শ্রাবণে চিরবিদায়

যুগে যুগে কবিরা সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়েই যেন পথ চলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রঠাকুর ও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি কালের কবি নন, কালজয়ী কবি। তাকে বিশ্বকবি উপাধি দিয়েছিলেন ব্রক্ষাবান্ধব উপাধ্যায়। তার পূর্ব পুরুষের আদি বসতি খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে। তিনি ঢাকায় দুইবার আসেন, প্রথমবার ১৮৯৮ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালে। তিনি একই সাথে দুইটি দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা।
শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত ‘শিলাইদহ কুঠিবাড়ি’। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। তার সৃষ্টিকম অবিস্মরণীয় তিনি যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। চির অমর হয়ে থাকবেন। তার সাহিত্যকর্ম স্রোতস্বিনি বহমান নদীর মতো। পুনরায় বছর ঘুরে ফিরে এসেছে শ্রাবণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম মহাপ্রয়াণ দিবস। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ তিনি কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলা একাডেমি অনলাইনে প্রবন্ধপাঠ, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অনুষ্ঠানে ‘পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার এবং বেসরকারি টেলিভিশনগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও নাটক প্রচার করে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ‘শ্রাবণের আমন্ত্রণে’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচার করবে ছায়ানট।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী, গল্পকার ছিলেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘গীতাঞ্জলী’। এই কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৩০-এর দশক থেকেই রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। জীবনের শেষ চার বছর তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন। ১৯৩৭ সাল থেকেই তার দীর্ঘকালীন অসুস্থতার সূত্রপাত। এরপর কিছুটা সুস্থ হলেও ১৯৪০ সালে তার অসুস্থতা বেড়ে যায়। জীবনের শেষ বেলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা তাকে ব্যথিত করে। জোড়াসাঁকোর প্রাসাদে ১৯৪১ সালে অসুস্থ কবি শান্তিনিকেতন ছেড়ে শেষবারের মতো চলে আসেন অসুস্থ কবি। অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি কবিতা লিখেছেন। তিনি বোধহয় বুঝেছিলেন তার, সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই বর্ষা, এই শ্রাবণের ধারা তার জীবনে আর ফিরে আসবে না। তাই তিনি লিখেছেন- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট! রক্ত কমলকর, রক্ত-অধরপুট, তাপ বিমোচন করুণ কোর তব মৃত্যু-অমৃত করে দান।’ ‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে, গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে’।
‘গীতাঞ্জলি’র শেষ পর্যায়ে ১৫৭তম কবিতায় কবি বলেন, ‘দিবস যদি সাঙ্গ হল/না যদি গাহে পাখি/ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে/এ বার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি’। কবি (১৪ শ্রাবণ) জোড়াসাঁকো মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রানী চন্দকে লিখে নিতে বলেছিলেন ‘তোমার সৃষ্টির পথ/রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে,/হে ছলনাময়ী’। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় কবি লিখেছেন ‘মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর! আজি তার তরে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে/জীবন আমার এত ভালবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়/মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়’।
১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ ‘ক্ষণিকা’ প্রকাশিত হয় শ্রাবণেই। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন‘...মরার পরে চাইনি ওরে অমর হতে/অমর হব আঁখির তব সুধার স্রোতে।’ আবার ‘ক্ষণিকা’র শেষ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘থাকব না ভাই থাকব না কেউ/থাকবে না ভাই কিছু।/সেই আনন্দে যাও রে চলে/কালের পিছু পিছু।’ এ বেদনা চিরকালের, চিরদিনের। কবি ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ বেলা ১২টা ১০ মিনিটে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রকাব্যে মৃত্যু এসেছে বিভিন্নভাবে। জীবদ্দশায় মৃত্যুকে তিনি জয় করেছেন বারবার। মৃত্যুবন্দনা করেছেন তিনি এভাবে- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট! রক্ত কমলকর, রক্ত-অধরপুট, তাপ বিমোচন করুণ কোর তব মৃত্যু-অমৃত করে দান’।
জীবনের শেষ নববর্ষের সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার সাধের শান্তিনিকেতনে। সেদিন তার কলমে রচিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংকট’ নামের অমূল্য লেখাটি। তারও ক’দিন পর ১৯৪১ সালেরই ১৩ মে লিখে রাখলেন, রোগশয্যায় শুয়েই ‘আমারই জন্মদিন মাঝে আমি হারা’।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতে কখনও তিনি শয্যাশায়ী, কখনও মন্দের ভালো। শেষের দিকে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতনের আশ্রম বালক-বালিকাদের ভোরের সঙ্গীত অর্ঘ তিনি গ্রহণ করেন তার উদয়ন গৃহের পূবের জানালার কাছে বসে। উদয়নের প্রবেশদ্বার থেকে ছেলেমেয়েরা গেয়ে ওঠেন কবিরই লেখা ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো আজ’।
আগস্টের প্রথম দিন দুপুরবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের ‘হিক্কা’ শুরু হয়। কবি কাতর স্বরে তখন উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন, ‘একটা কিছু করো, দেখতে পাচ্ছো না কী রকম কষ্ট পাচ্ছি।’ পরের দিন হিক্কা থামানোর জন্য ময়ূরের পালক পুড়িয়ে খাওয়ানো হলেও তাতে কিছুমাত্র লাঘব হল না। আগস্টের ৩ তারিখ থেকে কিডনিও নিঃসাড় হয়ে পড়ে। ৬ আগস্ট রাখিপূর্ণিমার দিন কবিকে পূর্বদিকে মাথা করে শোয়ানো হল। পরদিন ২২শে শ্রাবণ, ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে জপ করা হলো ব্রাহ্মমন্ত্র ‘শান্তম, শিবম, অদ্বৈতমৃ’ ‘ৃতমসো মা জ্যোতির্গময়ৃ’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন মৃত্যুপথযাত্রী। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ঘড়িতে তখন ২২শে শ্রাবণের বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট। কবি চলে গেলেন অমৃতআলোকে। বাসস
এমএসএম / এমএসএম

আসছে আরফান হোসাইন রাফির প্রথম কাব্যগ্রন্থ: ‘সুদিন ফিরে আসছে’

বহুরূপী

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে মানিক লাল ঘোষের একগুচ্ছ কবিতা

একুশ ও আমরা

মানিক লাল ঘোষের একগুচ্ছ একুশের ছড়া

অপূর্ব চৌধুরী'র নতুন বই

সাহায্যের হাত বাড়াই

কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার পেলেন সব্যসাচী লেখক মীর লিয়াকত আলী

একজন নসু চাচা

বলি হচ্ছে টা কী দেশে

জগলুল হায়দার : তরুণ ছড়াকারের ভরসাস্থল

দিকদর্শন প্রকাশনীর সফলতার তিন যুগ
