আস্থার সংকটে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা অধিক গুরুত্ব বহন করে।প্রতিটি মানুষের সঠিক চিকিৎসা পাওয়া তার মৌলিক অধিকার।দেশের প্রতিটি মানুষকে সঠিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।এক্ষেত্রে গড়িমসি করার কোন সুযোগ নাই। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা আগের চেয়ে অনেক দুর এগিয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্ত এই অগ্রগতির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি বিশেষ করে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাওয়া আজও নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার অভাব না থাকলেও অব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে মানুষ তাদের প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এটা বলাই যায়। কারণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে নজর দিলে তার সঠিক চিত্র ফুটে উঠে যদিও গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসাব্যবস্থা শহরের মতো উন্নত নয় এই সমস্যা ভারতেও আছে এবং বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই এই সংকটে আক্রান্ত। মানবসভ্যতার ১৫ হাজার বছরের ইতিহাসে এটা প্রমাণিত যে গ্রাম আছে বলেই শহরের জন্ম হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি শহরের বেঁচে থাকার খোরাক জোগায়। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ গ্রামে থাকে, অথচ বাকি ৩৫ শতাংশের জন্য আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ ও সেবা নিয়োজিত এই বৈষম্যের দায় কার। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। ঢাকায় কিংবা অন্যান্য বড় শহরে রোগী নিয়ে চিকিৎসা করানো প্রায় অসম্ভব। এখনো তাদের একমাত্র ভরসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু অভিযোগ আছে, সেখানেও তারা উপযুক্ত চিকিৎসা পায় না। চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই, রোগ পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, অ্যাম্বুল্যান্স বিকল হয়ে আছে-এ রকম আরো কত কী।
তাছাড়া সেখানে রোগীদের ইনজেকশন দেওয়া, কাটাছেঁড়া করা, সেলাই, ড্রেসিং-সবই করতে হয় ওয়ার্ড বয়দের। বেশিরভাগ হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ সব ধরনের জনবলেরই অভাব রয়েছে। এই চিত্র শুধু এক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নয়, সারা দেশেই এমন করুন অবস্থা। লোকবলের অভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এক্স-রে মেশিনসহ রোগ পরীক্ষার অন্যান্য যন্ত্রপাতি বছরের পর বছর অচল হয়ে পড়ে থাকে। এমনকী অ্যাম্বুল্যান্সও বিকল হয়ে থাকে। সরকার স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি নিচ্ছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে কী করে? আমরা আশা করি,দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই দুরবস্থা বিবেচনায় হাসপাতালের কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে লোকবল নিয়োগসহ দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ১৯৭২ সাল থেকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রথম ডাক্তার নিয়োগসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা হয়। চিকিৎসকসহ সেবাদানকারীর বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয় সেখানে। প্রথম দিকে ডাক্তাররা গ্রামে যেতে অনীহা প্রকাশ করলেও স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে প্রথম ব্যাচের ডাক্তারদের উপজেলায় যোগদানের মাধ্যমেই উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যাত্রা শুরু। গ্রামাঞ্চল ও পৌরসভার মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বলে রাখা ভালো, চিকিৎসাসেবা পাওয়া নাগরিকের অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার। তাই সরকার যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গ্রাম, ইউনিয়ন,উপজেলা,পৌরসভা, জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে বিভিন্ন ক্লিনিক, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসপাতাল গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের চিকিৎসাসেবা নেওয়ার অন্যতম ভরসা হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
কারণ তাদের পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই এই মানুষগুলো কম খরচে ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়ার জন্যই আসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।সরকার জনগণকে সুলভ মূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এসব কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকাল এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখানোর জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে রোগীকে স্লিপ নিতে শুরু হয় দুর্ভোগ। তারপর, পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার না থাকা এবং ডাক্তাররা ঠিক সময়ে চেম্বারে না আসায় রোগীকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। যার দরুন রোগী আরো অসুস্হ হয়ে পড়েন। এ ছাড়া ডাক্তারদের নিয়েও রয়েছে রোগীদের নানা অভিযোগ, ডাক্তাররা রোগী ভালো করে দেখেন না, রোগীর কথাগুলো ভালোভাবে শোনেন না ও গতানুগতিক ওষুধ প্যারাসিটামল ও এন্টাসিড ইত্যাদি লিখে দিয়ে তাদের দায় সারে। এমনও অভিযোগ আছে যে, তারা রোগীদের কাছ থেকে আবারও বাড়তি টাকা নেন, যেসব রোগী ভিজিট দেন, তাদের ভালোভাবে দেখেন আর যারা দেন না, তাদের দায়সারা সেবা দিয়ে বিদায় করেন। এ যেন অফিস টাইমে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখার মতো অবস্থা। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থার অভাব শুধু সাধারণ রোগীদেরই নয়, অনেক উর্ধ্বতন র্কমর্কতা, সরকারি আমলা, এমপি মন্ত্রীদেরও। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা না থাকার কারণ, প্রয়োজনীয় দক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি না হওয়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা, মেধাবী চিকিৎসকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা, কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়াও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে জরুরী রোগী দেখানোর ক্ষেত্রে অধিক সিরিয়াল।বেশির ভাগ নির্ভুল রোগ নির্নয়ের ক্ষেত্রে এক ডায়গনষ্টিক সেন্টারের সাথে অন্য ডায়গনষ্টিক সেন্টারের রিপোর্টে মিল না থাকা।
এছাড়াও টেকনিশিয়ান এর অভাব,প্রয়োজনীয় ডাক্তারের স্বল্পতা, ডাক্তারদের বাসা ও চেম্বারের অভাব, নিরাপত্তার অভাব, এছাড়া প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারনে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। প্রতি বছর স্বাস্থ্যখাতে গৃহীত বাজেটের এক অংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বরাদ্দ করা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ওষুধ না পাওয়ার পিছনে কারণ কি?কেন রোগীকে বাধ্য হয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হবে? এছাড়াও অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে জনবল সংকট খুবই প্রকট। তাই অনেক রোগী জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হন।অধিকন্তু, অপারেশন থিয়েটারগুলোতেও অস্ত্রোপচার হয় না বললেই চলে।এতে রোগীকে বাধ্য হয়ে জেলা বা বিভাগীয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। ফলে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফির মতো চিকিৎসা সরঞ্জামের সুবিধা একেবারে নেই।তাই রোগীকে বাইর থেকে এক্সরে, আলট্রাসনো-গ্রাফি করার জন্য অনেক বেশি টাকা গুনতে হয়। তাছাড়া প্রায় অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যাম্বুলেন্স নেই। টয়লেটগুলোর অবস্থাও খুব শোচনীয়। টয়লেটগুলোতে নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা। উল্লিখিত নানাবিধ সমস্যা ও অব্যবস্থাপনার কারণে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর সেবার মান বলতে গেলে শূন্যের কোটায় সৃষ্ট সমস্যা সমাধানকল্পে প্রয়োজন-প্রতিটি উপজেলায় যে স্বাস্থ্য কমিটি আছে তার দায়িত্ব উপজেলা স্বাস্থ্য কম- প্লেক্সের চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন করা ও জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা; এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে উচ্চতর কর্তৃপক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা আনয়ন করা। এবং স্বাস্থ্য কমিটি নিয়মিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনার ওপর রিপোর্টও তৈরি করা, যেখানে জনগণেরও বক্তব্য থাকবে, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের। এক্ষেত্রে, সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এ কমিটির রিপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি উপজেলায় প্রয়োজনীয় কাঠামোগত উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় উপকরণ, ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জাম যথাসময়ে জোগান দেওয়া নিশ্চিত করা।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর সেবাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সময়ের দাবি। দেশ উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে শিক্ষা ও চিকিৎসা। স্পর্শকাতর এ দুটি বিষয়কে কোনো ভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নাই,কিন্তু দুর্নীতি অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই দুটি বিষয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অনস্বীকার্য যে, স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অথচ দুঃখজনক এ দীর্ঘ সময়ের প্রয়াস প্রচেষ্টায় অর্জিত সাফল্যকে অনেকে নিজেদের তাৎক্ষণিক সাফল্য বলে দাবি করেন। মহামারী আকারে ধেয়ে আসা করোনা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক ব্যাধি বিস্তার রোধকল্পে সময় থাকতে উপযুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সে কাজে সরকারের তরফে নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখাশোনা আবশ্যক হবে, গণস্বাস্থ্য উন্নয়নে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবার অংশগ্রহণের অনিবার্য আবশ্যকতা রয়েছে। নীতি কৌশল বাস্তবায়নে দলীয় বা সংগঠনগত দৃষ্টিভঙ্গির বিবরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলে সাফল্যকে বিলম্বিত করবে মাত্র। আর্থসামাজিক পরিবেশ উন্নয়নে জনস্বাস্থ্য একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। একে উপেক্ষা কিংবা এ খাতে অপারগতার অবকাশ খুব কম। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজমান। তাদের প্রত্যেকেরই বুকে রয়েছে অসন্তুষ্টির জমানো অনেক কাহিনি। কিন্তু তার পরও মানুষ শেষ পর্যন্ত চিকিৎসাকর্মীদের কাছেই আশ্রয় নেন। মানুষ বাঁচতে চায়। জীবন বাঁচাতে তারা নির্ভর করেন চিকিৎসাকর্মীদের ওপরই। সমস্যা হলো আমাদের চিকিৎসাসেবা অবহেলার বলয়মুক্ত হয়ে অগ্রাধিকারের শীর্ষে স্থান পায়নি। যদি পেত, তাহলে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য মাত্র পাঁচজন ডাক্তার বরাদ্দ থাকত না। আমাদের দেশে ৭৮ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে আর দেশের মোট চিকিৎসকদের প্রায় ৭০ শতাংশ বাস করেন ঢাকাসহ বড় বড় শহরে। এটা একটা বিরাট বৈষম্য এবং যা আমাদের চিকিৎসাসেবাকে বিরাট ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। চিকিৎসাসেবার বিরাজমান এই গ্যাপ কমানোর জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
এমএসএম / এমএসএম