জাতীয় স্বার্থ রক্ষা জরুরি
প্রতি নির্বাচনের আগে পরে বাংলাদেশে আলোচনায় আসে বিদেশি কূটনীতিকদের বিশেষ কর্মতৎপরতা। সাম্প্রতিক সময়ে এসব বিষয়ে কথা বলে আলোচনায় এসেছেন বেশ কয়েকজন কূটনীতিক। এ ছাড়াও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুদ্ধের বিপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান, র্যাব ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, বাংলাদেশের বড় কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে চীন, রাশিয়া ও জাপানের বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে কোন অবস্থানে বাংলাদেশ? এসব বিষয়ে কথা বলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো: আব্দুর রশীদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক সকালের সময় এর যুগ্ম সম্পাদক- ফয়েজ রেজা।
সকালের সময়: কিছুদিন আগে র্যাবসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা। বাংলাদেশ চেষ্টা করছে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য। আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞা আগামী নির্বাচনে কোনো প্রভাব রাখবে মনে করেন?
মো: আব্দুর রশীদ : বাংলাদেশের নির্বাচন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়। নির্বাচনের আগে বিশ্বের অনেক দেশ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। প্রভাব বিস্তার করার জন্য তাদের হাতে ‘নিষেধাজ্ঞা’ অস্ত্রটি রয়েছে। আমাদের দেশে ক্ষমতার পালাবদলের সময় তারা তাদের দেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার কাজটি জরুরি ভেবে এই ‘নিষেধাজ্ঞা’ অস্ত্রটি ব্যবহার করে। দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিকভাবে নিষেধাজ্ঞার বিষয়গুলো ব্যবহারের একটি সুযোগ আছে। র্যাবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যৌক্তিক ব্যাখ্যা চাওয়া দরকার ছিল। এখন যে ব্যাখ্যার আদান-প্রদান শুরু হয়েছে, সেটি আগে শুরু হওয়া দরকার ছিল। তবে আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, সেটি দেখা যাচ্ছে না। দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক আমরা শুরু থেকেই দেখে আসছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এক পক্ষে জনগণ এবং সরকার বিপরীত পক্ষে অবস্থান নেওয়া, এটি আমাদের ভূরাজনৈতিক কারণেই হয়ে থাকে। এখন ভূ-রাজনৈতিক কারনে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রভাবিত হতে পারে। এই প্রভাবকে বিবেচনায় রেখেই বাংলাদেশকে তার নতুন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবাই সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এর আগের নির্বাচনে দৃশ্যমান যে অভিযোগগুলো এসেছিল, সেগুলো খন্ডন করা হয়নি। ফলে এসব নিয়ে প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে ঘনিভূত হয়েছে।
সকালের সময়: কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সীমান্ত উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেছিল মিয়ানমার। এ জন্য তারা দুঃখ প্রকাশও করলো। বাংলাদেশের সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করার পেছনে কি কারণ ছিল মনে হয়? রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করছে তারা?
মো: আব্দুর রশীদ : মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সমস্যা এক নয়। রোহিঙ্গা সমস্যাটি মিয়নমারের তৈরি করা সমস্যা এবং এর সমাধান তাদেরকেই করতে হবে। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতিগোষ্ঠির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, তার প্রভাব দেখা গেছে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। এতে বাংলাদেশের সীমান্তে আন্তার্জাতিক আইনের লঙ্গন করেছে মিয়ানমার। তাই বাংলাদেশে এটি নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ কেন সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখায় নি?
সংঘাতের উৎস বা উৎপত্তির ক্ষেত্রে আপনাকে খুব সতর্ক হতে হবে। সংঘাতটি আগামীতে আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে? তা ভাবতে হবে। আপনার শক্তি আছে, তাই আপনি শক্তি প্রদর্শন করলেন। আগামীতে সে সংঘাত আপনাকে ভালো জায়গায় নাও নিয়ে যেতে পারে। শানিÍপূর্ণ উদ্যেগে যদি সমাধানের পথ খোলা থাকে, তবে সে পথেই হাটা উচিৎ। সেটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তখন সংঘাতের রাস্তায় যাওয়া যায়।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ক্রমান্বয়ে তাদের ভূখন্ডের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। সেক্ষেত্রে জাতি গোষ্ঠির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে সমাধান খোঁজা উচিত নয়। জাতীয় সংহতি তৈরির করার জন্য সব জাতি গোষ্ঠির মধ্যে রাজিৈতকভাবে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার শক্তির প্রভাবে সহজ সমাধানের চেষ্টা করেনি। এখন হয়তো তারা অনুভব করছে, সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এর সমাধান হবে না।
সকালের সময়: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলো কিভাবে অবদান রাখতে পারে?
মো: আব্দুর রশীদ : বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক উন্নয়ণ এর একটি মূল জায়গা হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু মিয়ানমার সরকারের একক সমস্যা নয়। আঞ্চলিক, ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার একটি ফল হচ্ছে এই রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা। সেক্ষেত্রে যেসব দেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে, তারা তা থেকে সরে আসছে কি না, তা দেখতে হবে। তাদেরকে আমরা পর্দার অন্তরালে দেখছি। তাদেরকে সামনে এনে যৌক্তিক কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। আমি দারুণভাবে বিশ্বাস করি, যেভাবে পরিস্থিতি গড়াচ্ছে, তাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের সময় এগিয়ে আসছে।
সকালের সময়: চীন কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
মো: আব্দুর রশীদ : যখন মিয়ানমারের উপর কেউ চাপ প্রয়োগ করে, তখন সবাই মনে করে চীন বিরোধী একটি রাজনৈতিক ব্লগ তৈরি করার একটি প্রচেষ্টা চলছে। মিয়ানমার এমনিতেও চীনের সাথে সীমানা সংলগ্ন। মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করা হলে তারা আরও চীন ঘেষা হয়ে যাবে। সেজন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে না বলে যুক্তি দাঁড় করায় চীন। তবে আমরা এই যুক্তির সাথে একমত নই। সমস্যা জিইয়ে রেখে যদি কোন দেশ তার সুবিধা নিতে চায়, আপনি যত সেই দেশের পেছনে ঘুরেন, সে আপনার সমস্যার সমাধান করবে না।
সকালের সময়: রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আগেও ভালো ছিল। সাম্প্রতিক যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানকে কিভাবে মূল্যায়ণ করেন?
মো: আব্দুর রশীদ : বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছে। বাংলাদেশের মূল্যবোধের সাথে রাশিয়া ইউক্রেন এর যুদ্ধের মূল্যবোধ মেলে না। ইউক্রেনের উপর রাশিয়া যে আক্রমণ করেছে, মানবিক দিক থেকে বাংলাদেশ ইউক্রেনের পক্ষে রয়েছে। এতে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হয়নি। রাশিয়ার পেছনে বিশ্বের অন্য কোন দেশকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এই যুদ্ধের পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এ যুদ্ধের সূচনা করেছে পুতিন। বিশ্ববাসী ভুগছে যুদ্ধের ফলে। বাংলাদেশ তার নিজস্ব মূল্যবোধের আলোকে অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বকে বাদ দিয়ে রাশিয়ার পেছনে দাঁড়ানোর জন্য যুক্তিপূর্ণ কোনো কারণ দেখা যায় না। বর্তমানে রাশিয়া রাজনৈতিকভাবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পুরো ইউরোপে একটি ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা কোনো পক্ষকেই দেখছি না, এই যুদ্ধ থামানোর উদ্যোগ নিতে।
অল্প দিনের মধ্যে বিজয় অর্জন করে যুদ্ধ বন্ধ হবে, সে অবস্থায় যখন নেই, তখন দরকার ছিল আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ থামানো। সে উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না। ব্যক্তিগত অভিলাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে পুতিনকে। জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে বিশ্ব নেতাদের। পৃথিবীর যে অস্থিরতা আমরা এখন দেখছি, এই যুদ্ধ বন্ধ হলে তা থেমে যাবে। পরিবেশ একটি ভালো অবস্থানে আসবে। যুক্তিপূর্ণ জায়গা থেকে বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশ তার নিজের অবস্থানে থাকতে পারেনি। সে তার নিজস্ব মূল্যবোধকে ধরেই অবস্থান নিয়েছে।
সকালের সময় : বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশি দেশ হিসেবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান কূটনৈতিক সম্পর্কটি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
মো: আব্দুর রশীদ : প্রতিটি রাষ্ট্র তার স্বার্থ সুরক্ষা করে। সীমানাবর্তী রাষ্ট্রগুলোর বেশি শঙ্কায় থাকে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে বিশ্বে দুটো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো নিরাপত্তা, অন্যটি বাণিজ্য। নিরাপত্তা ও বাণিজ্য দিয়ে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কটি ধরতে পারবেন। বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাণিজ্য সম্পর্কটি উচ্চ পর্যায়ে আছে। অন্যদেশগুলোর সাথে বাণিজ্যের সম্পর্ক আছে বাংলাদেশের। নিরাপত্তার বিষয়টি সন্নিবেশিত নেই। আমাদের দেখতে হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি। এই স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে যে দেশ যত বেশি কৌশল অবলম্বন করবে, সে দেশ তত সুফল পাবে।
সুজন / সুজন