ঢাকা রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মৃত্যু উপত্যকা ও একগুচ্ছ লাল-গোলাপ


নন্দিনী আরজু রুবী photo নন্দিনী আরজু রুবী
প্রকাশিত: ১১-৭-২০২১ দুপুর ৩:৩৫

তখন মধ্যরাত, চারিদিকে সুনশান নীরবতা। শুধু মাটি কাটার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটা টিমটিমে বাতি জ্বলছে। সেই স্বল্প আলোয় ছয়জন শক্তসামর্থ যুবক কোদাল- গাইতি চালিয়ে নীরবে কবর খুঁড়ে চলেছে। সন্ধ্যে থেকে একটানা কাজ, সব সারতে হবে ভোরের আগে। এখন রাত দুইটা বিশ মিনিট। 
রাতজাগা পাখিরাও নীরব। থমকে আছে বাতাস, যেন অশনি পাতের অপেক্ষায় প্রকৃতি নিথর। চারটে কবর খনন করেছে ওরা, মৃতদের দাফন কাজ সকালের আগেই সমাপ্ত হবে। কায়েস, মনি, রনি, মোহাম্মদ, মিজান সাথে তাদের বন্ধু গৌতম। ওরা স্বেচ্ছায় সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।একনাগাড় পরিশ্রমে শরীরের ঘামও নিঃশেষ, ধুলো আর মাটিতে মাখামাখি ক্লান্ত শরীর। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। নির্ঘুম লাল চোখ, শ্রান্তিতে নুয়ে পড়তে চাইছে দেহ তবুও ভ্রুক্ষেপহীন মাটি খুঁড়ে চলেছে...

হাতের কাজ শেষ হতেই, দূরে গাড়ির হেড লাইট দেখা গেলো। এদিকেই এগিয়ে আসছে। জীবনবৃন্ত থেকে খসে পড়া মৃত্যু চিরন্তন সত্য, জাতি-ধর্ম-বর্ণ কোন ভেদাভেদ নাই। সবাই মাটির সন্তান। মাটির গহ্বরে শেষ ঠিকানা, সেখানেই বিলীন। গাড়ি থেকে বিশেষ পোশাক পরা কিছু মানুষ নেমে এলো। লম্বা ব্যাগে ভরা শবদেহ ঘাসের উপর শুইয়ে রাখলো। ইমাম সাহেব ও উপস্থিত ক'জনে জানাজা শেষ করে কবরে শুইয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিলেন। দাফন কাজ শেষ। হাত তুলে মৃতদের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করলেন, গাড়ি ফিরে গেলো। জীবন অধ্যায়ের অনাড়ম্বর পরিসমাপ্তি। যন্ত্রণার অবসান, স্রষ্টার সমিপে নীরব সমর্পণ।  ওরা ছয়জন গোরস্থানের পাশে মসজিদের বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। ইমাম সাহেব কোরআন তেলওয়াত করছেন। একজন সংবাদবাহক এসে ইমামের সাহেবের হাতে নাম ঠিকানা দিয়ে চলে গেলেন। 


ইমাম আস্তে ডাকলেন, ‘মোহাম্মদ ওঠো...’মোহাম্মদ চোখ খুলে জানতে চাইলো, ‘কী হয়েছে?’‘আর একটি কবর খুঁড়তে হবে, একজন মারা গেছেন।’ ইমাম সাহেবের শান্ত স্বর।শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে এই কবরস্থান, এদিকটা নির্জন, কেবল রাতে শহরের উঁচু অট্টালিকার আলো চোখে পড়ে। 

রেবেকা জেগে আছেন, অস্থিরভাবে ঘর আর বারান্দা পাঁয়চারি করছেন, ঘুমাতে পারছেন না। তার স্বামী জামাল হোসেন অসুস্থ হাসপাতালে ভর্তি। ভীষণ জ্বর ডায়রিয়া আর শ্বাস কষ্ট হচ্ছিলো। রেবেকা তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন করেছিলেন। হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে গেছে। আজ কয়েকদিন হয়ে গেলো, তিনি স্বামীর সাথে দেখা করতে পারেননি। কাছে যেতে দেওয়া হয়নি তাকে। আশঙ্কায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। চমকে উঠছেন, যখন রাতের নিস্তব্ধতা চিরে রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন শোনা যাচ্ছে। 
জামাল হোসেন বিশেষ কেবিনে শুয়ে আছেন। ভীষণ শ্বাসকষ্ট ভেন্টিলেশনে আছেন, তবুও বুকে প্রচন্ড চাপ অক্সিজেন টানতে ফুসফুস যেন ফেটে যাচ্ছে। যুঝে যাচ্ছেন শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ করে। আইসিইউ এর কাঁচের দরজার এপাশে ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীরা অসহায়। জীবনের কী কঠিন বাস্তবতা, শিয়রে দাঁড়িয়ে মৃত্যু। 

ভোর হতে এখনো অনেকটা সময় বাকি। রেবেকা সুলতানার খুব শীত করছে। জ্বর এসেছে, হালকা কাশি, গলা ব্যথা করছে। কম্বল টেনে নিলেন গায়ে, ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগছে নিজেকে। চোখ বুজে স্মৃতির পাতা উলটে পুরনো দিনের অনেক কথা ভাবতে লাগলেন তিনি। কাল তাদের ত্রিশতম বিবাহ বার্ষিকী। দু'জনে এই দিনটি ঘিরে ছোট ছোট পরিকল্পনা সাজিয়ে ছিলেন। প্রতিবছর এই বিশেষ দিনে স্ত্রীকে লাল গোলাপ উপহার দেন জামাল হোসেন। রেবেকার মনেই থাকে না এই তারিখটা। প্রতি বছর ভুলে যান। আজও মনে নাই। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় সারারাত তিনি ছটফট করেছেন। অবচেতন মনে কিসের যেন অপেক্ষা, ভিতর- বাহির শূন্য অনুভব, ডুবে আছেন গভীর ভাবনার অতলে ...
  সূর্য উঠেছে, পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। জানালার ফাঁক দিয়ে একফালি আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। অবরুদ্ধ শহর যান্ত্রিক আওয়াজ নাই, কেমন নীরব! ঝিমিয়ে আছে। 


 হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠলেন তিনি 
এতো সকালে কে এলো!
দরজা খুলে বিস্মিত...  তাজা লাল-গোলাপের তোড়া হাতে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে!!
জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি রেবেকা সুলতানা?’
হ্যাঁ... 


এটা জামাল সাহেব অর্ডার করেছিলেন, আজকের তারিখে বাসায় পৌঁছে দিতে। 
একটা সাদা খাম আর সোনালি কাগজে মোড়া প্যাকেট দিয়ে ছেলেটি চলে গেলো। গোলাপগুলো দেখেই চকিতে তার আজকের বিশেষ দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো। চিরকুটে কী লেখা পড়ার জন্য তিনি অধীর হয়ে উঠলেন। তাড়াহুড়ো করে ফুলগুলো টেবিলে রাখতে গিয়ে অসাবধানে আঙ্গুলে কাঁটা ফুটে একফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এলো, সাদা খামে লাল দাগ। চিরকুটটি খুলে পড়তে যাবেন! ঠিক তখুনি মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো।
রেবেকার বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো.....

এমএসএম / এমএসএম