যারা ভয় দেখাবে বরং তারাই ভয়ে থাকবে: র্যাগিং সতর্কতায় ভিসি সৌমিত্র
ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে নতুন স্বপ্ন নিয়ে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আর এর সঙ্গে সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা শুরু করেছে র্যাগিং নামক এক ভয়াবহ অপসংস্কৃতি। র্যাগিং শব্দের অর্থ নাকি ‘পরিচয়পর্ব’। কিন্তু বাস্তবে পরিচয়পর্বের নামে চলে মানসিক নির্যাতন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরনো শিক্ষার্থীদের সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা, বর্তমানে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতিতে সেটাকে র্যাগিং বলে অভিহিত করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন শেখানোর নামে তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
এর ফলে বিগত বছরগুলোতে অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলেও গেছেন। কাউকে আবার ডাক্তারের শরণাপন্নও হতে হয়েছে। বস্তুত, ক্যাম্পাসে আসা নবীনরা সর্বদাই র্যাগিংয়ের ভয়ে ভীত থাকে।
ক্যাম্পাসে দিন দিন র্যাগিং যন্ত্রণার মাত্রা বেড়েই চলেছে। যদিও সিনিয়ররা র্যাগিংকে ফান হিসেবেই মনে করেন। তারা মনে করেন, এর মাধ্যমে জুনিয়রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। সখ্য গড়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেখা হলে ভয়ে সালাম দিয়ে সম্মান দেখানো আর আড়ালে গিয়ে বকা দেয়া কখনও সম্মান হতে পারে না।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটাকে অনেকে সম্মান ও শ্রদ্ধা বলে মনে করেন! আজ যে ছেলেটি র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, সে নিশ্চয়ই আগামীতে এর চেয়ে বেশি মাত্রায় র্যাগিং করার পরিকল্পনা করবে। ফলে এ অপসংস্কৃতি বৃদ্ধি পেতেই থাকবে।
অনেকেই ক্যাম্পাসে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ককে ভাই-বোনের সম্পর্ক বলে থাকেন। যদি ভাই-বোনের সম্পর্কই মনে করেন, তাহলে তাদেরকে র্যাগিংয়ের নামে অশ্লীল কথাবার্তা বলতে বাধ্য করছেন কেন? মেয়েদের প্রপোজ করানো, জোর করে গান গাওয়া, নৃত্য করানো ইত্যাদি কি শিক্ষার অংশ? এর মাধ্যমে তারা কী শিক্ষা দিচ্ছেন? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘটনাটি সত্যিই বেদনাদায়ক।
বিশ্ববিদ্যালয় হল মুক্ত জ্ঞানচর্চার জায়গা। সেখানে আমরা শুরুতেই কেন শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছি? কেন তাদের চলাচলে হস্তক্ষেপ করছি? প্রকৃতপক্ষে এটা কখনই কাম্য নয়।
র্যাগিং এর বদলে সিনিয়রদের সহযোগিতা পূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করে স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী ফাওজিয়া তাবাস্সুম ঐশী বলেন, আমরা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ তম আবর্তন এবং ৭ম আবর্তনের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের পরিবেশ সব কিছুই নতুন। তাই এই পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে বড় ভাই আপুরা সহযোগিতা ও আন্তরিকতার সাথে আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের সিনিয়র শিক্ষার্থী মোস্তাফিজ বলেন, "হাজারো স্বপ্ন নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। পরিবার থেকে দূরে সম্পূর্ণ নতুন এবং অপরিচিত পরিবেশে এসে অনেক সময় তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্রজদের দ্বারা বিভিন্ন রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। এরকম আচরণ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা নবীনদের জন্য আন্তরিক, সৌহার্দ্যপূর্ন ও সহযোগিতামুলক পরিবেশ প্রত্যাশা করি। আমরা চাই নবীন শিক্ষার্থীরা যেন নির্ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই জ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারে। সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা অগ্রজদের দায়িত্ব। বন্ধ হোক র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় হোক জ্ঞান, নীতি ও মনুষ্যত্ববোধ চর্চার জায়গা।"
এবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছে এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর র্যাগিংকে নিষিদ্ধ করে বলেন, "আমরা নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই যেহেতু উচ্চশিক্ষিত, এখানে এমন একটি জগৎ আমরা তৈরি করবো যেটির সাথে বাইরের পার্থক্য থাকবে। এই জগতের মূল চেতনা হবে আমাদের সুসংস্কৃত জীবনবোধ।"
তিনি আরো বলেন, "এখানে কোনো ভয় থাকবে না,ভীতি থাকবে না, র্যাগিং থাকবে না, জোর করে শ্রদ্ধা আদায় থাকবে না। এখানে আমরা বুকে টেনে নেওয়ার চর্চা করতে চাই। এর বাইরে যারা যাবে তাদের জন্য আমরা বেশ কঠোর। এখানে যারা ভয় দেখাবে বরং তারাই ভয়ে থাকবে।"
এমএসএম / এমএসএম