ঢাকা বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

সমাবর্তন : আনোয়ার শাহজাহান


সাহিত্য ডেস্ক photo সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩-১-২০২৩ দুপুর ২:২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠান চলছে। বিদেশ থেকে অতিথি হয়ে এসেছেন অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. জঁ তিরোল। আছেন রাষ্ট্রপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শেষে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন ক্লাসের স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা সর্বোচ্চ রেজাল্ট করেছেন, শুরু হয়েছে তাঁদের গলায় গোল্ড মেডেল পরিয়ে দেয়ার পর্ব।

মাইকে একের পর এক ঘোষণা আসছে বিভিন্ন অনুষদের যাঁরা গোল্ড মেডেল বিজয়ী হয়েছেন তাঁদের নাম। তাঁরা একে একে মঞ্চে আসছেন আর গোল্ড মেডেল গ্রহণের পর সংক্ষেপে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করে চলে যাচ্ছেন। এদিকে মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠছে পুরো সমাবেশস্থল। মেডেল দেয়া প্রায় শেষের দিকে। মাইকে ঘোষণা এল, “আর মাত্র একজন বাকি আছেন। তিনি গোল্ড মেডেল গ্রহণের পরপরই আজকের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ভাষণ দেবেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তার আগে আমি মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি পারমাণবিক প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াজ চাকলাদারকে। তিনি তাঁর অনুষদে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছেন।”

ঘোষণার পরপরই তুমুল করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল চারদিক। রিয়াজ চাকলাদার মঞ্চে এলেন। স্মিত হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন মঞ্চের ঠিক মাঝ বরাবর। মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিদের মধ্যে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বিদেশি একজন অতিথি গোল্ড মেডেল প্রদানের জন্য প্রস্তুত। মাইকে আবারও মেডেল নেয়ার জন্য ঘোষণা আসার পর রিয়াজ চাকলাদার এগিয়ে গেলেন তাঁর সামনে। কিছুটা মাথা নোয়ালেন। গোল্ড মেডেলটি গলায় গ্রহণের পরপরই তিনি মঞ্চে সবার সাথে করমর্দন করলেন।

এর পরপরই মাইকে ঘোষণা এল, “এবারের সমাবর্তনের সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্ট যিনি করেছেন, তাঁর কাছ শুনব এই ভালো রেজাল্ট করার পেছনের ইতিহাস। শুনব তাঁর পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতির কথা - বলেই রিয়াজকে মাইক্রোফোনের সামনে আসতে ইশারা করলেন ঘোষক।

রিয়াজ চাকলাদার মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখেমুখে এই মুহূর্তে উজ্জ্বল আলোর দ্যুতি। তবে কিছুটা ভাবগম্ভীর। তাঁর পুরো শরীর সমাবর্তন গাউনে আবৃত। তার পরও পোশাক যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে তেমন জৌলুশ নেই। খুবই সাধারণ গোছের। একজন ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তাঁর সাফল্যের কথা শোনার আশায় সমাবেশস্থলে তখন পিনপতন নীরবতা। সবার দৃষ্টি মাইক্রোফোন হাতে রিয়াজ চাকলাদারের দিকে।

সবাইকে সালাম দিয়েই রিয়াজ বললেন-

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে আজ আমরা যারা শিক্ষাজীবনের সর্বশেষ ডিগ্রিটা অর্জন করলাম, তারা সবাই দেশমাতৃকার কাজে আত্মনিয়োগ করব। আমার আজকের এই ভালো রেজাল্ট এক দিনের চেষ্টায় সম্ভব হয়নি। বলতে পারেন, এটা আমার সারা জীবন ধরে করা চেষ্টার ফল। এ জন্য আমাকে দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি যখন এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই, তখন ঢাকা শহরে আমি নতুন। কিছুই চিনি না, কাউকেই চিনি না। অনেক চেষ্টার পরও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সুযোগ পাইনি।

একসময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরের একটি মেসে থাকার ব্যবস্থা হলো। বাড়ি থেকে প্রতি মাসে সামান্য পরিমাণ টাকা আসত। তাই টিউশনি খুঁজতে শুরু করলাম। সকালে ক্যাম্পাসে আসতাম, সমস্ত ক্লাস শেষে মেসে ফিরতাম বিকেলে। দুপুরে কিছু খাওয়ার মতো পয়সাকড়ি কাছে থাকত না। প্রথম দিকে প্রায় এক বছর দুপুরে শুধু পানি খেয়ে কাটিয়েছি। কোনো কোনো দিন পাঁচ টাকার চিনাবাদাম কিনে খেয়েছি। একটি মাত্র শার্ট-প্যান্টে প্রথম বছর পার করেছি। জীবনে প্রথম চামড়ার স্যান্ডেল কিনেছি অনার্স সেকেন্ড সেমিস্টারে। বছরখানেকের মাথায় যখন একটি টিউশনি পেয়ে গেলাম, তখন বাড়ি থেকে আসা টাকা আর টিউশনি দিয়ে মোটামুটি চলতে শুরু করলাম।

আপনারা শুনে অবাক হবেন যে এই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নকালে যত বই পড়েছি, তার একটিও কেনা সম্ভব হয়নি। সবই বন্ধুদের কাছ থেকে হাওলাত করে পড়েছি। তবে আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ আমাকে বই হাওলাত দিতে কার্পণ্য করেননি। আজ তাঁদের সবার প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আমি আজীবন আপনাদের এই সহযোগিতার কথা স্মরণে রাখব।

গ্রাম থেকে আমার পড়ালেখার সমস্ত খরচ পাঠাবে, এমন অ্যাবিলিটি আমার পরিবারের ছিল না। বিভিন্ন কারণে টাকার অভাবে অনেক কাজ করতে পারিনি। তার পরও একসময় বেশ কয়েকটি টিউশনি পেয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু একটার বেশি কখনোই লোভ করিনি। কেননা যখনই আমি টাকা ইনকামের দিকে ঝুঁকে পড়ব, তখন আমার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে। আমি বিচ্যুত হব আমার লক্ষ্য থেকে। আমার রুমমেটদের দেখেছি, তাদের প্রতি মাসে যত টাকার সিগারেট লাগত, তত টাকায় আমি দুই মাস চলতে পারতাম এই ঢাকা শহরে।

উচ্চশব্দের এই নগরীতে সমস্ত কোলাহল যখন থেমে যেত, তখনই পড়তে বসতাম। মেসে আলো জ্বালিয়ে রাত জেগে পড়লে অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত। কেউ কেউ বিরক্ত হতো। তাই গভীর রাতে রান্নাঘরে গিয়ে পড়তাম। আর আপনারা সবাই জানেন যে ভালো রেজাল্টের জন্য খুব বেশি একটা পড়তে হয় না। লক্ষ্য অটুট রেখে নিয়ম করে এগোলে সাফল্য সহজেই দুয়ারে এসে কড়া নাড়ে। আর সব মানুষের সাফল্যের পেছনে থাকেন একজন অনুপ্রেরণাকারী। আমার জীবনেও তেমন একজন আছেন। যাঁর জন্য আজ আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলতে পারছি। যাঁর জন্য আমি সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছি।

আমি যেমন পড়ালেখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি, তেমনি তিনিও অনেক পরিশ্রম করেছেন আমার সফলতাকে ত্বরান্তিত করতে। বরং তিনি আমার চেয়ে বেশিই শ্রম দিয়েছেন। তাঁর অবদান আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি। আমার ভালো রেজাল্ট, আমার এই অবস্থানে পৌঁছানোর পেছনে তিনিই আসল কারিগর। আমি মনে করি, তিনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক; আমার জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। তাঁর আদর্শের আলোয় আমি উদ্ভাসিত। আর আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার ভেতরে থাকা এই গর্ব আর আত্ম অহংকার আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে উজ্জীবিত করে সার্বক্ষণিক। আজকের এই সমাবর্তনে আপনাদের অনুমতি পেলে আমি সেই মহান ব্যক্তিটিকে এখনই এই মঞ্চে আনতে চাই এবং আমার এই গোল্ড মেডেলসহ সমাবর্তনীয় পোশাকটি তাঁকে পরিয়ে দিতে চাই।

সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র সমাবেশস্থল হইহই শব্দে কেঁপে উঠল। সবারই একই কথা, ‘আমরা তাঁকে দেখতে চাই – আমরা তাঁকে দেখতে চাই’। রিয়াজ চাকলাদার ঝটিকাবেগে মঞ্চের একপাশের এ্রক্সিট গেটে গেলেন এবং অশীতিপর একজন বৃদ্ধকে সাথে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। এতক্ষণ সবাই ভাবছিলেন, রিয়াজ চাকলাদারের অনুপ্রেরণাদানকারী হয়তো হবেন এই শহরের কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি, বাংলাদেশের প্রথিতযশা কোনো শিক্ষক কিংবা স্বনামধন্য একজন ব্যক্তি, যাঁকে এক নামে সবাই চেনে। অথচ যাঁকে নিয়ে তিনি মঞ্চে উঠেছেন তিনি শরীরের ভারে ন্যুব্জ একজন অতিদরিদ্র মানুষ।

মাথার চুল এবং মুখের দাড়ি ধবধবে সাদা। জায়গায় জায়গায় শরীরের চামড়া ঝুলে গেছে, ভাঁজ পড়েছে পরতে পরতে। পরনে পলিয়েস্টার একটি লুঙ্গি আর সাদা রঙের অতি সাধারণ একটি ফতুয়া। পায়ে প্লাস্টিকের একজোড়া শক্ত স্যান্ডেল, যার সামনের দিকটায় কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। দীর্ঘদিন পরার ফলে লুঙ্গিটার ভাঁজে ভাঁজে কোঁকড়া হয়ে গেছে। গরমে ও ঘামে চিতা পড়তে পড়তে ফতুয়া তার আসল রং হারিয়েছে অনেক আগেই।

সমাবেশের সবাই কেমন যেন নিশ্চুপ। রিয়াজ চাকলাদার তাঁর শরীর থেকে গাউনটি খুলে পরিয়ে দিলেন ওই বৃদ্ধের গায়ে। মাথা থেকে বিশেষ হ্যাটটি খুলে পরালেন তাঁর মাথায়। এবার গোল্ড মেডেলটিও বৃদ্ধের গলায় পরিয়ে দিলেন। এসব কিছুতে বৃদ্ধ লোকটি কেমন যেন ইতস্তত করছিলেন এবং একটু কাঁপছিলেনও।

রিয়াজ চাকলাদার এবার ওই বৃদ্ধের কয়েক হাত সামনে দাঁড়ালেন এবং তাঁকে স্যালুট করলেন। ওই সময় সমাবেশের সমস্ত শিক্ষার্থীও উঠে দাঁড়ালেন। অজস্র করতালিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত। রিয়াজ এবার মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়েই সবার উদ্দেশে বললেন-

এই মুহূর্তে যাঁকে আমি স্যালুট করলাম, তিনি আমার বাবা। তিনি বাংলাদেশের গর্বিত একজন মুক্তিযোদ্ধা। উনার মতো বীরসন্তানদের জন্যই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমরা স্বাধীন জাতি। আমরা গর্বিত বাঙালি জাতি। ইনিই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন আদর্শ মানুষ হওয়ার। তিনি একজন মাঝি। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুন্দিশাইলে কুশিয়ারা নদীতীরে তিনি ডিঙি নৌকায় মানুষ পারাপার করেছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। লগি-বৈঠা ঠেলে তিনি যা আয় করেছেন, তার প্রায় সবই খরচ করেছেন আমাকে মানুষ করার জন্য। আপনাদের অনুমতি পেলে আমরা আজ এই মহান বীর সন্তানের কাছ থেকে শুনতে চাই তাঁর আজকের দিনের অনুভূতির কথা।

এ সময় সমস্বরে সবাই ‘ইয়েস ইয়েস’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। রিয়াজ চাকলাদার মাইক্রোফোনটা বাবার হাতে দিলেন কিছু বলার জন্য। তাঁর বাবা হিরু মিয়া কম্পিত হাতে মাউক্রোফোনটা নিলেন। কোনো দিন স্বপ্নেও কল্পনা করেননি এমন একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি উঠতে পারবেন, তাঁকে একজন বীরসন্তান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। দেশ স্বাধীনের পঞ্চাশ বছরে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি যতটা সম্মান ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন, আজ পেয়েছেন তার চেয়ে অধিক। তিনি এই মুহূর্তে বাকরুদ্ধ। গর্বে তাঁর বুকটা ভরে গেছে। নিজেকে আজ সত্যিকারের একজন বীরযোদ্ধা মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে তিনি কিছুটা আবেগাপ্লুতও। ডান হাতে ধরা মাইক্রোফোনটি মুখের কাছে নিয়ে কোনো অনুভূতিই প্রকাশ করতে পারলেন না। কেবল হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। একসময় বাবাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন রিয়াজ চাকলাদার।

হিরু মিয়ার জীবনে এবারই প্রথম ঢাকায় আসা। যদিও ছোটকাল থেকেই তাঁর শখ ছিল ঘুরে ঘুরে দেখবেন রাজধানী শহর। চিড়িয়াখানায় গিয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর হরিণ দেখবেন। এক টাকার নোটের ওপর শিংওয়ালা হরিণ দেখে কৈশোরেই তাঁর শখ জাগে প্রাণীটিকে সরাসরি দেখার। হরিণ ছাপানো এক টাকার একটি নোট তিনি যত্ন করে রেখেও দিয়েছেন পুরাতন এক পুথি গ্রন্থের মধ্যে। মাঝেমধ্যেই সেটি বের করে দেখেন। কিন্তু সাধ থাকলেও তাঁর সাধ্য যে নেই!

সাত ছেলে-মেয়েকে নিয়ে হিরু মিয়ার টানাটানির সংসার। রিয়াজ সবার বড়। রিয়াজের মা সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারেননি কখনো। সন্তানদের তিনবেলা ভালো খাবার দিতে না পারলেও তাদের পড়াশোনার বিষয়ে হিরু মিয়ার যথেষ্ট মনোযোগ আর কড়াকড়ি। ছোটখাটো অজুহাতে ছেলে-মেয়েদের স্কুল কামাই দেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি মাঝেমধ্যেই স্কুলে গিয়ে হেড মাস্টারের কাছে জানতে চান তাঁর ছেলে-মেয়েরা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে কি না।

হিরু মিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও নিজে তিনি অত্যন্ত সৎ আর সজ্জন ব্যক্তি। মানুষকে সব সময় সততার শিক্ষা দেন। নিজের সন্তানদের মানুষ করছেন একটি মাত্র মূলমন্ত্র দিয়ে। আর তা হচ্ছে সততা, সত্যবাদিতা ও পরিশ্রম। তিনি মনে করেন, এই তিনটি গুণ থাকলে যেকোনো মানুষ তার মেধা দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। নিজেকে উদ্ভাসিত করতে পারে জাতির সার্থে।

রিয়াজের সাথে সুরমা মেইল ট্রেনে রাতের বেলা ঢাকায় এসেছেন হিরু মিয়া। যে কারণে রেললাইনের দুই পাশের কিছুই তাঁর দেখার সুযোগ হয়নি। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় থাকলেন। বেড়ালেন কাঙ্ক্ষিত সেই চিড়িয়াখানা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফ্যান্টাসি কিংডমসহ অনেক জায়গায়। ঢাকায় আসার পর থেকে তিনি ছেলের মেসেই আছেন। কাল তিনি বাড়িতে ফিরবেন। এই সাতটা দিন তাঁর কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হয়েছে। তিনি বাড়িতে ফেরার জন্য উদগ্রীব, কেননা সন্তানদের সামনে বসে শোনাবেন রাজধানী শহর দেখার অভিজ্ঞতা। গ্রামের চা স্টলে বসে গল্প করবেন। সবাই নিবিষ্ট মনে বসে বসে শুনবে হিরু মিয়ার এই সাত দিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত। রাতের খাবার খাওয়ার পর ঘুমোতে যাওয়ার আগে হিরু মিয়া ছেলে রিয়াজকে কাছে ডেকে বললেন-

 বাবা রিয়াজ, "তর ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানর পর আমার খালি একটা কথাই বারবার মনো ওর। আমার সারা জীবনর কষ্ট আর স্বপ্ন সার্থক ওইছে আইজ। তরে আমি হাছারির একজন ভালা মানুষ বানাইতে পারছি। এই সাত দিনে ওত ভালও লাগছে আমার, মনে ওয় জীবন আমার জীবন বাড়ি গেছে। জানে কর আরও বেশি দিন সময় বাঁচতে। ঢাকাত আওয়ার দিন তুই আমারে রাইতকুর বেলা লইয়া আইলি। আমি সারা রাস্তায় কোনতা দেখতে পারছি না। আমরে যখন বাড়িত লইয়া যাইবি, দিনর বেলা ট্রেইনো করিয়া নিয়া যাইবি। আমি জানালার কানদাত বইয়া সবকিছু দেখি দেখি বাড়ি জাইমু।"

বাবার কথা কেড়ে নিয়ে রিয়াজ চাকলাদার তখন বললেন-

ঠিক আছে বাবা, তোমাকে দিনের বেলাতেই নিয়ে যাব। কাল সকাল দশটায় ট্রেন। দিন থাকতেই বাড়িতে পৌঁছাব আশা করছি। সারা দিন বেড়িয়েছ, তাই অনেক ক্লান্ত। এখন ঘুমাও।

সকাল সাড়ে নয়টার পরপরই কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে যান তাঁরা। লোকাল একটি ট্রেনে জানালার পাশে সিট পেয়েছেন হিরু মিয়া। এতে ভীষণ খুশি তিনি। তাঁর পাশেই বসেছেন রিয়াজ। নির্ধারিত সময়ই ট্রেন ছেড়ে দেয়। রাস্তার দুই পাশের এটা-ওটা বিষয়ে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন হিরু মিয়া। একসময় ট্রেন এসে থামে বিমানবন্দর স্টেশনে। তখন রিয়াজ তাঁর বাবার উদ্দেশে বললেন-

বাবা, এখানেই আমাদের নামতে হবে। কেননা কিছু কাজ বাকি আছে, সেগুলো শেষ করে তবেই আমরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেব। এসো আমার সাথে – বলেই নামার প্রস্তুতি নিলেন।

ছেলের কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে হিরু মিয়া নেমে পড়লেন। রিয়াজ বাবাকে সাথে নিয়ে হেঁটে সরাসরি চলে গেলেন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ডোমেস্টিক ইনডোরে ঢুকলেন তাঁরা। এরপর লাগেজ চেকিংয়ের পর বাবাকে নিয়ে বসলেন ওয়েটিং স্পেসে। তখন হিরু মিয়া ছেলের উদ্দেশে বললেন-


 এখানো তর কিতা কাম? আমরা নিরাই ওইয়া বইয়া আছি কেন? বাড়িত কুন সময় যাইমু? মন চার তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাইতে।

রিয়াজ তখন বললেন-

এই তো বাবা, আর ঘণ্টাখানেক পরই আমরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেব। ততক্ষণ তুমি কফি খাও – বলেই তিনি কফি বারে গিয়ে দুই মগ কফি নিলেন। ফিরে এসে বাবার হাতে একটি মগ দিয়েই বসলেন পাশাপাশি। কফিতে প্রথম চুমুক দিয়েই হিরু মিয়ার মুখটা কেমন কুচকে উঠল। বিস্বাদের কিছু খেলে যেমন হয়, ঠিক তেমন। তাই ছেলের উদ্দেশে বললেন-


"কফি মনে ওর আগুনে বেশি জ্বাল দিয়া পুড়িয়া ফালাইছে। কিলা জানি তিততা তিততা, পুড়া পুড়া গন্ধ রে বাবা। তুই আমারে এর থাকি এক কাপ চা দিলা।" রিয়াজ কিছুটা হেসে বললেন-

না বাবা, কফির স্বাদ এমনই। প্রথম খাচ্ছ তো, তাই এমনটা মনে হচ্ছে তোমার কাছে।

কফি খাওয়া শেষ করে রিয়াজ বোর্ডিং পাসের কাজ সম্পন্ন করলেন। এরপর বাবাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন সরাসরি বিমানের গেটে। হিরু মিয়া তখন অবধি জানেন না যে কী ঘটতে যাচ্ছে। বিমানে ওঠার আগে আগেই তিনি বললেন-

রিয়াজ, ইতা কী?

রিয়াজ বললেন-

বাবা, এটা বিমান।

আকাশে যে বিমান উড়তে দেখো, সেই বিমানে চড়ে আজ আমরা বাড়িতে যাব। সরাসরি সিলেটে গিয়ে নামব। প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে। হিরু মিয়া ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে সারা জীবন আকাশ দিয়ে আধ হাত পরিমাণ লম্বা যে বিমান ধীরে লয়ে উড়ে যেতে দেখেন, সেই বিমানের সামনে তিনি এখন দাঁড়িয়ে। কিন্তু তিনি বিমানে উঠতে নারাজ। ছেলেকে বললেন-

বাপরে রে, আমার যে ডর করের। চল আমরা ট্রেইনো করি যাই। লুঙ্গি পরিয়া আমারে কিতা বিমানও উঠতে দিবো নি?

কেন দেবে না। অবশ্যই তুমি বিমানে উঠবে। আর এখন ট্রেনে যাওয়া সম্ভব নয়, কেননা বিমানে টিকিট কাটা আছে। না গেলে টাকা তো ফেরত দেবে না। চলো উঠি – বলেই তিনি বাবাকে ধরে বিমানে উঠে পড়লেন। বিমানের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় তাঁদের সিট। জানালার ধারে বসলেন হিরু মিয়া। বিমানের ভেতরে এদিক-ওদিক দেখছেন শুধু।


প্লেন আকাশে উড্ডয়নের পর থেকে জানালার বাইরে মুগ্ধতার সাথে দেখছেন হিরু মিয়া। তিনি এখন বাস্তবে আছেন নাকি স্বপ্ন দেখছেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। বিমানটি যখন নির্দিষ্ট উচ্চতায় থিতু হলো, তখন হিরু মিয়া ছেলেকে বললেন-

"রিয়াজ, এই বিমানরে নিচো থাকি যে ছোট লাগের? আগে জানলে তর মারে কইয়া আইতাম আকাশর বায়দি তাকিয়া থাকতা। তাইলে আমাদের দেখতা পারতা।"

 জি বাবা, বিমানটিকে নিচ থেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। আর এটি ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেটে গিয়ে নামবে। তাই আমাদের বাড়ি থেকে হয়তো এটিকে দেখা যাবে না।

হিরু মিয়া বিমানে ওঠার পর থেকেই কেমন যেন অন্যমনস্ক। চেয়ারের হাতলের ওপর বাম হাতটা রেখে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছেন জানালার ওপারে। পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র মেঘগুলোকে কাটিয়ে বিমান উড়ে চলেছে আপন গন্তব্যে। আর এদিকে হিরু মিয়া ফিরে গেছেন আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের একটি দিনে। ওই দিন তিনি খুব কাছ থেকে বিমান উড়তে দেখেছিলেন। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। তিনি আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন সিলেটের বিভিন্ন জায়গায়।

 অক্টোবরের শেষের দিকে কোনো এক বিকেল। হিরু মিয়া ছদ্মবেশে তাঁর বাড়ির অদূরেই কুশিয়ারা নদী পার হচ্ছিলেন নৌকায় করে। মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দে কয়েকবার চক্কর দিল পাকিস্তানি দুটি জঙ্গি বিমান। এত নিচ দিয়ে যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল মাথার ওপর ভেঙে পড়বে। খুব আতঙ্ক আর সন্তর্পণে নদী পার হলেন হিরু মিয়াসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। পার হওয়ার পরপরই এলাকার পরিচিত একজনের কাছে খবর পেলেন, আজ পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিত আক্রমণ করেছে তাঁদের এলাকায়। পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামের হজরত জাহান শাহ মওলার মাজারসংলগ্ন মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে মুসল্লিরা বের হচ্ছিলেন। এ সময় কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা সেখানে একুশজনকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে। মুসল্লিরা সবাই রোজা ছিলেন। কেননা তখন রমজান মাস চলছিল। এই একুশজনের মধ্যে ছিলেন হিরু মিয়ার বাবাও।

হিরু মিয়ার দুচোখ বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে জল। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয়জন বাবাকে হারিয়েছিলেন ওই দিন।

রিয়াজ চাকলাদার বুঝতেও পারলেন না পাশের সিটে বসে তাঁর বাবা স্মৃতিচারণার কোন মহাসাগরে নৌকা বাইছেন। এমন সময় বিমানের মাইকে ঘোষণা এল, ‘আপনারা যাঁর যাঁর সিটবেল্ট বেঁধে ফেলুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বিমান সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করবে।’



লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক।

এমএসএম / এমএসএম