দর মেয়ে চোখে পড়েনি আমার। এখানকার ট্যাক্সি ড্রাইভাররাও খুবই ভালো। বেশির ভাগই বয়স্ক ড্রাইভার, ওরা গল্প করতেও বেশ পছন্দ করে।
রুবাবার হোস্টেলে এসে ল্যাগেজ নিয়ে সিকিউরিটি অফিসার থেকে সিকিউরিটি কার্ড আর চাবি নিয়ে চলে যায় রুবাবার নির্দিষ্ট রুমে। সেদিন ভিড় ছিল প্রচুর। বিভিন্ন দেশের ছাত্রীরা এসে উঠেছে হোস্টেলে। রুবাবার রুমে ওর সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলো তাঁরপর আমরা কিচেনে গেলাম ওখানে কে কোন ফ্রিজ ব্যবহার করবে এগুলো বুঝে নিলো রুবাবা। এখানেও বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো: কেউ চাইনিজ, কেউ ইন্ডিয়ান, কেউ কানাডিয়ান সবার সাথে আলাপ করে বেশ ভালো লাগলো। সবাই বেশ সহযোগিতাপূর্ণ কিছুক্ষণ পর আমরা বের হই লাঞ্চ করবো আর রুবাবার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে যাব। কাছাকাছি হেঁটে যাওয়া যায় এরকম একটি গ্রোসারির দোকান থেকে বেশ কিছু জিনিস কিনে হোস্টেলে ফিরে এলাম। রাতের খাবার শাপলা থেকে আনিয়ে নিলাম। চোখের পলকে পাঁচটি দিন কেটে গেলো! অনেক কিছু দেখব বলে আশা করেছিলাম, অতঃপর মনকে সান্ত্বনা দিলাম নাইবা হলো দেখা যা দেখেছি তাই বা কম কি! তাও আবার পাঁচ দিনের ভিতর। তাছাড়া এদেশে আমার আত্মীয় তো দূরে থাক কোনো পরিচিত কেউ নেই মেয়েটাকে একা রেখে যাব ভাবতেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে এলো!
নিজের মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিলাম এখানকার মানুষ কত ভালো প্রত্যেকেই আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, বিশেষ করে মওরিন আর শাপলা রেস্টুরেন্টের মালিক। রাতে ঘন্টা দুয়েক একটু ঘুমাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম এলো না। ভোর চারটায় ট্যাক্সি ডাকি এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য। ঠিক সময়ে ট্যাক্সি চলে আসে এবার মা-মেয়ের বিদায়ের পালা। ল্যাগেজ নিয়ে আমি আর রুবাবা নিচে নেমে আসি, নিচে সিকিউরিটি অফিসার ও আরও একজন ভদ্রলোককে দেখলাম দু'জনেই এগিয়ে এলেন গাড়িতে ল্যাগেজ তোলার সময়। উনারা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করলেন অনেকক্ষণ ধরে বুকের ভিতর চেপে রাখা কান্নাটা এবার বেরিয়ে এলো।
আমি আমার মেয়েকে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। মেয়েটাও কাঁদছে এদিকে সিকিউরিটি অফিসার আমাদের কান্না দেখে হাসছে আর বলছে, এই দেখো মা মেয়ের কান্না শুরু হয়ে গেল। তাঁরপর আবার সান্ত্বনা দিলেন চিন্তা না করার জন্য। এরপর গুডবাই বলে গাড়িতে উঠি।
গুডবাই এডিনবরা। বুকের ধনকে রেখে একা চলে এলাম। এই শহরে আর কোনোদিন আসা হবে কিনা জানিনা, তবে এই পাঁচ দিনের অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে। আমরা সারা জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে এগোতে থাকি। আবার অনেক কিছু ভুলেও যাই স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো বড় রহস্যময়।
এমএসএম / এমএসএম

বৃষ্টি ভালোবাসো!

নিষ্ফল ডায়েট

মুখোশ

অনিকেত জীবনের গল্প

আজ ২২শে শ্রাবণ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস

আসছে আরফান হোসাইন রাফির প্রথম কাব্যগ্রন্থ: ‘সুদিন ফিরে আসছে’

বহুরূপী

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে মানিক লাল ঘোষের একগুচ্ছ কবিতা

একুশ ও আমরা

মানিক লাল ঘোষের একগুচ্ছ একুশের ছড়া

অপূর্ব চৌধুরী'র নতুন বই

সাহায্যের হাত বাড়াই
